পরীর বাড়ি থেকে ঠনঠনের বিল তিন কিলো মিটার। সে কিছুটা সাইকেল চালিয়ে কিছুটা সাইকেল ঠেলে জমিতে পৌঁছালো।ধানের জমিটা আজকে হাটকিয়ে ফেলতে হবে। পরের দিন সর্ষে কাটবে। ধানের চারার গোড়ার মাটি দশ আঙুলে হাল্কা আলগা করে দিচ্ছে। আলগা মাটিতে গুচ্ছমূল বেরিয়ে ধানগাছের গোছা মোটা হয়ে ওঠে। ঝাড় যত মোটা হয়; ফলন তত বেশি। আগাছা উপড়ে তুলে আলের উপর রেখে দিচ্ছে। মেঘলা আকাশ। রোদ ওঠেনি। ভ্যাপসা গরমে শরীরটা আনচান করছে। খিদেয় পেট চুইচুই করছে। একটু জিড়িয়ে নিতে পারলে হত। কোমর ধরে গেছে। খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল পরি। দুই হাতে চোখ আড়াল করে দেখছে তিনু আসছে কিনা।
ওই তো তিনুর মাথাটা সর্ষেক্ষেতের উপর ভাসতে দেখা গেল। আর দুটো ক্ষেত পেরোতে পারলেই পুকুর পাড়ে উঠে আসতে পারবে। আজ একটু কড়া কথা বলতেই হবে তিনুকে। মাঠের ভাত এতবেলায় আনলে বাঁচা যায়? মুখ ঝামটা দিলে সেও শুনিয়ে দেবে। পুকুরের পাড় বেয়ে উপরে উঠে এল পরি। কলে হাত -পা ধুয়ে চালার মধ্যে মাটির উপরে বসে পড়ল। তিনু গামছার গিট খুলে থালা সরিয়ে ভাতের গামলা সামনে এগিয়ে দিল। নাতি তিনুকে কিছু বলতে পারল না। গরম ভাত দেখে সব রাগ জল হয়ে গেল। গো গ্রাসে গিলছে ভাতের গরাস। কিছুটা ভাত থেকে গেল। পুকুরে ফেলতেই মাছের ঝাঁক ভেসে উঠল। শোল মাছের ঝাঁক।
এই বিলে বছর দুয়েক আগে দেশি মাছের রমরমা ছিল। মার্চ মাস থেকে বৃষ্টি হওয়ায় নদী, খাল-বিলে বেশ জল ছিল। পরি আশ মিটিয়ে মাছ ধরছে। রোদ উঠলে মাছ লাফিয়ে পাটের জাগে উঠে আসে। জলে দাঁড়িয়ে পাট ধোয় যারা পা নাড়াতে হয় ঘনঘন। মাছে এসে ঠোকরায়। জোক লাগলে অবশ্য বোঝা যায় না।। মাছ কোথা থেকে এল। বিগত বেশ কয়েক বছর পর এই অঞ্চলের মানুষ খয়রা,খলসে, পাটা খলসে, পুটি, শোল, লাঠা, জিয়োল, বেলে, পাকাল, প্রচুর পরিমাণে ধরে খেয়েছে। পরী বিক্রি করেছে; অন্যদের দিয়েছে। টিনের ডোঙা জিকে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখত। ডিঙি খুলে জাল, রাবানি দোয়াড়ি, আটল নিয়ে ভেসে পড়ত। ফেরার পথে সাপলা, পাট, পাটকাঠি বোঝায় করে নিয়ে এসে ডাঙায় তোলে।
পরিদের পাড়ার সেচ দপ্তরের আধিকারিক বিলের মাঠে অনেক জমি কিনেছে। ছুটিতে বাড়ি এসে মাঠের কাজে লেগে যায়। পেঁয়াজের সময় তোলা, কাটা, বস্তা বোজায় করার কাজে মুনিসদের সঙ্গে হাত লাগায়। পাল্লা দিয়ে পরীর সঙ্গে মাছ ধরে। ছিপ দিয়ে মাছ ধরার ভয়ানক নেশা। বাড়ির পাশে খালে ছিপ ফেলে সারাদিন বসে থাকে। চাকরি করে লোকটা টাকার কুমির হয়ে গেছে; তবুও মাছ ধরার এত বাতিক কেন - কে জানে? কার্তিক মাস। পলদার জল ঝোর নদী হয়ে থগবগের ব্রিজের নীচ দিয়ে কুলকুল করে খালে এসে পড়ছে। জনা তিনেক থগবগের ব্রিজের ওপাশে খ্যাপলা জালে মাছ ধরছে। মাছ ধরা একরকমের নেশা। মাছ ধরা দেখাও নেশা। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে ছিপ নিয়ে পরীর সঙ্গে কোথায় কোথায় মাছ ধরতে চলে যায়। বিলের জল শুকিয়ে আসায় থগবগের ব্রিজের এখানে পরি প্রতিদিন মাছ ধরে। ছোটোবেলার নেশি। মেছো পরি বলে ডাকত অনেকে। বালক পরি এখন বয়ষ্ক লোক। ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়েছে। নাতি হয়ে গেছে। তার আগের মতোই নির্মেদ শরীর। তেল চোয়ানো কুচকুচে কালো চামড়া বয়সের কারণে অথবা মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন কাজ করার ফলে তামাটে হয়ে গেছে। কদম ছাট চুলের মধ্য থেকে দুই, একটা সাদা চুল উঁকি-ঝুকি মারছে। কটা গোঁফ। থ্রি কোয়ার্টার প্যাণ্টের উপর কষে গামছা বাঁধা কোমরে। বালক বয়সে পরির খেলার সঙ্গীর থেকে মাছ ধরার সঙ্গী বেশি ছিল। স্কুলের সময়টুকু ছাড়া সারাদিন টো টো করে ঘুরত। মাছ ধরা,খাপড়া খেলা, কাচের গুলি, হাড়ের গুটি, ডাঙ্গুলি খেলায় মেতে থাকত সারাক্ষণ। পড়াশোনার প্রতি খুব অনীহা ছিল। প্রাইমারি স্কুলটাও টপকাতে পারেনি। সরল আর সৎ হওয়ায় বড়ো বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিল। আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল পেড়ে দেওয়ার জন্য ডাক পড়ত। কাঠবিড়ালী মতো তরতর করে যে কোনো গাছে উঠে যেত। অন্ধকার রাতে চোখগুলো জ্বলজ্বল করত।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ না হওয়ার বিশেষ কারণ ছিল। কাশীপুর পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মারামারি হওয়ার পর পড়া ছেড়ে দেয়। ও পাড়ার বদ ছেলেরা ছুটির ঘণ্টা বাজলেই আসনের এক কোনা ধরে অন্য পাড়ার ছেলে-মেয়েদের সপাৎ সপাৎ বাড়ি মেরে দে দৌড়। পরী মার খেয়ে হজম করার পাত্র ছিল না। পুলিশের ছেলেকে মেরে নাক ফাঁটিয়ে দিয়েছিল। তারপর আর স্কুলে যাওয়ার সাহস দেখাতে পারেনি। অভাবী সংসার। বড়ো বাড়িতে বেশ কয়েক বছর রাখালি করে। আর একটু বড়ো হয়ে মাঠের কাজ করতে হত। বিশেষ করে শীতের সময়। আমন ধান ওর বাবা আগা পেড়ে কেটে আঁটি বেধে দিত। পরি দুই হাতে দুই আঁটি ধান জলের মধ্য দিয়ে টেনে এনে ডাঙায় গাঁদা দিত। জল ঝরে গেলে মাথায় করে বাড়ি।
বালক পরী শীতের শুরুতে পাড়ার কয়েকজন জুটিয়ে নিয়ে কৈমারি,ডিগ্রী, ঠনঠনের বিলে মাছ ধরতে যেত। নারকেলের মালাই ঢাকনাওয়ালা ভাঁড় মোটা লাঠির মাথায় ঝুলিয়ে। হাতে থাকত খেজুরের ডাটা। পাতাগুলো ছোটো ছোটো করে কাটা। আমন ধান মাথা পেড়ে কাটা। জমির বুক নাড়ায় ঢাকা। উপর মাঠের জল শুকিয়ে গেলেও নীচের দিকে মানে ফরেস্টের দিকে চিকচিকানি জল। কাকড়ায় মাটি তুলে ডাই করে রাখে। পরিদের দল মাঠে এসে এমন গর্তের সন্ধানে ছড়িয়ে পড়ে। যে গর্তের মাটি কাচা অর্থাৎ শুকিয়ে শক্ত হয়ে যায়নি; সেই গর্তে খেজুরের ডাটা ঢুকিয়ে দিয়ে উপর-নীচ করবে কিছুক্ষণ। খেজুরের ডাটা দিয়ে গর্তের ভেতর ঘোলানোর ফলে ভেতরে থাকা কাকড়ারা পিলপিল করে উঠে আসে। জিয়োল মাছ গর্তের মুখের কাছে এসে তুগবুগ করে। পরি টপাটপ মাছের মাথাটি সাবধানে ধরে মালায় সরিয়ে ভাঁড়ে রাখে। বিকাল পর্যন্ত ভাঁড়টার অনেকটা ভরে ওঠে। ওদিকে পরির সঙ্গে যারা গিয়েছে তারা কেউ দু'চারটে পেয়েছে; কেউ পায়নি। কোন গর্তে মাছ আছে সেটা পরি খুব ভালো বুঝতে পারে। জলের স্রোত দেখেয় বোঝে মাছ আছে কী নেই। ছোটোবেলায় তার শরীরের কোথাও না কোথাও মাছের আঁশ দু'চারটে লেগে থাকত। জলের গতি দেখে বুঝেছে মাছ আজ তেমন ধরা পড়বে না; তবুও সকালের ওক্তোর টা হয়ে গেলে বাজারে যেতে হবে না। সব খেপে মাছ উঠছে না। খ্যাপলা জাল দিয়ে তিনজন মাছ ধরছে। মাছ বাজারের খরচটা বেঁচে যায়। খেত-খামারে, নার্সারিতে কাজে যাবার আগে যা হয় আর কী ! মাছ ধরার নেশা সাংঘাতিক। তার উপর জ্যান্ত মাছের ঝোল দিয়ে গরম ভাতের স্বাদই আলাদা! টানে টানে দে'ড় জনের ভাত খেয়ে ফেলে এক একদিন পরি।
সজনী তাই চাল একটু ধরেই নেয়। পরীর জালটাকে ছড়িয়ে ফেলার একটা কায়দা আছে; সবাই পারে না। তার কঞ্চির মতো দড় তামাটে ডান হাতে দড়ি পেঁচিয়ে ধীরে ধীরে গুটিয়ে তুলে নিয়ে এসে জাল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নেয় মাছ ধরা পড়েছে কিনা। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে খুব মাছ হল। সারা রাত-দিন দশ-পনেরোটা জাল জলে ঝপাঝপ পড়েছে থগবগের খালে। প্রত্যেকে জল থেকে জাল তুলে সরে দাঁড়িয়েছে অন্যজনকে জাল ফেলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। ঘুল্লি দিয়ে ঝোরের জল ব্রিজের তল দিয়ে বগবগ করে এসে পড়ছে থকবগের খালে। খাল, জল নিয়ে খেড়োদাড়ির মাঠে ঢেলে দেয়। বর্তমানে খালটি অনেক জল বহন করে নিয়ে গিয়ে ঢেলে দেওয়ার বল, শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। বছর বছর বাঁধাল দেওয়ায় খালে চরাট পড়েছে। দুধার থেকে আল ঠেলে খালটাকে কোন ঠাসা করেছে চাষীরা।
রাতে টর্চ জ্বেলে মাছ ধরে মানুষ। জলের তোড়ের শব্দের সঙ্গে মানুষের কোলাহল মিলেমিশে থকবগে গমগম করে। কার্তিক মাস পড়তেই জলের তোড় কমে এসেছে। পরী পাট কাটা ধোয়া শেষ হতেই দুইবেলা বিলে পাড়ি দেয় ডোঙা নিয়ে মাছ ধরতে। অধিকাংশই নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের লোক। মাহিষ্য, কপালিরা কিছু আছে। মাছ ধরার কাজটি একচেটিয়া জেলেদের পেশা নেই। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পালটে যায় রুটি রুজি।
২০২১ সালের ২৬শে জানুয়ারি থগবগের পুরানো ব্রিজ ভেঙে ফেলা হয়। নতুন ব্রিজ তৈরির জন্য পাশ দিয়ে মাটির রাস্তা বেঁধে দিয়েছে। ব্রিজের কাজ শুরু হলেও ধীর গতিতে এগোচ্ছিল। স্থানীয় মানুষদের দাবিতে জল নিষ্কাশনের জন্য তিনটি সেকশান হল। পরী সন্ধ্যেবেলাটা ব্রিজে ঠেক করতে আসে। পুরানো ব্রিজের সঙ্গে তার একটা ঘণিষ্ট যোগ ছিল। দলবেঁধে স্নান করতে আসত। বর্ষায় দুরন্তবেগে ছুটে চলা জলে ব্রিজের উপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে লাফিয়ে পড়ত। পাঁচ/সাতজন লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে প’ড়ে ভাসতে ভাসতে খালের শেষ মুখে গিয়ে ডাঙায় উঠে পায়ে হেঁটে আবার ব্রিজে চলে আসত। এক আধবেলা কাটিয়ে দিয়েছে কতদিন। চোখদুটোর লাল টকটকে হয়ে গেছে। কালো চামড়ার উপর সবুজ শেওলার আস্তরণ পড়ে গেছে। জিয়োল মাছের মতো কিলবিল করে বেড়িয়েছে। এখন যা জল হয় গাই গরুর গা ধোওয়ায়। কলের জলে নিজে স্নান করে। ক্লাবের ছেলেরা কিছুটা জায়গা পরিস্কার করে ক্রিকেট খেলে। ব্রিজে বসে পরি দেখে। ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে ওঠে ২০০০ সালের বাঁধ ভাঙা বন্যা। ব্রিজের উপর চার ফুট ঘোলা জল। স্রোতের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে গৃহপালিত পশু। চারিদিকে হাহাকার। মাটির দেওয়াল ভেঙে পড়ার ঝপঝপ আওয়াজ।বুক কেঁপে ওঠে। রাতে চোর ডাকাতের ভয়। পনেরো দিন বাড়ি ছাড়া। ওরা আশ্রয় নিয়ে ছিল বাজারের জেগে থাকা ডাঙায়। পরীর দুশ্চিন্তা হয় যদি আবার কখনও ওই রকম বাঁধ ভাঙা বন্যা হয়; তাহলে খাল-বিল দিয়ে জল বেরিয়ে নদী হয়ে সমুদ্রে পড়তে কতদিন লাগবে - একমাস? দুই মাস? না, ছয়মাস? এ চিন্তা পরীর মাথায় ঘুরপাক খায়।
(ক্রমশ)
আলোকচিত্রঃ লেখিকার কাছ থেকে প্রাপ্ত।