বিবিধ

মহাভারতঃ আজ গঙ্গার কথা



স্বপ্না সেন



গঙ্গা ও শান্তনু (১৮৯০)। শিল্পীঃ রাজা রবি ভার্মা।

ভারতীয় জনজীবনের চেতনায় রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। রামায়ণ মহাভারতের সর্বত্র এক অসাধারণ সমাজ দর্শন, ধর্মবোধ, রাজনীতি চেতনা, মানবতাবাদের সাথে স্বার্থবুদ্ধির সংমিশ্রণ, রণনীতির কূটকৌশল, ধর্ম অধর্মের সূক্ষ্ম অথচ জটিল সম্পর্ক সবকিছুর প্রতিফলন দেখা যায়। প্রায় পুরাকালের রাজরাজড়ার ক্ষাত্রতেজ, ব্রাহ্মণদের আত্মগরিমা, আর্য অনার্যের সংঘর্ষ, জমির লড়াই, রাজনৈতিক আগ্রাসন সবকিছুই যেন চিরকালীন সত্য। তাই এই দুই মহাকাব্য হোমারের ইলিয়ড অডিসির মতোই জনপ্রিয়।

রামায়ণ মহাভারতকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ফেলে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন অনেকেই। মহাভারতের বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে অতি নিপুণতার সঙ্গে বিশ্লেষণ করেছেন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী মহাশয়। বুদ্ধদেব বসু তাঁর নাটক তপস্বী ও তরঙ্গিনীতে ফুটিয়ে তুলেছেন হস্তিনাপুরের অন্দরমহলের এক বিশেষ অধ্যায়। প্রথম পার্থ নাটকেও তিনি মহাভারতের আশ্রয় নিয়েছিলেন। গজেন্দ্র নাথ মিত্র তাঁর সুবিখ্যাত পাঞ্চজন্য উপন্যাসে পাণ্ডবদের স্বর্গারোহণ পর্বটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপিত করেছিলেন। সৌরভ মুখোপাধ্যায় রবিবাসরীয় আনন্দ বাজারে মহাভারতের অলৌকিক ঘটনাগুলিকে যুক্তিসংগত ব্যাখ্যায় বিশ্লেষণ করেছেন। সুলেখিকা বাণী বসু তাঁর কালিন্দী লেখাটিতে সত্যবতী ও ভীষ্মের সমসাময়িক সময় ও চরিত্রগুলির আধুনিক পর্যালোচনা করেছেন। এরকম আরও অনেক চিন্তাধারা অনেকে গড়ে তুলেছেন এই মহাকাব্যদ্বয়কে নিয়ে। অর্থাৎ এটাই সেই সংস্কৃতি যা আমাদের অন্তর্গত রক্তের মধ্যে সতত প্রবহমান। একেই আমরা ট্র্যাডিশন বলি।

আমার এই বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার বয়সে ভারতের এই দুই অতুলনীয় সম্পদের কথা ভাবতে গিয়ে আরও এক চিরকালীন ট্র্যাডিশনের কথা মনে পড়ল। তিনি পুণ্যসলিলা গঙ্গা। হিমালয় থেকে নেমে এসে উত্তর ও পূর্ব ভারত বিধৌত করে সাগরে মিশে গিয়েছেন। তিনি পূজনীয়া, নমস্যা। তিনি আমাদের জীবনদাত্রী। কোন সুদূর কালে তাঁর আবির্ভাব এই মর্ত্যভূমিতে। তাঁর কতো রূপ, কতো পরিচয়। তিনি হিমালয়নন্দিনী। শিবের জটায় আবদ্ধ। তিনি সুরধুনী, তিনি জাহ্নবী, তিনি ভাগীরথী। এছাড়াও তাঁর আর একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তিনি ভীষ্মজননী। হস্তিনাপুরের চন্দ্রবংশীয় রাজা শান্তনুর প্রথমা স্ত্রী।

বলা যেতে পারে বেদব্যাসের মহাভারতের মূল আখ্যান গড়ে উঠেছে এই গঙ্গাকে কেন্দ্র করে। আমরা নিশ্চয়ই স্বীকার করে নিতে পারি মহাভারতের এক বিশিষ্ট চরিত্র গঙ্গা যিনি পরবর্তী কালের সুবিশাল কর্মকাণ্ডের দ্বার খুলে দিয়েছিলেন।

বেদব্যাসের লেখনী অনুযায়ী চন্দ্রবংশীয় রাজা শান্তনু নদীতীরে এক পরমা রূপবতী রমণীকে দেখে মুগ্ধ হন এবং বিবাহ প্রস্তাব রাখেন। রমণী সম্মত হন এবং নিজ পরিচয় দেন এই ভাবে যে তিনি হিমালয়ের বাসিন্দা এবং স্বাধীনতাপ্রিয়। তাঁর নাম গঙ্গা। বিবাহ সম্পর্কে তাঁর শর্ত আছে। তিনি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছা অনুসারে চলবেন। তাঁর কাজে কোনও প্রশ্ন করা যাবে না এবং বাধাও দেওয়া যাবে না। তাহলে তিনি রাজ্য ছেড়ে চলে যাবেন। শান্তনু এই শর্তে রাজী হলেন এবং বিবাহ সম্পন্ন হলো।

ঘটনার ঘনঘটা শুরু হল এরপর থেকে। গঙ্গা পরপর তাঁর সাতটি শিশু সন্তানকে জন্মমাত্রই নদীতে ভাসিয়ে দেন। শর্ত অনুযায়ী শান্তনু নিশ্চুপ থাকেন। ব্যতিক্রম ঘটে অষ্টমপুত্র জন্মদানের পরে তাকে নদীতে ভাসানোর সময়ে। শান্তনু বাধা দেন। গঙ্গা তাঁর শর্ত অনুযায়ী শিশুপুত্র নিয়ে চলে যান। মহাভারতের কাব্যিক আখ্যানের সূত্রপাত হলো এইভাবে।

গঙ্গাকে নিয়ে বহু জল্পনা রয়েছে। পুরাণে কথিত তিনি মহাদেবের জটাজালে আবদ্ধ ছিলেন। ভগীরথ তপস্যায় ব্রহ্মাকে সন্তুষ্ট করে তাঁকে মর্ত্যে আনয়নের অনুমতি পান। সগর রাজার ষাট হাজার সন্তানের ভস্মরাশি প্লাবিত করে তিনি তাঁদের মুক্ত করেন। তাই তিনি ভাগীরথী। জহ্নু মুনি গঙ্গার জলে তাঁর আশ্রম ও যজ্ঞের উপকরণসমূহ ভেসে যাওয়ার ফলে ক্রুদ্ধ হয়ে গঙ্গার সমস্ত জল পান করে ফেলেন। দেবতারা তপস্যা করে জহ্নু মুনিকে সন্তুষ্ট করলে তিনি কর্ণ দ্বারা গঙ্গাকে মুক্ত করেন। সেই থেকে গঙ্গা জহ্নু কন্যা জাহ্নবী নামে পরিচিতা। গঙ্গা স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল তিন পথেই প্রবাহিত বলে তিনি ত্রিপথগা। গঙ্গাকে বিষ্ণু তাঁর নখাগ্রে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন। পৃথিবী জলশূন্য হওয়ার উপক্রম হলে দেবতাদের অনুনয়ে গঙ্গাকে বিষ্ণু নখাগ্র থেকে নিষ্ক্রান্ত করে দেন। সেই থেকে গঙ্গার নাম হয় বিষ্ণুপদী। সঙ্গীত গঙ্গার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। রাগরাগিনীতে তিনি আপ্লুত হয়ে যান। তাই তিনি সুরধুনী।

মহাভারতের আদিপর্বে যে গঙ্গাকে আমরা দেখি তিনি এক স্বতন্ত্র প্রভায় উজ্জ্বল। বলা হয় যে অষ্টবসুরা যখন বশিষ্ঠ মুনির গাভী নন্দিনীকে অপহরণ করে তখন বশিষ্ঠ তাঁদের মর্ত্যে জন্মগ্রহণ করার অভিশাপ দেন। তারা ক্ষমা প্রার্থনা করলে বশিষ্ঠ তাদের বলেন পৃথিবীবাসের মেয়াদ তাদের দীর্ঘ হবে না। কিন্তু এই অন্যায়ের মূল হোতা প্রভাস। তার পৃথিবীবাস সুদীর্ঘ হবে। তারা কিভাবে পৃথিবীতে জন্ম নেবে তার জন্য সুরনদী গঙ্গার সাথে যেন পরামর্শ করে।

এইভাবে কুরুরাজ্যে এক অদ্ভুত ঘটনার সৃষ্টি হলো যার ফল সুদূরপ্রসারী। ঘটনাটিকে পুরাণ থেকে সরে এসে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এবার বিশ্লেষণ করা যাক। গঙ্গা পার্বত্য রমণী, স্বচ্ছন্দ বিহারিণী এবং আত্মাভিমান সম্পন্না। তাঁর প্রথম সাতটি পুত্র হয়তো ক্ষীণজীবি বা মৃত ছিল। তাই তিনি তাদের নদীতে ভাসিয়ে দেন। অষ্টম পুত্রটি ছিল সুস্থ। শান্তনু ভীত হয়ে পড়েছিলেন যে একেও হয়তো গঙ্গা নদীবক্ষে বিসর্জন দেবেন। তাই তিনি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে গঙ্গাকে বাধা দেন। গঙ্গা স্বাভিমানী। স্বামীকে শর্তের কথা মনে করিয়ে দিয়ে শিশুপুত্রকে নিয়ে চলে যান। পার্বত্য রমণীদের অভিমান বোধ অতিশয় তীব্র। এই ব্যাপারে তাঁরা কোনও আপোষ করেন না। গঙ্গাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না।

গঙ্গাকে এইভাবে কিন্তু বিশ্লেষণ করাই যায়। অতঃপর তিনি দায়িত্বশীল মাতার মতো পরশুরাম ও বশিষ্ঠের কাছে শস্ত্র ও শাস্ত্র শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। তাঁর নাম হয় দেবব্রত। ক্ষত্রিয় ও ঋষিশ্রেষ্ঠর শিক্ষায় তিনি দীপ্ত হয়ে ওঠেন। গঙ্গা দেবব্রত তারুণ্যে উপনীত হলে শান্তনুকে পুত্র সমর্পণ করেন। এই সেই পুত্র যাকে তিনি কুরুরাজ্যের যোগ্য উত্তরাধিকারী করে গড়ে তুলেছেন। দেবব্রত যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হলেন। মহাভারতের আখ্যানকে জটিলতর গর্ভে নিক্ষেপ করে গঙ্গা আবার ফিরে গেলেন। পরবর্তী ঘটনাবলী বিচিত্র এবং বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতে দীর্ণ।

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।