বিবিধ

হোসে রামিরেজ ব্যারেটো - ময়দানী সেই সবুজ তোতা



দেবাশিস সেনগুপ্ত


৬ মে, ২০১২, রবিবার। বুকের পাঁজর ভেঙ্গে দেওয়া দিনটার কথা আজ। এবং কি আশ্চর্য...আজও দিনটা চোখের একদম সামনে। আগের দিন সেই হাইভোল্টেজ ম্যাচ দেখেছি ইডেনে। ৫ মে ২০১২, শনিবার। পুনে বনাম কলকাতা। আইপিএলে। কৃত্রিম মায়া ছেড়ে ঐ একদিনই বোধহয় যথার্থ ক্রিকেট আবেগে জারিত হয়েছিল আইপিএল। সে অন্য গল্প।

যাক সে কথা। পরের দিনের গল্প-র "মুখবন্ধ" এবার শুরু। আজ আমার সীমিত ক্ষমতায় মনে পড়ছে কলকাতা ফুটবলে বিশ্বমানের একটাই দীর্ঘদিনের জাদুকর - বার বার স্বচক্ষে দেখা একটাই নাম। আর সেই নামটার বিদায় বেলা। সেদিন ছিল ফুটবলের প্রেক্ষিতে আমার "নিঃস্ব বাংলা"। রবিবার ৬ মে ২০১২ ভিজে চোখে আমিও যে মাঠে ছিলাম।

রবিবার ৬ মে, ২০১২। সকাল থেকেই দ্রিম দ্রিম বুকের মধ্যে। থেকে থেকেই মনের মধ্যে "অজানা কষ্ট, কি যাচ্ছেতাই।" পুনে এফ সি-র বিরুদ্ধে মোহনবাগানের হয়ে বিদায়ী ম্যাচ (আই লীগে) তার, বিকেল ৪টে থেকে যুবভারতীতে। "বুকের জ্বালা বুকে গোপন" করে মাঠে গেলাম। গোগ্রাসে গেলা ম্যাচটা ফ্রেম টু ফ্রেম মনে আছে আজ, দশ বছর পরেও। প্রায় ৬০,০০০ দর্শকের সামনে তিনি করেছিলেন প্রথম গোলটা দুরূহ কোণ থেকে "সার্জিকাল প্লেসিংয়ে", দ্বিতীয়টা ওডাফা-র, সম্ভবত তারই পাস থেকে। ২-০ জিতেছিল মোহনবাগান। ও হ্যাঁ, প্রতিপক্ষের গোলে ছিলেন তখন ভারতের এক নম্বর গোলকিপার সুব্রত পাল।

তার আগের ১১ বছর (১৯৯৯-২০০০ থেকে ২০০৩-২০০৪ আর ২০০৬-২০০৭ থেকে ২০১১-২০১২) চোখের মণির মত মোহনবাগানকে আগলে রাখা, তখনও আগ্রাসী ফর্মে থাকা এদেশের সেরা বিদেশী রিক্রুট সেই শেষবারের মত খেলছেন মোহনবাগানের হয়ে, ভাবাই যাচ্ছিলনা। ঈশ্বরের আবার অবসর হয় নাকি? এখনও আমার মত কত মোহনবাগানপ্রেমীর ঘরের আর হৃদয়ের দেওয়াল জুড়ে যে তার ছবি, তার কোন গুণতি হয়না।

আসল গল্প এবার শুরু। তার এই অপরিণত 'বিদায়'-এর নেপথ্যে ছিলেন তখনকার কর্তারা। কি লাভ হলো এতে ক্লাবের বা তাদের, আজ সবাই হাড়ে হাড়ে বোঝে! ২০০৪-এ অবশ্য ক্ষমতাসীন ছিল অন্য কর্তাদের দল। সোজা কথায়, সবুজ মেরুনের এই "শীত গ্রীষ্ম, বর্ষার ভরসা"-কে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন তখনকার কর্তারা। আমরা, অখুশী সমর্থকরা নিরুচ্চার কান্নাতে বুক-চোখ ভেজানো ছাড়া বিশেষ কিছু করতে পারিনি সেদিন। মুখ বুজে অন্যায়টা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। পরের দু'বছরে ২০০৫-এর কলকাতা লীগ ছাড়া কিছু জেতেনি মোহনবাগান।

চোখের জলে চিরদিনই অভিশাপ নামক একটা ইনগ্রেডিয়েন্ট জড়িয়ে থাকে যে!

১৭ জানুয়ারি ২০০০ মারগাওতে ডেম্পোর বিরুদ্ধে দশ নম্বর সবুজ-মেরুন জার্সি পরে ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার করেছিলেন তার প্রথম গোল। আর ধারাবাহিক সাফল্যের সেই ইতিহাস ৬ মে ২০১২ তারিখে থেমে গিয়েছিল পুণের সুব্রত পালকে টপকে, নিজের ২২৪ তম গোলে। তার ১২ বছর আগে দেশের "এক নম্বর টিমের" বিরুদ্ধে গোল করে ব্যারেটো তার আসার ঘোষণা করেছিলেন। আর দেশের "এক নম্বর গোলকিপারের" নাগাল এড়িয়ে অনবদ্য একটা গোল করে শেষ হয়েছিল মোহনবাগানে ব্যারেটোর রাজ্যপাট। মাঝে মোহনবাগানের নৌকায় চড়ে ৩৯৮টি ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি এবংআমার মত অনেকেরই বুকের বাঁদিকের স্থায়ী মঞ্চে প্রবেশ করেছিলেন অনায়াসেই।

ময়দানী সেই সবুজ তোতা, হোসে রামিরেজ ব্যারেটো (Jose Marcio Ramirez Barreto)-র খেলা আর তাকে বঞ্চনার গল্প অনেকটাই জায়গা জুড়ে আছে আমার বুকে আর মাথায়। সেটা আর একদিন। আজ শুধু ৬ মে, ২০১২-র গল্পটাই বললাম এখানে।

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।