গল্প ও অণুগল্প

আমার মা (পঞ্চম পর্ব) [ধারাবাহিক উপন্যাস]



অচিন্ত্য সাহা


।। ৫ ।।

তখন সন্ধ্যা সমাগত, পশ্চিম আকাশে সূর্যের বিভা ক্ষীণ হয়ে এসেছে, আমার ঘরের পিছনে নবদ্বীপ যাওয়ার সড়কপথ এবং ঐতিহ্যবাহী ছোটো রেললাইন। আর একটু পরেই ট্রেন আসবে। স্বরূপগঞ্জ থেকে যাত্রা শুরু করে কৃষ্ণনগর স্টেশন ছুঁয়ে দিগনগর হয়ে শান্তিপুরে শেষ হবে তার যাত্রাপথ। এই ট্রেনের গতি খুবই কম, যাত্রী সাধারণ চলন্ত ট্রেনে স্বচ্ছন্দে ওঠানামা করতে পারেন। একটা ছোটো খেলনা গাড়ির মতো দেখতে ট্রেনটা, আমার বেশ লাগে। ওর আসার সময় হলে আমি জানালা দিয়ে ওকে দেখতে থাকি। দেখতে দেখতে আমাদের মধ্যে এক আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। দিনের মধ্যে চারবার আসা-যাওয়া করে। তার মধ্যে আমি ওকে সকালে আর সন্ধ্যায় দেখতে পাই। কেবলমাত্র ছুটির দিনগুলোতে ওকে চারবারই দেখি। কোনো কোনো দিন হয়ে ওঠে না, কেননা যেদিন আমার বন্ধু দ্বিচক্রযানটিকে সঙ্গী করে বেরিয়ে পড়ি। সকালে একটা ব্যাচ পড়িয়ে এক বোতল জল, কিছু শুকনো খাবার, গামছা, ছাতা সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। সারাদিন নদীয়া জেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে সন্ধ্যার কিছু আগেই বাড়ি ফিরে আসি। গ্রাম-গঞ্জের মানুষের মধ্যে গিয়ে ওদের সাথে কথা বলে ওদের অভাব অভিযোগের নানা কথা শুনি। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি - যদি কোনোদিন মানুষের মতো মানুষ হতে পারি সেদিন ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবো। এক একদিন ওদের দুঃখ যন্ত্রণার কথা মনের মধ্যে এতটাই প্রভাব বিস্তার করতো যে, রাতে ঘুমোতে পারতাম না। আমার বাবার মুখটা ভেসে উঠতো। তিনি কখনো তাঁর অভাব বা অর্থকষ্ট নিয়ে উদ্বিগ্ন হতেন না, কিন্তু তাঁর মুখ দেখলে বোঝা যেত ভেতরে ভেতরে তিনি যথেষ্ট কষ্ট পাচ্ছেন। বিশেষ করে দিদিকে নিয়ে তাঁর উদ্বিগ্নতা ছিলো চোখে পড়ার মতো। দিদির বয়স বাড়ছে, বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে তার শারীরিক গঠন এমন বেড়ে উঠছে যে গ্রামের মানুষ মাঝে মাঝেই তার বিয়ের প্রসঙ্গে কথা বলছেন। আঠারো পূর্ণ হবার আগেই বেশ কয়েকটি জায়গা থেকে তার বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করে। এমনিতেই পাঁচ সাতটা গ্রামের মধ্যে বাবার বেশ সুখ্যাতি আছে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে বাবা স্থির করেন গ্রামে থাকলে তিনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন না। তাই একদিন দিদিকে নিয়ে শহরে দাদার বাড়িতে রেখে যান। তখন দাদার আর্থিক সমস্যা ছিলো না, বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে চলে যেত।

গ্রাম ঘুরে ঘুরে মানুষের নানান সমস্যার কথা শুনি আর সমাজের জীর্ণ দশার ছবিটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমার কাছে। একটু একটু করে মনে দানা বাঁধে অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র। তখনও চিন্তার গভীরতা অতটা না এলেও এর জন্য যারা দায়ী তাদের চিনতে অসুবিধে হয় না। একবার দুর্গাপুজোর সময় ইচ্ছে হলো মথুরাপুর গ্রামে যাবো। শুনেছি ওখানে বেশির ভাগ মুসলিমদের বাস, কিন্তু ঈদ বা শারদোৎসব ওরা একসাথে মিলেমিশে উদ্‌যাপন করে। অষ্টমীর দিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। মথুরাপুরে যেতে হলে দৈয়ের বাজার থেকে ডানদিকের রাস্তা ধরে ভগবানপুর হয়ে মাধবপুরের উপর দিয়ে যেতে হয়। ওখানে এককালে বক্সীবাবুদের জমিদারি ছিলো। আজ তাঁরা নেই বটে কিন্তু তাঁদের ভিটে বাড়িটা অযত্নে অবহেলায় জীর্ণ হয়ে আছে। মাধবপুর থেকে আমার এক বন্ধু আসতো। ওর কাছে বিস্তারিতভাবে সব জেনে নিলাম, ওকে আমার সাথে থাকার প্রস্তাবও দিলাম। ও বেশ এককথায় রাজি হয়ে গেল। মাধবপুর পৌঁছে ডানদিকের রাস্তা ধরে এগোতে এগোতে কিছুটা গিয়ে দেখলাম একটা ছোটো নদী। নদীর নাম কলিঙ্গ, পরে জানলাম ওখানে একই নামে একটি গ্রামও আছে। একসময় এই নদীপথ নীলকর সাহেবরা ব্যবহার করতেন। আসান নগর, ভীমপুর অঞ্চলে এখনো সেই নীলকর সাহেবদের ভাঙ্গা কুঠি এবং নীল জ্বাল দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত বড়ো বড়ো কড়াইয়ের ভগ্নাবশেষ পড়ে আছে। কলিঙ্গ নদী আজ মৃতপ্রায়। ছেঁড়া কাপড়ের মতো টুকরো টুকরো হয়ে মথুরাপুর, পোড়াগাছা, ভাতজাংলা, আসাননগরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে। এখন নদীর বুকে কোখাও কোখাও গড়ে উঠেছে ইটভাটা, শস্যক্ষেত এবং গোচারণভূমি।

রাস্তার দু'পাশে খড় ও মাটি দিয়ে তৈরী বাড়ি, কোনো কোনোটাতে টালি, করোগেট টিন বা অ্যাসবেসটস দিয়ে চালাঘরের ছাউনি দেওয়া। বেশ লাগছিল, কারো কারো বাড়িতে গরু ছাগল, কারো কারো বাড়িতে হাঁস-মুরগী পালনের রেওয়াজ আছে। গ্রামের মানুষ অধিকাংশই কৃষিজীবী। কেউ কেউ নিজের জমি চাষ করেন, কেউ আবার অন্যের জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করেন, কেউ কেউ আছেন ভাগচাষী, আবার অনেকে আছেন যাঁরা অপরের জমিতে ক্ষেতমজুরের কাজ করেন। গ্রামের কোনো বাড়িতে প্রাচীর দেওয়া দেখা গেল না, এমনকি বেড়া দিয়েও বাড়িগুলোকে একটা থেকে অপরটাকে আলাদা করা নেই। প্রত্যেকে প্রত্যেকের বাড়ির ওপর দিয়ে যাতায়াত করেন। আমাদের গ্রামের সঙ্গে এই গ্রামের এটাই পার্থক্য লক্ষ্য করা গেল। আমার বন্ধু আরশাদ বললো- এখানে এটাই স্বাভাবিক রীতি, কারও সাথে কারোরই কোনো বিবাদ নেই। হিন্দু মুসলিম একসাথে মিলেমিশে খাকেন। বিপদে আপদে সবার পাশে সবাই ছুটে আসেন। মাঝখানে কলিঙ্গ একটা বিভাজন রেখা টেনে দিয়েছে। নাহলে...

আমরা কলিঙ্গ পার হলাম। নদীর উপর বাঁশের বাঁখারি পরপর সাজিয়ে অস্থায়ী সাঁকো নির্মাণ করা হয়েছে। সাঁকো নির্মাতা নদীর পারে একটা বাঁশের মাচা তৈরি করে বসে আছেন। তিনি পারানির কড়ি সংগ্রহ করেন। আমরা তাঁকে ঘাট পার হওয়ার জন্য টাকা দিলাম। এখন অক্টোবর মাস, এই সময় নদীতে কিছুটা হলেও জল থাকে। কিছুদিন আগেই বর্ষা শেষ হয়েছে তাই জলের দেখা পাওয়া গেছে। নাহলে সারাবছর কলিঙ্গ শুকনো থাকে। তখন নদীর মাঝ বরাবর হেঁটে পার হওয়া যায়। নদীর বুকের ওপর চাষিরা জমি বানিয়ে চাষ করেন, তখনও পারানির কড়ি দিতে হয়। এটাই ওর সারাবছরের উপার্জন। ওর কাছ থেকে ওর সংসারের হাল হকিকত জানা গেল। মাত্র তিন বছর বয়সে ওর বাবার মৃত্যু হয়। মা অনেক কষ্ট করে ওকে বড়ো করে তুলেছেন, কিন্তু আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় পড়াশোনা বেশিদূর হয়নি, চার ক্লাস পাস করে প্রথমে মাঠের কাজ করতো তারপর পঞ্চায়েতের কোনো এক মেম্বার ওকে ঘাটের কাজে লাগিয়ে দেন। তাঁর মৃত্যুর পর ঘাটের মালিকানা ওর হাতে চলে আসে, ওর নাম অনন্ত। তখন নদীর ভরা যৌবন, প্রচুর জল। নদীতে খেয়া পারাপার করতো। এদিকে লোকের আনাগোনা একটু কম। ভবুও সারাদিনের সংগৃহীত অর্থে ওদের দুজনের খাওয়া পরা ঠিক ঠিক ভাবেই সম্পন্ন হতো। তারপর বিবাহ, পরপর তিনটি সন্তানের আগমন এবং মায়ের অসুস্থতা ওকে একেবারে নাজেহাল করে দেয়। তবুও সবকিছু আগের মতোই চলছিল, এর মাঝে শুরু হলো এক নতুন সমস্যা কলিঙ্গের ওপর ব্রিজ নির্মিত হবে। কপালে পড়লো চিন্তার ভাঁজ এবার সংসার চলবে কীভাবে, নদীর উপর ব্রিজ নির্মিত হলে ওর রোজগার কমে যাবে, ছেলেমেয়েদের মুখে কীভাবে অল্প তুলে দেবে, ওদের পড়াশোনার খরচ জুটবে কোথা থেকে, পুজোর সময় নতুন পোশাক কিনবে কী করে? এমনই নানা প্রশ্ন ওর মস্তিষ্ককে অকেজো করে দিচ্ছিল। তখন গ্রামের প্রধান প্রধান ব্যক্তির নিকট ওর সমস্যার কথা তুলে ধরে। তাঁদের করুণায় ওর স্ত্রী একটা স্কুলে জল দেওয়া, স্কুল পরিষ্কার করা এবং দিদিমণি মাস্টারমশাইদের পরিষেবা দেওয়ার কাজ পায়। পারিশ্রমিক সামান্য হলেও ওর স্ত্রীর সেবা ও স্বভাবের জন্য খুশি হয়ে মাস্টারমশাই দিদিমণিরা মাঝে মাঝেই অতিরিক্ত পারিতোষিক দিতেন। ফলে অনন্ত মাঝির সাংসারিক অবস্থা তেমন খারাপ হতে পারেনি। মোটামুটি চলে যায়, ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে, ওরা বড়ো হলে অনন্ত মাঝির অভাব অনেকটাই ঘুচে যাবে। অনন্ত আশা করে একদিন ওদের দুঃখ ঘুচবে, সুদিন আসবে। ওর সাথে কথা বলে বেশ ভালো লাগছিলো এত সহজ সরল স্বাভাবিকভাবে কথা বলছিল যে, উঠতে মন চাইছিল না। কিন্তু আরশাদ জানালো এখনো অনেকটা পথ যেতে হবে, আবার ফিরে আসতে হবে। ওর সমস্যা হবে না, সমস্যা হবে আমার। ঠিক কথাই বলেছে, আমাকে ফিরতে হবে। আমরা এগিয়ে চললাম, খানিকটা গিয়ে দেখলাম একটা বাঁশবন। রাস্তার দুপাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে, এখানে সূর্যের আলো ততটা স্পষ্ট নয়, আবছা আলোয় মোড়া রাস্তা। বাঁশ বনের ভেতরে বাতাস বইছে তার কটকট শব্দ শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দুই একটা ছোটো ছোটো ডোবা দেখা যাচ্ছে, তাতে সামান্য জল আছে। আরশাদ জানালো বাঁশের জন্য প্রচুর জল লাগে। মাঝে মাঝে পাম্প চালিয়ে ডোবাগুলিতে জল দেওয়া হয়। ভাতে উন্নত জাতের বাঁশ হয়, এগুলো একসময় নদীপথে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হতো এখন ট্রাক ভর্তি করে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। বাঁশ বিক্রি করে বছরে কয়েক হাজার টাকা রোজগার হয়। বাঁশবন একসময় বক্সী বাবুদের ছিলো, ওরা কলকাতায় চলে যাবার পর এখানকার মাতব্বর গোছের কিছু মানুষ এটার দখল নেয়। তারাই বর্তমান মালিক। পরে সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে বক্সী বাবুরা এটার অধিকার ছেড়ে দেন। কেননা সুদূর কলকাতা থেকে এই গণ্ডগ্রামে এসে এর দেখাশোনা করা সম্ভব নয়। আরশাদের কথা শুনতে শুনতে মনে পড়ে গেল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের "কালিন্দী" উপন্যাসের কথা। গ্রামের জমিদারি প্রখা কীভাবে আধুনিক প্রযুক্তির কাছে পরাজয় স্বীকার করে নতুন ব্যবস্থাকে নতমস্তকে মেনে নিতে হয়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ "কালিন্দী"। এখানে অবশ্য ব্যাপারটা সম্পূর্ণ বিপরীত - গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যাবার পর গ্রামের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে শহরের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া এবং নিজের জন্মভিটেকে মন থেকে মুছে ফেলার প্রচেষ্টা-বক্সী বাবুদের কার্যকলাপে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমার মনের ভেতরটা কেমন একটা ব্যথায় চিনচিন করে ওঠে। আমিও হয়তো বক্সী বাবুদের একজন প্রতিনিধি। আমাদের বাড়ির পিছনে ছিলো এমনই একটা বাঁশ বাগান, সেখান থেকে শুকনো কঞ্চি কেটে আমরা সেটাকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতাম। কখনো কখনো নুইয়ে পড়া বাঁশের ডগাটা কেটে বাবা সেটাকে বেড়া দেওয়ার কাজে লাগাতেন। আরশাদকে বিষয়টা জানাতেই ও বললো-হ্যা, এটা এখানকার মানুষেও করে থাকেন। দুজনের গ্রামজীবনের কথোপকথনের মাঝে মথুরাপুর গ্রাম থেকে আগত এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হলো। ব্যক্তিটি যে আরশাদের পূর্ব পরিচিত তা ওদের কথাবার্তা থেকে জানা গেল। ভদ্রলোক যাচ্ছেন তাঁর মেয়ের বাড়ি বাঙ্গালঝিতে, ওখানেই তাঁর ছোটো মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। পুজো উপলক্ষে মেয়ে জামাইকে আনতে যাচ্ছেন। কথাবার্তায় বুঝলাম লোকটা মুসলিম সম্প্রদায়ের। মনে সামান্য একটু হলেও প্রশ্ন উকি দিল। শুনেছি বাংলাদেশের অনেক গ্রাম আছে যে সমস্ত জায়গায় হিন্দু মুসলিম সম্মিলিত ভাবে পুজো করেন। এই ব্যাপারটা স্বচক্ষে দেখার জন্যেই এই গ্রামে আসা। আমি জিজ্ঞেস করলাম -

- পুজোর সময় মেয়ে জামাই আসবে কেন? আপনারা তো হিন্দু নন।

তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে বললেন - বাবাজী, কথাটা আমাকে বলেছ ঠিক আছে, কিন্তু মনের ভুলেও গ্রামে গিয়ে একথা বোলো না। একথা শুনলে তোমাকে কেউ আস্ত রাখবে না। আমরা এখানে ধর্মীয় ভেদাভেদ মানি না। ঈদ, রোজা, পূজা উৎসব একসাথে উদযাপন করি। এর মাঝেই আছে আমাদের আনন্দ। কারও বিপদ আপদে সবাই একসাথে ঝাপিয়ে পড়ি। কেউ মারা গেলে পুরো গ্রাম শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ি। আমরা জাতধর্ম মানি না।

কথাগুলো শুনে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত শিউরে উঠলো। সত্যি এমনও গ্রাম আছে! চারিদিকে যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামার শিকার হয়ে মানুষ মানুষকে সন্দেহের চোখে দেখছে, একে অপরকে হত্যা করার জন্য অস্ত্রে শান দিচ্ছে, পরস্পর ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছে, পাশবিকতা, নির্মমতা, নিষ্ঠুরতার জঘন্য খেলায় মেতে উঠছে তখন নদিয়া জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটা অনন্য নিদর্শন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে শুনে মনটা গর্বিত হয়ে উঠলো। আমি তো এটাই চাই, আমার বাবার কাছ থেকে এই শিক্ষা পাওয়া। তিনি আজ এই ছবিটা দেখতে পেলে ভীষণ খুশি হতেন। আমার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল, ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম -

আচ্ছা কাকু আপনাদের মনে এই ধারণা কীভাবে সৃষ্টি হলো? যেখানে সমগ্র পৃথিবী নিজের নিজের ধর্ম নিয়ে মারামারি কাটাকাটি করে, পরধর্মের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করছে এবং "স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পরধর্ম ভয়াবহ" - বলে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে এক ভয়ানক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে সেখানে আপনারা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করছেন, এর রহস্য কী?

- বাবাজী সে এক ইতিহাস বটে। অনেক বড়ো কাহিনি, তুমি যদি সত্যি শুনতে চাও তবে আমাদের গ্রামে থাকতে হবে। এইভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সবকিছু বলা সম্ভব নয়। তা তুমি কোথেকে আসছ, এখানে কারও বাড়ি যাবে, নিশ্চয় দুই একদিন থাকবে? আমি আজই ফিরে আসবো তখন নাহয় বাকি কথা বলা যাবে। এখন তাহলে চলি কেমন? আমার আবার দেরি হয়ে যাবে, ফিরতে হবে তো?

- ঠিক আছে কাকু আপনি আসুন। আমি আজ বিকেলেই চলে যাবো। পরে আবার আসবো কোনো একদিন, তখন নাহয়...

উনি চলে গেলেন, আমি অবাক হয়ে ওঁর যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে আছি। আরশাদ বললো-চল। এভাবে দাঁড়িয়ে পড়লে হবে? তোকেও ফিরতে হবে আমাকেও।

আমি আর কথা না বাড়িয়ে ওকে অনুসরণ করতে লাগলাম। অনেকক্ষণ চুপচাপ। আমি প্রাণভরে উপভোগ করছি মথুরাপুর গ্রামের ছবির মতো সাজানো দৃশ্যাবলী। মাঝে মাঝেই মনটা উদাসী হয়ে উঠছে, আরশাদ আমার তদগত বিহ্বল ভাব লক্ষ্য করছে। ও জানে ওর বন্ধু জয় একটু ভিন্ন প্রকৃতির, একটু ভাবুক মল, একটু চিন্তাশীল বিচক্ষণ মনের অধিকারী। তাই সেও তার বন্ধু জয়কে চুপচাপ দেখে নিজেও কোনো কথা বলছে না, পাছে বন্ধুর চিন্তার ব্যাঘাত ঘটে।

আরও মিনিট পাঁচেক হাঁটার পরে আমরা গ্রামে পৌঁছালাম। সাধারণ আর পাঁচটা গ্রামের মতোই, বিশেষত্ব কিছু নেই। একটা বারোয়ারী মন্দির, তার পাশে একটা পুরনো বটগাছ, তা থেকে ঝুরি নেমে এসেছে, বারোয়ারির সামনে একটা বেশ বড়ো মাঠ। এখানে বর্ষাকাল বাদ দিয়ে সারাবছরই নদীর জলের ওপর নির্ভর করে বাঁচতে হয়। বারোয়ারির সামনের মাঠের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে আছে একটা বেলগাছ। খুব বেশি বড়ো না হলেও গাছটির আকার আকৃতি দেখলে চমকে যেতে হয়। ওর গোড়ায় একখণ্ড পাখরে তেল সিঁদুর লাগিয়ে কারা যেন রেখে গেছে। দু-একটি ফুল ছড়ানো দেখা গেল। কখাটার সত্যতা এখানেই যে, মানুষ যুক্তির অবতারণা না করে অনায়াসেই সবকিছু মেনে নেয়।

(ক্রমশ)