গ্রামের সুভাষিত নাম কৃষ্ণপুর। সবাই বলে কেষ্টপুর। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মাথাভাঙা নদী। এই নদীতে এক দূরন্ত শৈশব কাটে আহাদ আলির। নদীর দু'ধারে কাশবন, বাঁশঝাড়। গাছের ডালে ডালে পাখি গান করে। মাথার 'পর ঝাঁকে ঝাঁকে পায়রা উড়ে যায় - কী যে সুন্দর লাগে!আহাদ আলির মন আটকে যায় রঙ-বেরঙের পায়রার ঝাঁকে। আহাদ আলির প্রিয় মানুষ বঙ্গবন্ধু। সে শুনেছে বঙ্গবন্ধুর অনেক প্রিয় ছিল এই পায়রা। বঙ্গবন্ধু পায়রা পুষতেন। তার ইচ্ছে সেও পায়রা পুষবে। মায়ের কাছে বলে, মা... আমি পায়রা কিনবো, টাকা দাও। ছোটচাচা শের আলি মোল্লাকে বলে, চাচা... আমাকে পায়রার ঘর বানিয়ে দাও। যেই কথা সেই কাজ - চাচা দোকান থেকে একটা পরিত্যক্ত কার্টুন কিনে আনলেন। বাড়ির বাঁশ-কাঠ দিয়ে খুব যত্ন করে বানিয়ে দিলেন চার খোপের একটা পায়রা-ঘর।আটচালা খেড়ো ঘরের কোল-ঘেঁষে পায়রার ঘরটা বাঁশের মাচায় বসানো হল।
কৃষ্ণপুর থেকে আট কিলোমিটার দূরে হাজরাহাটি গ্রাম। ওই গ্রামে আহাদের মামাবাড়ি। মামাবাড়ির পাশে এক ভদ্রলোকের অনেক পায়রা। শোনা গেল, তিনি পায়রা বিক্রি করেন - জোড়া পাঁচ টাকা। একদিন সকালে আহাদ আলি সেই পায়রাওয়ালার বাড়ি হাজির। ঘরের চালে অনেক পায়রা। বক-বকুম, বক-বকুম করে ডাকছে, চাল থেকে উড়ে গাছের ডালে বসছে।একটু পরে পাখা মেলে উড়ে যাচ্ছে শূণ্যে - কী দারুণ। আহাদের চোখে-মুখে আনন্দের আভা।সে ধীরপদে এগিয়ে গেল পায়রাওয়ালার কাছে। পকেট থেকে মায়ের দেওয়া পাঁচ টাকা বের করে বললো, আমি একজোড়া পায়রা কিনবো।
ভদ্রলোক দুটি হাত মেলে ধরলেন আর মুখে কী যেন বললেন। অমনি পায়রার ঝাঁক ছুটে এল। তার হাতে-ঘাড়ে-মাথায় বসলো। কী দারুণ শিকারী, কী দারুণ ভক্ত! আহাদ আলি মনে মনে বললো, আমিও এভাবে পায়রাগুলোকে ভক্ত বানাবো। একরাশ মুগ্ধতা আর পায়রাজোড়া নিয়ে দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরে আহাদ।
পায়রা পোষার শখ পূরণ হতে চলেছে তার।বাড়িতে এনে পায়রা দুটোর পাখা সুতো দিয়ে বেঁধে রাখলো। সপ্তাহখানেক পরে সুতো খুলে দিল। ওরা খোপওয়ালা ঘরের চারপাশে উড়ে উড়ে বসছে। বক-বকুম রবে মুখর করে তুলছে বাড়ি। আহাদের চোখে-মুখে যুগপৎ আনন্দ আর শঙ্কা। শঙ্কা এই জন্য যে, কখনও যদি উড়ে যায়! আহাদের ভয় সত্যি হলো, পায়রা উড়াল দিল; মূহুর্তে চলে গেল চোখের আড়ালে।
আহাদ ভাবলো, ফিরে আসবে। সে বাড়ি-মাঠ-নদীতট ঘুরে আসে, কোথাও পায়রার দেখা মেলে না - ফিরেও আসে না।
আহাদের চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জল। খাওয়া-দাওয়া ভুলে ঘরের এককোনায় বসে আছে সে। মা বললেন, যে বাড়ি থেকে এনেছিলি, সেই বাড়ি যা। সেখানে যেতে পারে? আট কিলোমিটার দূরের পথ। এতপথ কীভাবে যাবে, আহাদের বিশ্বাস হতে চায় না; মা বললেন, তুই যা, দেখবি ওখানেই আছে। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে দুলতে আহাদ অবশেষে পৌঁছলো হাজরাহাটি গ্রামের সেই বাড়ি। হ্যাঁ, মায়ের কথাই সত্যি - পায়রা হাজির ওদের পূর্বের প্রভুর বাড়ি। সম্পর্ক মিলিয়ে দেখতে গেলে ভদ্রলোক আহাদের মামা। মামা বললেন, ভাগ্নে সাত দিন না, পনেরো বিশ দিন পাখা বেঁধে রাখবা।
এবার পায়রা পোষ মেনে গেল, উড়ে দূরে যায়, আবার ফিরে আসে। আহাদের মনে ভয় কেটে গেল। পায়রাগুলো খুব প্রিয় আহাদের। সে যত্ন করে, ওদের সাথে বলে - বক-বকুম-কুম। মাস দুই পরে ওরা বাসা বানাতে শুরু করলো, ডিম পাড়লো। কালে কালে বাচ্চাও হলো। মাঠ থেকে সর্ষে-দানা এনে মা-পায়রা বাচ্চাকে খাওয়ায়। এইসব দেখতে বড্ড ভালো লাগে। আহাদের জীবনে এমন আনন্দ আগে আসেনি। দিন যায়, মাস যায় - এখন অনেক পায়রা আহাদের। ও ডাকলে পায়রাগুলো আসে ওর কাছে, হাতের তালু মেলে ধরলে বসে তালুতে - আহাদের আনন্দ আর ধরে না।
গ্রামের মাঠ ক্ষেত-খন্দে ভরা। পায়রা ঝাঁক ধরে যায়, পেট ভরে খেয়ে ফিরে আসে। বাড়িতে তেমন একটা খাদ্য-খাবার দিতে হয় না। বন্ধুদের কারো কারো শখ জাগে, তারাও আহাদের মতো পায়রা পুষবে। পাশের গ্রাম থেকে কেউ কেউ পায়রা কিনতে আসে। আহাদের একটা মায়া জন্মে গেছে পায়রাগুলোর প্রতি। সে একজোড়া ধরে, হাতের মুঠোয় নিয়ে ভাবে নাহ্! এ জোড়া তো দারুণ সুন্দর, এদের বেচবো না। ওদের ছেড়ে আরেক জোড়া ধরে। হাতের পাঁচ আঙুলের স্পর্শ করে, বৃত্তাকার মায়াবী চোখের দিকে তাকায়; বলে নাহ্! থাক পায়রা বেচবো না। আহাদ পায়রার লোমশ ডানা ছুঁয়ে বলে, নাহ্, তোদের আমি ভালোবাসি। তোদের জন্য আমার খুব মায়া। সত্যি পায়রাগুলোকে সে খুব ভালোবাসে।ভালোবাসলে সুন্দর সুন্দর কথা মনে আসে। পড়ার টেবিলে বসে সে পায়রাগুলোর উদ্দেশ্যে প্রেমপত্র লেখে:
প্রিয় পায়রাগুলো, তোমরা ভালো থেকো
সারাদিন আমার বাড়ি মুখর করে রেখো
যেখানেই যাও তোমাদের ঠিকানায় ফিরো
আমার প্রিয় পায়রাগুলো ভালো থেকো।"
মানুষের জীবনে প্রেম আসে। আহাদের জীবনে প্রথম প্রেম এসেছিল পায়রা-প্রেম। আহাদ মাঝেমধ্যে পায়রাগুলো নিয়ে ছড়া লিখতো, কবিতা লিখতো। নিজের ছড়া নিজে পড়েই মুগ্ধ হতো; মনে মনে বলতো, "আমি তো বেশ ছড়া লিখতে পারি। আমি শহরে যাব, পত্রিকায় ছড়া লিখবো।"
এসএসসি পাশ করে সত্যি সে একদিন চলে এলো শহরে। বাড়িতে ছোট ভাই আর মা পায়রাগুলো দেখভাল করে। মাসে এক-দুবার সে গ্রামে যায়।vপায়রাগুলো করুণ চোখে তার দিকে চায়। পায়রাগুলো রেখে তার মন চায় না শহরে আসতে। তবু্ও সে ফিরে আসে ইট-কাঠের শহরে। পায়রাগুলোর কথা মনে হলে সে ছড়া লেখে, কবিতা লেখে। পত্রিকা অফিসের লোকজনের কাছে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সে বিরহের কবিতা লেখে:
পায়রাগুলো নেই ধারে-কাছে
মনটা পড়ে আছে তাদের মাঝে।
কাল বাদে পরশু বাড়ি যাবো
আমি তাদের সাথে দিন কাটাবো।"
পরের দিন আহাদের কলেজ ছুটি। আহাদ শহরের দোকান থেকে রঙ কেনে - লাল-নীল-সবুজ রঙ। ভালোবেসে এক একটা পায়রার শরীরে সে একেক রকম রঙ মাখাবে - কত্ত সুন্দর লাগবে পায়রাগুলো।
বাড়ির সীমানায় এসে সে মাঠের দিকে তাকায়, আকাশের দিকে তাকায় - মনে ভাবে তার পায়রাগুলোর দেখা মিলবে। আহাদ গ্রামের বাড়িতে গেলে তার কথার আওয়াজে পেয়েই পায়রাগুলো ঝুপঝাপ মাটিতে নেমে আসতো, বক-বকুম-কুম শব্দে স্বাগত জানাতো। আজ কোন সাড়াশব্দ নেই। পায়রাগুলোর কোনো সর্বনাশ হলো কি? মায়ের বিষন্ন মুখ দেখে সে চিন্তিত হয়ে পড়ে। আহাদ মাকে বলে, কী হয়েছে মা, পায়রাগুলো কই?
মায়ের চোখে জল। মা বাকরুদ্ধ।
পরের দিন পত্রিকায় সংবাদ শিরোনাম হলো: 'ফসলে বিষ: শতাধিক পায়রার জীবননাশ।'
আহাদ আলি শোকে পাথর হয়ে যায়। অনেকদিন সে শহরেই থাকে। বক-বকুম শব্দ শুনলে সে আনমনা হয়ে ওঠে। আকাশে পতপত করে পায়রা উড়তে দেখে সে বিরহের কবিতা লেখে। মনে মনে ভাবে সেই পায়রাগুলো ছিল তার নন্দিত ভালোবাসা। এই ভালোবাসাই তাকে টেনে এনেছে লেখালেখির জগতে। আজ সে কবি। এই নন্দিত ভালোবাসাই তাকে কবি করে তুলেছে।
চিত্রঃ লেখায় ব্যবহৃত ছবিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) ব্যবহার করে কাল্পনিকভাবে তৈরি।