প্রবন্ধ

কবির মানসীঃ জীবনে ও সৃজনে (চতুর্থ ও শেষ পর্ব)



অমিতাভ বিশ্বাস



শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জনৈক ছাত্রী।

'মানসী'র ছায়াময়-মায়াময় রূপ বিদূরিত করার চেষ্টা করেছেন কবি এই গানে "তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা/ মম শূন্যগগন-বিহারী।/ আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা/ তুমি আমারি, তুমি আমারি,/ মম অসীম গগন বিহারী। মম হৃদয় রক্তরাগে তব চরণ দিয়েছি রাঙিয়া,/ অয়ি সন্ধ্যা স্বপন বিহারী।/ তব অধর এঁকেছি সুধা বিষে মিশে মম সুখ-মুখ ভাঙিয়া/ তুমি আমারি, তুমি আমারি,/ মম বিজন জীবন বিহারী/ মম মোহের স্বপন-অঞ্জন তব নয়নে দিয়েছি পরায়ে,/ অয়ি মুগ্ধ নয়ন বিহারী/ মম সংগীত তব অঙ্গে অঙ্গে দিয়েছি জড়ায়ে-জড়ায়ে/ তুমি আমারি, তুমি আমারি,/ মম জীবন মরণ বিহারী।"

রবীন্দ্রনাথের প্রেম ভাবনায় প্রেমিককে 'সাধক' এবং 'পাগল'-এর সাথে তুলনা করা হয়েছে। "কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো/ সাধক ওগো, প্রেমিক ওগো,/ পাগল ওগো ধরায় আসো।" প্রেম-পূজা ও জীবনদেবতা একাকার একটি গানে। "নিভৃত প্রাণের দেবতা যেখানে জাগেন একা,/ ভক্ত যেথায় খোলো দ্বার আজলব তাঁর দেখা/ সারাদিন শুধু বাহিরে ঘুরে ঘুরে কারে চাহিরে,/ সন্ধ্যাবেলার আরতি হয়নি আমার শেখা।/ তব জীবনের আলোতে জীবন প্রদীপ জ্বালি/ হে পূজারী, আজ নিভৃতে সাজাব আমার থালি।/ যেখা নিখিলের সাধনা পূজালোক করে রচনা/ সেথায় আমিও ধরিব একটি জ্যোতির রেখা।"

রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানসী সম্পর্কে জানিয়েছেন তাঁর গানে তুমি 'সুদূর নীহারিকা নও'। তুমি শুধু পটে লিখা কেবল 'ছবি নও'। 'নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই - আজি তাই/ শ্যামলে শ্যামল তুমি, নীলিমায় নীল।/ আমার নিখিল তোমাতে পেয়েছে তার অন্তরের মিল।/ নাহি জানি, কেহ নাহি জানে/ তবসুর বাজে মোর গানে,/ কবির অন্তরে তুমি কবি - /নও ছবি, নও ছবি নও শুধু ছবি।” স্ত্রী মৃণীলিনী দেবীর সঙ্গে মাত্র ২০ বছরের দাম্পত্যজীবন কাটিয়েছেন কবি রবীন্দ্রনাথ, তাঁর কথা মনে করে তিনি লিখেছেন ১. 'যেদিন সকল মুকুল গেল ঝ'রে/ আমায় ডাকলে কেন এমন করে।/ যেতে হবে যে পথ বেয়ে শুকনো পাতা আছে ছেয়ে,/ হাতে আমার শূন্য ডালা কী ফুল দিয়ে দেব ভ'রে।..." ২. "এ পারে মুখর হল কেকা ওই, ও পারে নীরব কেন কুহু হায়। এ কহে, আর একটি কেকা কই, শুভ যোগে কবে হল দুহু হায়।..." ৩. "ওই মালতীলতা দোলে পিয়াল তরুর কোলে পূব-হাওয়াতে।/ মোর হৃদয়ে লাগে দোলা, কিরি আপনবোলা/ মোর ভাবনা কোথায় হারা মেঘের মতন যায় চলে।/ জানি নে কোথা জাগো ওগো বন্ধু পরবাসী -/ কোন নিভৃত বাতায়নে।..." ৪. "ভরা নদী ছায়ার তলে ছুটে চলে/ খোঁজে কাকে, পিছু ডাকে।" ৫. "ছায়া ঘনাইছে বনে বনে, গগনে গগনে ডাক দেয়া।/ কবে নবঘন বরিষণে গোপনে গোপনে এলি কেয়া।/ পুরবে নীরব ইশারাতে একদা নিদ্রাহীন রাতে/ হাওয়াতে কী পথে দিলি ঘেয়া/... বুঝি এলি যার অভিসারে মনে মনে দেখা হল তাঁর, আড়ালে আড়ালে দেয়া-নেয়া।” ৬. "আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে তারি ছায়া পড়েছে শ্রাবণ গগন তলে। / সে দিন যে রাগিনী গেছে থেমে অতল বিরহে নেমে/... নিবিড় সুখে মধুর দুখে জড়িত ছিল সেই দিন/ দুই তারে জীবনের বাঁধা ছিল বীণ/ তার ছিঁড়ে গেছে কবে একদিন কোন হাহারবে,/ সুর হারায়ে গেল পলে পলে।" ৭. "আমার দিন ফুরাল ব্যাকুল বাদল সাঁঝে/ গহন মেঘের নিবিড় ধারার মাঝে।/ বনের ছায়ায় জল-ছল ছল সুরে/ হৃদয় আমার কানায় কানায় পুরে।.../ কোন্ দূরের মানুষ যেন এল আজ কাছে,/ তিমির-আড়ালে নীরবে দাঁড়ায়ে আছে।/ বুকে দোলে তার বিরহ ব্যথার মালা/ গোপন মিলন অমৃতগন্ধ ঢালা।/ মনে হয় তার চরণের ধ্বনি জানি/ হারমানি তার অজানা জনের সাজে।"

কবি দুঃখের আগুনে নিজেকে পোড়াতে চেয়েছেন চেয়েছেন কি! সাধ করে কেউ কি পুড়তে চায়? আসলে প্রিয়জনের মৃত্যু এসে বারবার নাড়া দিয়েছে কবিকে। ফালা-ফালা করেছে অন্তর। বাহিরে তবু তিনি ধ্যনস্থ সিদ্ধার্থের মত। তিনি লিখেছেন: "এই করেছ ভালো, নিঠুর (হে), এই করেছ ভালো।/ এমনি করে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো।/ আমার এ ধূপ না পোড়ালে গন্ধ কিছু নাহি ঢালে,/ আমার এ দীপ না জ্বালালে দেয় না কিছুই আলো।/ যখন থাকে অচেতনে এ চিত্ত আমার/ আঘাত সে যে পরশ তব, সেই তো পুরস্কার।/ অন্ধকারে মোহে লাজে চোখে তোমায় দেখি না যে,/ বজ্রে তোলো আগুন করে আমার যত কালো।" পুনরায় লিখেছেন - "আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে/ এ জীবন পুণ্য করো দহন দানে।/ আমার এই দেহখানি তুলে ধরো,/ তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো / নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বালুক গানে।/ আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব/ সারারাত ফোটাক তারা নব নব।/ নয়নের দৃষ্টি হাতে ঘুচবে কালো,/ যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো/ ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্বপানে।"

এরকম আরো অনেক গান আছে যেগুলো তিনি কিশোর বয়সের কাব্যসঙ্গিনী কাদম্বরী দেবীকে নিয়ে লিখেছেন, যেমন - ১. "আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি/ ...বাহির-পানে চোখ মেলেছি হৃদয় পানে চাইনি।" ২. "জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো।” ৩. "বাজিল কাহার বীণা মধুর স্বরে/ আমার নিভৃত নব জীবন 'পরে।” ৪. "দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে/ আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাইনে তোমারে।"

ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো যাঁর নাম দিয়েছিলেন বিজয়া, তাঁকে নিয়েও বেশ কয়েকটি গান লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, যেমন - ১. "আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী।/ তুমি থাকো সিন্ধু পারে ওগো বিদেশিনী।” ২. "আমি যে গান গাই জানি যে কার উদ্দেশে/ যবে জাগে মনে অকারণে চঞ্চল হাওয়ায়, প্রবাসী পাখি উড়ে যায়/ সুর যায় ভেসে কার উদ্দেশে।” ৩. "...দেখা হয়েছিল তোমাতে আমাতে কী জানি কী মহালগনে।/ এখন আমার বেলা নাহি আর বহিব একাকী বিরহের ভার" ৪. অধরা মাধুরী ধরেছি ছন্দোবন্ধনে।/ ওযে সুদূর রাতের পাখি/ গাহে সুদূর রাতের গান।/ .../ ওগো বিদেশিনী,/ তুমি ডাকো মোরে নাম ধরে, / ওযে তোমারি চেনা।"

রবীন্দ্রনাথের কাব্যজীবনকে মোটামুটি সাতটি পর্বে ভাগ করা যায়। রবীন্দ্র কাব্য জীবনের পর্ব বিন্যাসগুলি হল যথাক্রমে ১. সূচনা পর্ব, ২. উন্মেষ পর্ব, ৩. ঐশ্বর্য পর্ব, ৪. অন্তর্বর্তী পর্ব, ৫. গীতাঞ্জলি পর্ব, ৬. বলাকা পর্ব ও ৭. অন্ত্যপর্ব। যেহেতু আমার আলোচ্য বিষয় কবির মানসী জীবনে ও সৃজনে তাই সমস্ত পর্ব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা না করে ঐশ্বর্য পর্বের কিছু অংশ যাতে শুধুমাত্র প্রেম ও প্রেমাণু গত্যের সৌগন্ধ আছে তা নিয়েই আমি আলোচনা করতে চাই। রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতা প্রসঙ্গে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন "প্রেমের ক্ষেত্রে এখনো রবীন্দ্রনাথ অপরাজেয় সম্রাট। তাঁর কবিতায় তাঁর গানে প্রেমের যে জয়গান আছে, তা চিরকালীন। সব বয়সেরই নারী-পুরুষের মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ ঠিক যেন আমাদের মনের কথাই লিখে গেছেন।"

৩. ঐশ্বর্য পর্বের কাব্যগ্রন্থগুলির সময় ও বৈশিষ্ট্য: 'মানসী' (১৮৯০), 'সোনার তরী' (১৮৯৪), 'চিত্রা' (১৮৯৬), 'চৈতালী' (১৮৯৬) প্রভৃতি। রবীন্দ্রনাথের তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বৎসরের মধ্যে লেখা পর্বটি 'ঐশ্বর্যপর্ব' বা সর্বশ্রেষ্ঠ পর্যায়। এই পর্বকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলা হয় এই কারণেই, কেননা, কবির অতি প্রসিদ্ধ কাব্যের অনেকগুলি এই পর্বে প্রকাশিত হয়। শিল্পরূপ, আবেগ, রোমান্টিকতা ও গভীর প্রত্যয়ের এমন সমন্বয় অন্য পর্বে এতটা হয়েছে কিনা সন্দেহ আছে।

'মানসী' কাব্যগ্রন্থের মূলভাব বস্তু: 'মানসী' কাব্যগ্রন্থে কবি শেষপর্যন্ত মর্ত্যকেন্দ্রিক বাসনাবদ্ধ থেকে মুক্ত হয়ে অনাদিকালের হৃদয় উৎস থেকে প্রবাহিত 'যুগল প্রেমের স্রোতে' ভেসে গেছে, এবং 'আশা দিয়ে, ভাষা দিয়ে, তাহে ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তুলি মানস প্রতিমা'- এই কথা বলে দ্বন্দু বিক্ষোভের জগৎ থেকে বিদায় নিতে চেয়েছেন। 'কড়ি ও কোমল' এর কবিতায় জীবনের অভিজ্ঞতা অভিজ্ঞতালব্ধ উপলব্ধিকেই রূপ দিয়েছেন কবি। 'মানসী'তে কবি সরে এসেছেন মানসলোকে। 'কড়ি ও কোমলের অভিজ্ঞতা পরিশ্রুত হয়ে এ কাব্যে আইডিয়ালে রূপান্তরিত হলো। কবি তাঁর শরীরী প্রিয়াকেই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা থেকে বাহির হয়ে বৃহত্তর মানস সংসারের সঙ্গে মিলিত হতে বলেছেন।” সূর দাসের প্রার্থনা'র মূল কথা ইন্দ্রিয়-সীমার বদ্ধতা থেকে মুক্তি চাওয়া- "আঁখি গেলে মোর সীমা চলে যাবে।” সৌন্দর্য আতুর রবীন্দ্রনাথ 'মানসী'তে উচ্চারণ করলেন, “দেখো শুধু ছায়াখানি মেলিয়া নয়ন / রূপ নাহি ধরা দেয় বৃথা যে প্রয়াস" ('নিষ্ফল প্রয়াস'), "কাছে গেলেই 'রূপ কোথা করে পালায়ন'। এসত্য অনুধাবন করেই কবি চান ধ্যানের জগতে সৌন্দর্যময়ী মুতি” প্রতিষ্ঠা। বাস্তবে দেখা গেছে দেহের সাথে দেহে মিলন হলে, সে মিলন কিছু সময় পরে ক্লান্তি জর্জ হয়ে পড়ে। প্রেমের পূরণ হলেই যে প্রেম ফুরিয়ে যায় "ভুল ভাঙা কবিতায় অনুরূপ ভাববস্তু উপস্থাপিত করেছেন, "বাঁশি ভেবেছিল, ধরা দিনু সেই / থামিল বাঁশি। / এখন কেবল চরণে শিকল কঠিন ফাঁসি।"

প্রেমের পরিবর্তে 'মিথ্যা আদর' প্রেমের এ রকম বিকৃতির থেকে বিচ্ছেদকেই শ্রেয় বলে ভেবেছেন রবীন্দ্রনাথ: "একেবারে ভুলে যেয়ো, শতগুণে ভালো সেও / ভালো নয়, প্রেমের বিকৃতি।/ সৌন্দর্য মূলত আত্মার / ক্ষুধা মিটাবার খাদ্য নহে যে মানব।" "শরীরের সৌন্দর্য বিকাশ শুধু দেখে আনন্দ পাবার জন্য, সুতীক্ষ্ণ বাসনা ছুরি দিয়ে সৌন্দর্য শতদল ছিঁড়ে নিলে তা বিনষ্ট করা হয় শুধু...।" "আকাঙ্ক্ষার ধর্ম নহে আত্মা মানবের" (নিষ্ফল প্রয়াস) 'রবীন্দ্রনাথ নির্দিষ্ট ব্যক্তির পরিবর্তে অনন্ত সৌন্দর্যের মাঝে একাকিনী বিরাজিত এক বিমূর্ত প্রিয়াকেই অন্বেষণে করেন। (মেঘদূত) যে ভালোবাসা নিছক সুখ-দুঃখের নিগড়ে আবদ্ধ নয়, সে ভালোবাসাকে প্রত্যক্ষ করা যায় জন্মে-জন্মান্তরে, যুগে-যুগান্তরে কালের তিমির রজনী ভেদ করে দয়িতার মূর্তি যেন চিরস্মৃতিময় ধ্রুবতারকার মত কবিচিত্তে উদয় হয়। তখনি বলা সম্ভব "আমা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগল প্রেমের ক্ষোভে / অনাদিকালের হৃদয় উৎস হতে।" 'কড়ি ও কোমল'-এ কবির নিজের মতে, প্রথম জেগে উঠেছিল বহিদৃষ্টি প্রবণতা সেই প্রবণতা 'মানসী'তে এসেই পরিণতি পেল, আত্মস্বরের বাইরে শোনা গেল অন্যান্য চরিত্রের স্বর 'নারীর উক্তি', 'পুরুষের উক্তি', 'ব্যক্ত প্রেম', 'গুপ্ত প্রেম'-এর মত নাটকীয় একাক্তি রচিত হল।

সোনার তরী কাব্যের মূল উপজীব্য 'সোনার তরী' রবীন্দ্র কাব্যজীবনের একটা বিশেষ প্রতীক বলে গৃহীত হতে পারে। এই কাব্যে নিসর্গের অপূর্ব মাধুরী ব্যক্তি মানসের সঙ্গে একীভূত হয়েছে। কবি যেন জাতিস্বর হয়ে সুদূর অতীত থেকে অনাগত ভবিষ্যতের মধ্যে নিজ জীবন প্রবাহকে অঙ্গীভূত করে উপলব্ধি করলেন। ('সমুদ্রের প্রতি' ও 'বসুন্ধরা' কবিতায়) 'মানস সুন্দরী' ও 'জীবন দেবতা' তত্ত্বের প্রথম পুরো রূপটি 'সোনার তরী' কাব্যের মধ্যেই ধরা পড়ে। 'মানসী' কাব্যগ্রন্থের 'বহিদৃষ্টি প্রবণ' কবিতাগুলিতে আছে বাস্তব সংসারের পটভূমি, 'সোনার তরী' কাব্যগ্রন্থে তার পরিবর্তে এল কাল্পনিক পটভূমি, রোমান্টিক বাতাবরণ। 'সোনার তরী'র 'বহিদৃষ্টি প্রবণ' প্রেমের এমন অসামান্য গাঁথা আর কোথাও দেখা যায়নি। "... কহিল কবির স্ত্রী, / রাশি রাশি মিল করিয়াছ জড়ো / রচিতেছে বসি পুঁথি বড়ো বড়ো / মাথার উপরে বাড়ি পড়ো-পড়ো / তার খোঁজ রাখ কি!” 'সোনার তরী'র পরবর্তী কাব্য 'চিত্রা'তে দাম্পত্য প্রেমের ছবি দেখি 'প্রেমের অভিষেক' ও 'এবার ফিরাও মরে' কবিতায়। 'চিত্রা' রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে পরিণত মনের কাব্য। রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি উৎকৃষ্ট কবিতা এই কাব্যের সম্পদ। এই কাব্যে 'মানস সুন্দরী' ও 'জীবন দেবতা' তত্ত্ব একটা পরিপূর্ণ সমন্বয় ও ঐক্যের মধ্যে মিলিত হয়েছে। 'চিত্রা' কাব্যে 'জীবন দেবতা' বিষয়ক কবিতাগুলি হল- 'চিত্রা', 'জীবন দেবতা', 'অন্তর্যামী' ও 'সিন্ধুপারে'। 'চৈতালী' কাব্যগ্রন্থের মূল ভাব হল পরিপূর্ণ জীবনের আনন্দ, ঐশ্বর্য, খণ্ড ও প্রত্যহকে অখণ্ড অন্দরের সঙ্গে গেঁথে তুলবার ইচ্ছা এবং প্রাচীন ও পুরাতন ভারতবর্ষের মধ্যে মানস পরিক্রমা গাঢ়বদ্ধ সনেটের মধ্য দিয়ে চমৎকার ফুটে উঠেছে। ঐশ্বর্য পর্বের সর্বশেষ কাব্য বলে এই কাব্যকে চৈতালী ফসলের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। 'মানসী' কবিতায় মানসীকে উন্মোচন করতে দেখি "শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী।/ পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি / আপন অন্তর হতে / বসি কবিগণ / সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন। / সঁপিয়া তোমার 'পরে নূতন মহিমা / অমর করিছে শিল্পী তোমার প্রতিমা। /.../ লজ্জা দিয়ে সজ্জা দিয়ে, দিয়ে আবরণ, / তোমারে দুর্লভ করি করছে গোপন। / পড়েছে তোমার 'পরে প্রদীপ্ত বাসনা / অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা।"

মৃত্যুঞ্জয় সেন লিখেছেন, "রবীন্দ্র সাহিত্যে প্রেমের প্রকাশ ও বিকাশ মানব সত্ত্বার পূর্ণতায়। প্রেমের চিরকালীন লাবণ্য, কল্পনা, প্রকৃতি রঙ নানা ব্যাখ্যায় উপস্থিত হয়েছে তাঁর কবিতায়, তাঁর গানে। যে প্রেম কখনও মিলনান্ত, বিয়োগান্ত, কখনও আকুতিরা ... রবীন্দ্রনাথের সব প্রেমের কবিতা ও গানের ভাষা যেন জীবন দেবতার অপার করুণাধারায় গিয়ে মিশেছে। তাঁর প্রেম নিভৃতে নিবেদিত প্রাণের দেবতার প্রতি এক সশ্রদ্ধ ভক্তিরস। তাঁর নির্মিত প্রেম যেন নারী পুরুষ আর ঈশ্বরের মিলন।"

'আমার সাহিত্য সাধনা'য় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, "আমার আয়ু এখন পরিণামের দিকে এসেছে। আমার মতে আমার শেষ কর্তব্য হচ্ছে, যে লেখাগুলিকে মনে করি সাহিত্যের লক্ষ্যে এসে পৌঁছেছে তাদের রক্ষা করে বাকিগুলোকে বর্জন করা, কেননা রস সৃষ্টির সত্য পরিচয়ের সেই একমাত্র উপায়। সবকিছুকে নির্বিচারে রাশীকৃত করলে সমগ্রকে চেনা যায় না। সাহিত্য রচয়িতারূপে আমার চিত্তের যে একটি চেহারা আছে সেইটিকে স্পষ্ট করে প্রকাশ করা যেতে পারলেই আমার সার্থকতা। অরণ্যকে চেনাতে গেলেই জঙ্গলকে সাফ করা চায়, কুঠারের দরকার। ... যারা অসম্পূর্ণ, কারখানা-ঘরের বাইরে তাদের আনা উচিত হয় না। কিন্তু তারা যে অনেক এসে পড়েছে তা এই বইয়ের গোড়ার দিকের কবিতাগুলি দেখলে ধরা পড়বে। কুয়াশা যেমন বৃষ্টি নয়, এরাও তেমনি কবিতা নয়। যাঁরা পড়বেন তাঁরা এইসব কাঁচটা বয়সের অকালজাত অঙ্গহীনতার নমুনা দেখে যদি হাসতে হয় তো হাসবেন, তবু একটুখানি দয়া রাখবেন মনে এই ভেবে যে, ভাগ্যক্রমে এই আরম্ভই শেষ নয়।"

শিল্প প্রাত্যহিকতার দাসত্ব থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়। তাই দেখা যায় শুধুমাত্র বেঁচে থাকার সংগ্রামে নিয়ত ব্যস্ত থেকেও মানুষ তার সুকুমারবৃত্তিগুলোকে যে কোন অবস্থায় প্রকাশ করার প্রয়াস করেছে। লেখক, কবি বা শিল্পী কেউই নিজের চিন্তাভাবনাকে শিল্পের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরতে পারেন না। সংগতিহীন টুকরো চিন্তা বা অনুভাবনাকেই মাঝে মাঝে মনে হয় অধিক গুরুত্বপূর্ণ যা শিল্প বা সাহিত্যধারায় প্রবাহিত হয় না, থেকে যায় মনের গভীরে। মানসিক প্রস্তুতি ও আবেগের অন্তরঙ্গতা থাকলেও কোন বিশেষ মুহূর্তে কবি যেটা প্রকাশ করতে চাইছেন শব্দ দিয়ে, রং দিয়ে বা সুর দিয়ে যে নিবিড় নিরাময়তা দিতে চাইছেন নিজেকে সাথে সাথে দিক্ষিত পাঠককে কবিতার ছায়ায় আশ্রয় পাওয়ার জন্য, অনেক সময়েই তা পেরে ওঠেন না আর এই জন্যই অতৃপ্তি, আরো নিঃসঙ্গতা, আরো নিবিড় অন্বেষণ চিন্তনে মননে। এই যে টানাপড়েন, মননের তীব্র পীড়ন, চিন্তাজগতে বিপুল আলোড়নের মধ্য দিয়ে কবি 'বিশ্বাসের ভূমি' উদ্ধার করতে সমর্থ হন। সিন্থোসিসের ভিতরে পেয়ে যান - থিসিস-অ্যান্টিথিসিসের এক মৌল অস্তিত্বকে। থিসিস-অ্যন্টিথিসিসের পর সিন্থেসিসের সলিড্ ভাবনায় প্রবেশের মত, সমাজবদ্ধজীবের দায়বদ্ধতা এবং মননভূমিতে চেতনার গভীরে অসম্ভব পীড়ন থেকেই কবির ভিতরে এক ধরনের অসহায়তা, বিপন্নতার জন্ম নেয়, অবচেতন মনে ভিন্ন এক আলো এসে ধরা দেয় যে আলোয় কবিতার বসতভিটে, আবার অন্ধকারের আবাস ভূমিও সেখানে।

সময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে না, বরঞ্চ আমাদেরকেই সুসময়ের জন্য, মহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষা করতে হয়। 'এই আছি, এই নেই, শেষ হবে জীবনবাতী।' একটা পারপ্লেক্স সিটি, একটা দোদুল্যমানতা সব সময় কাজ করে যাবৎকালে। সুলগ্ন খরস্রোতা নদীতে যতই পরপর দুটো ডুব দিক না কেনো, দুটো ডুবই কিন্তু জলের ভিন্নতায়, অভিনবত্বে 'সুলগ্ন'কে ক্লেদমুক্ত করছে। জয় গোস্বামী 'নিজের রবীন্দ্রনাথ' প্রবন্ধে লিখেছেন "রবীন্দ্রনাথের মত এত অজস্রবার নতুন হয়ে উঠতে আমি দেখিনি কোন কবিকে। একটা স্কুলে গেছি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কিছু বলতে, ছোটরা উৎসুক চোখ নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। হঠাৎ মনে হল কি বলবো?... যা বলবো তাই যদি এদের কাছে ভুল প্রমাণিত হয় পরে, রবীন্দ্রনাথ তো কোন স্কুল পাঠ্য অংক নন, যে সবার খাতায় একই উত্তর হবে। এক একজনের রবীন্দ্রনাথ এক এক রকম।” “এক একটা শব্দের খনিগর্ভে প্রবেশ করলে / প্রাগৈতিহাসিক জলের দেখা মেলে / নিজেকে তখন এককোষী অ্যামিবা / বলে মনে হয়, / অবিরাম সাঁতার কাটি / প্রাচীন জলে / সাদা খাতা পূর্ণ করবার জন্য / এ যাবৎকাল পর্যন্ত আমি / যেন একটা কবিতাই / লিখে চলেছি...।" তন্বিষ্ঠভাবে রবিঠাকুরের কাব্য ও গান পাঠ করলে অনুভূত হয় রবীন্দ্রনাথ যেন সারাজীবন একটা কবিতাই লিখতে চেয়েছেন তা প্রেমের কবিতা, যেখানে তিনি তাঁর কাব্যমানসীকে উত্তোরণ করেছেন 'জীবন দেবতা' রূপে, প্রেমকে তিনি প্রকৃতির সাথে যুক্ত করে পূজার স্তরে নিয়ে গেছেন।

(সমাপ্ত)


যে পত্র-পত্রিকা ও গ্রন্থগুলি আমাকে তথ্যানুসন্ধান করতে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে তার উল্লেখ করলাম এখানে -

১। 'প্রাহ্ন' পত্রিকা (রবীন্দ্রভাবতী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদ, সান্ধ্য-১৯৯৩-৯৪)।
২। 'দেশ' পত্রিকা ২রা এপ্রিল, ২রা মে ২০০৫।
৩। 'শিক্ষা ও সাহিত্য' পত্রিকা, নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতি, ডিসেম্বর ২০০৬।

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।