।। ৩ ।।
গোটা একটা বছর আরও সময় আছে। বাবা অবশেষে রাজী হয়েছে,তোমার বিয়ে পিছিয়ে দেওয়ার। তোমার এখন স্বয়ম্বরের কল্পনায় রঙ লেগেছে। তুমি বসে বসে ভাবছ, সত্যিই কি তুমি, তোমার মনের মত পুরুষের দেখা পাবে? এতদিন, তোমার স্বপ্নের রাজকুমার তো কেউ ছিল না। ইদানীং ভাবতে শুরু করেছো কেমন পুরুষ পছন্দ তোমার? সেকি হবে কঠিন শৌর্যের প্রতীক নাকি ক্ষমাশীল ধৈর্যের আধার? কে তোমাকে দেবে সবচেয়ে বেশী স্বাধীনতা? তোমার কাছে স্বাধীনতাই হচ্ছে, ভালবাসার নামান্তর!
এমনতর ভাবনায় বিভোর হয়ে দিন কাটতে লাগল, কিন্ত যুধাজিত হঠাৎই একদিন এসে যা বলল, তাতে তোমার, স্বপ্ন দেখার দিন ফুরালো। বাবা, যুধাজিত কে ডেকে বুঝিয়ে বলেছেন, যে তোমার স্বয়ম্বরের আয়োজন করার সামর্থ্য এই মুহুর্তে রাজ কোষাগারের নেই। আবার ইতিমধ্যে কোশল দেশের রাজা একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন যা খুবই আকর্ষনীয়! ভারত ভূখন্ডের, এই সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হল কোশল। অযোধ্যা হল কোশলের রাজধানী আর রাজার নাম দশরথ। সেই রাজার সব আছে, ধনভান্ডার পরিপূর্ণ, সীমান্ত বর্তী সমস্ত দেশ গুলি রাজার বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে, দেশের মধ্যে ভক্ত প্রজাকুল আছে, তিনশো জন রাণী আছে, অবশ্য তার মধ্যে পাটরাণী আছে দুজন, কিন্ত দশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, রাজার কোনও সন্তান নেই। তাই রাজা দশরথ, তোমার রূপ গুণের কথা জানতে পেরে, তোমাকে তার তৃতীয় রাণী হিসেবে পেতে চান।
এমনতর লোভনীয় প্রস্তাব কে অমান্য করার কথা রাজা অশ্বপতি ভাবতেও পারেন না। অতএব, যুধাজিতের ওপর দায়িত্ব দিয়েছেন, তোমাকে সম্মত করানোর জন্য।
যে কথা বলা হয়নি, তুমি যে শুধু ভাল যোদ্ধা বা ঘোড়সওয়ার হয়ে উঠেছ, তাই নয়, তুমি ইতিমধ্যে যুধাজিতের কাছ থেকে রথ চালনাও শিখে নিয়েছ। একই রকম কুশলতায় আজকাল তুমি রথ চালাতে পার! কতদিন দূরের প্রান্তরে যুধাজিত তোমার রথের সওয়ারী হয়েছে আর বলেছে, " তুমি সবদিক দিয়ে আমার থেকে সেরা, আমি যত তোমাকে দেখছি ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি!"
সেই যুধাজিত তোমাকে বোঝাতে চাইছে, " কৈকেয়ী, স্বয়ম্বর হলেও, তোমার পছন্দের রাজকুমার কে তুমি বরমালা পড়াতে পারবেনা, এটা জেনে রাখো, বাবা যাকে মনে করবেন বা যাকে স্বামী হিসেবে পেলে, কেকয়া রাজ্যের লাভ হবে, তাকেই তোমার মেনে নিতে হবে বাধ্য হয়ে। তার চেয়ে এই সম্বন্ধ অনেক ভাল! তুমি রাজার তৃতীয় রাণী হবে ঠিকই, তবে তোমার ইচ্ছা মতো জীবন কাটাতে পারবে, কারণ শুনেছি রাজা দশরথ সবদিক দিয়েই মানুষ ভাল, তোমাকে তিনি সুখেই রাখবেন, আশাকরি!
রাগে ফেটে পড়লে তুমি, " যুধাজিত, তুমিও একথা বলবে, আমি ভাবতেও পারিনি। রাজা দশরথ আমাকে, শুধু তার সন্তান ধারনের জন্য বিবাহ করতে চান। তিনি, আমাকে চান না, আর আমিও কোনও অচেনা পুরুষের সন্তান ধারণ করার জন্য বিবাহ করতে রাজী নই। তুমি রাজা হতে চাও, তাই তুমি পিতার সব আদেশ শিরোধার্য কর!
এই বিয়েতে তিনজন পুরুষের স্বার্থ সিদ্ধি হবে, রাজা অশ্বপতি, দশরথের মত রাজাধিরাজের বন্ধুত্ব লাভ করবে, তুমি বাবার কাছে আরও বেশী বিশ্বস্ত হয়ে উঠবে, আর দশরথের সন্তানলাভের ইচ্ছা পূর্ণ হবে। কিন্ত আমার কি হবে? চলে যাও তুমি!" আহত বিস্মিত যুধাজিতের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে, তোমার বিছানায় শুয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লে।
সাবধানে, মন্থরা ভেজানো দরজা খুলে ঘরে এল।সে সবই শুনেছে। ঘরে এসে তোমার মাথার কাছে বসে পরম মমতায়, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল! বলল, " দ্যাখো বাছা, আমার এতখানি বয়স হল, জীবনে অনেক দেখলাম, কার কিসে ভাল হয়, সেটুকু বোঝার মত বুদ্ধি আমার হয়েছে! তাই বলছি, এমন সন্বন্ধের প্রস্তাব তুমি হাতছাড়া কোরোনা। এতে আখেরে তোমার লাভই হবে। এখানে তোমার বাবা কে তো দেখছি, ফিরেও তাকাননা তোমার দিকে, আমি তোমাকে এতদিন বুক দিয়ে আগলেছি, কিন্ত আমার ক্ষমতা কতটুকু? এরপর এই বিবাহ না হলে হয়তো, যে কোনদিন যার তার গলায় ঝুলিয়ে দেবেন তোমাকে! তখন আমি তো কোন ছার, যুধাজিত ও কিচ্ছু করতে পারবেনা।"
তুমি মন্থরার দিকে চেয়ে বললে, " সত্যি বলছ, মানে নিজের মন থেকে বলছ তো? নাকি তোমাকেও কেউ পাঠিয়েছে আমায় রাজী করাতে?"
মন্থরার কথা তুমি অক্ষরে অক্ষরে মানো, কারণ এতদিনে এইটুকু বুঝেছ যে একমাত্র এই মানুষটা তোমাকে নিজের প্রাণের থেকেও বেশী ভালবাসে।
শুরু হল প্রস্তুতি পর্ব, মন্থরা তোমার, রাজী হওয়ার সংবাদ দিল যুধাজিত কে, যুধাজিত দিল পিতা অশ্বপতি কে, পিতা দিল রাজা দশরথ কে। চারিদিকে সাজোসাজো রব উঠল! তোমাদের প্রাচীন পাথরের তৈরী রাজপ্রাসাদটা ঘষা মাজা হতে লাগল। রন্ধনশালার বড় বড় রাঁধুনিরা নড়ে চড়ে বসল! এদের সবার সঙ্গে তোমার আলাপ ছিল। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, তোমার ওপর রন্ধনশালার তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেও বিশেষত মন্থরারই আগ্রহে! কারণ তোমাকে সমস্ত বিষয়ে পারঙ্গম করে গড়ে তুলতে চেয়েছিল মন্থরা। তোমার নির্দেশেই অযোধ্যা বাসীদের জন্য বিশেষ বিশেষ রান্নার আয়োজন হল। কেকয়াবাসী দের থেকে তাদের খাদ্যাভ্যাস অনেকটাই আলাদা, একথা তুমি বিভিন্ন লোকের মুখে শুনেছিলে।
অবশেষে সব কিছুর সঙ্গে মিশে গিয়ে, সবার আনন্দের সাথে নিজের আনন্দটা ভাগ করে নিলে। রাজা দশরথের পত্নী হতে আগ্রহী হলে তুমি!
গ্রন্থের নামঃ কৈকেয়ী (Kaikeyi: A Novel)
লেখিকাঃ বৈষ্ণবী প্যাটেল (Vaishnavi Patel)
ভাষাঃ ইংরাজী
প্রকাশকঃ রেডহুক (Redhook)
বাঁধাইঃ পেপারব্যাক
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৫১২ পাতা
মুদ্রিত মূল্য (ভারতীয় মুদ্রায়): ১,৭৩৪ টাকা
(ক্রমশ)