"পাহাড়ের গায়ে রোদ্দুর খেলা করে
সবুজের বন রহস্যে ভরপুর
পাহাড়ি নদীটি ভিজিয়ে দিচ্ছে পা
মেঘেরা বলল, চলো না অনেক দূর।
আঁকাবাঁকা পথে রঙিন পাথর খুঁজি
তারার আলোয় প্রকৃতির কানাকানি
পথের প্রান্তে দোদুল্যমান সেতু
শাল-মহুয়ার একরাশ হাতছানি।"
আবারও বেরিয়ে পড়লাম ডুয়ার্সের উদ্দেশ্যে। সবুজ পাহাড় আমাকে বারবার ডাকে। চললাম লাটাগুড়ি, ঝালং, বিন্দু, সান্তালখোলা হয়ে রিশপ-এ। সঙ্গে আমার পরিবার ও বিদ্যালয়ের কয়েকজন সহকর্মীর পরিবার।
বিকেলে নবদ্বীপ ধাম স্টেশন থেকে তিস্তা-তোর্সা এক্সপ্রেস ধরে নিউ ময়নাগুড়ি স্টেশনে পৌঁছলাম ভোরবেলায়। শীত জড়িয়ে ধরেছে নিউ ময়নাগুড়িকে। বলা ভালো, হালকা শীতের মেজাজে পরিচ্ছন্ন, নির্জন ময়নাগুড়ি আমাদের স্বাগত জানাল। স্টেশনে গাড়ি হাজির ছিল। রওনা দিলাম লাটাগুড়ির রিসর্ট-এ। প্রকৃতির কোলে সাজানো গোছানো রিসর্ট। রোদ ঝলমলে আবহাওয়া, পাখির ডাক সকালটাকে মনোরম করে তুলেছিল। গরুমারা জাতীয় উদ্যান এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়।
ব্রেকফার্স্ট সেরে টিকিট সংগ্রহ করতে গিয়ে অভিজ্ঞতা হ’ল বেশ। বিকেলের সাফারির টিকিট কাটতে লম্বা লাইন। 'যাত্রাপ্রসাদ ও রাইনো' সাফারির ডিমাণ্ড সবচেয়ে বেশি। আমরা খুশি, আমরা সেই সুযোগ পেলাম। তিনটে নাগাদ জঙ্গলের দরজা খুলে গেল। আঁকাবাঁকা মেঠো পথ ধরে জিপসি চলল। সূর্যদেবতা তখনও আকাশে বিরাজমান হলেও ক্রমশ আমরা প্রায়ান্ধকার অরণ্য’র গভীরে যেতে লাগলাম। পথে দেখা মিলল ময়ূরের।
নানা গাছের সারি। নিঃঝুম এই পরিবেশে হুডখোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘ্রাণ নিলাম প্রকৃতির। মূর্তিনদীর ধারে ওয়াচ টাওয়ারে পৌঁছতেই আনন্দে আত্মহারা সকলে। নদীতে জল খাচ্ছে একশৃঙ্গ গণ্ডার, নদীর পাড়ে একপাল হরিণ, একদল বাইসন গভীর জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছে।একঝাঁক সাদা বক জড়িয়ে ধরেছে গণ্ডারগুলোকে। দূরে পাহাড়শ্রেণি, এঁকেবেঁকে চলেছে মূর্তি নদী। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। রং পাল্টে যাচ্ছে বনানীর, আকাশের। প্রকৃতির কোলে, প্রকৃতির স্নেহে বড় হয়ে ওঠা গণ্ডারদের দেখে বলতে ইচ্ছে হ'ল 'বন্যেরা বনে সুন্দর'।
জঙ্গলের পথ পেরিয়ে পৌঁছলাম ধামসা-মাদলের তালে-ছন্দে মাতোয়ারা হতে স্থানীয় শিল্পীদের নৃত্য'র আসরে। তাঁদের অভ্যর্থনায় আমরা সবাই আপ্লুত। আমার কন্যাও যোগ দিল তাঁদের সঙ্গে। গানের সুরে সন্ধ্যার বাতাস তখন মুখরিত। সেখান থেকে ফিরে মুড়ি ও বেগুনির সঙ্গে গরম কফি হাতে বাংলোর বারান্দায় শুরু হ’ল সান্ধ্য আড্ডা - গান, কবিতা।
পরের দিন ভুটান পাহাড়ের কোলে মূর্তি নদীর শীতল জলে পা ডুবিয়ে, রঙিন পাথর কুড়িয়ে নিয়ে, চাপড়ামারি জঙ্গল পেরিয়ে চলে এলাম ভুটান সীমান্তে, সবুজে ছাওয়া রূপসী ঝালং-এ। ঝোলুং ও জলঢাকার সঙ্গমে পাহাড়ঘেরা ঝালং। ভিউ পয়েন্ট থেকে নিচের দৃশ্য অসাধারণ। ঝালং থেকে ১২ কিমি উত্তরে ভুটানের টেণ্ডু পাহাড়ের কোলে ভারতের শেষ জনপদ বিন্দু। এখানে এসে কিছুটা হলেও দুঃখ পেলাম। লকগেটের ঝোলানো সেতু পেরিয়ে রয়্যাল ভুটান রাষ্ট্র। জলঢাকার মৃদু কলতান ও সবুজ অরণ্য'র যুগলবন্দি প্রশান্তি এনে দিল মনে। এখান থেকে রওনা দিলাম সান্তালখোলার উদ্দেশ্যে। সামসিং থেকে প্রায় চার কিলোমিটার। পথে আমরা নামলাম চা-বাগান দেখতে। ডুয়ার্সের প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। আসলে যখন ম্রিয়মান রোদ্দুর, দূরে পাহাড়শ্রেণিকে ঘিরে ধরেছে মেঘ, চা-বাগানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় বোধহয় এটি।
কেউ কেউ বলেন ‘সান্তালখোলা যেন প্রকৃতির শেষ স্টেশন'। দু’পাশে গভীর খাদ। এক ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে পৌঁছে যাবেন 'সান্তালখোলা ওয়াইল্ডারনেস ক্যাম্প'-এ। চারপাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ পাহাড়। পাহাড়ের মধ্যিখানে বসে নির্জনতা অনুভব করার এমন পরিবেশ বোধহয় আর দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না। রকি আইল্যাণ্ডে পৌঁছলাম যখন তখন প্রায় অন্ধকার নেমে এসেছে। আলো-আঁধারিতে এক অন্যরকমের অনুভূতি হ’ল।
পরের দিন রওনা হলাম লাভা হয়ে রিশপ-এর উদ্দেশ্যে। গরুবাথান হয়ে রাস্তা ছিল ভীষণ খারাপ। তার উপর রাস্তায় প্রায় এক ঘন্টা দেরি হ’ল। মিলিটারি কনভয় চলেছে। প্রায় ১৫০টি গাড়ি অতিক্রম করল আমাদের। এ-ও বেশ লাগল। দুপুরবেলা পৌঁছে গেলাম লাভা। ‘মেঘপরীদের দেশ' লাভা। হাত দিয়ে ছোঁয়া যায় মেঘ। আকাশ ছিল পরিষ্কার। সাদা মেঘের ভেলা আকাশজুড়ে। রোদ্দুরের খেলা পাহাড়জুড়ে। বৌদ্ধ মনেস্ট্রিতে চলছিল প্রার্থনা। ‘লাভা' শব্দ’র অর্থ জানতাম। ‘লা’ মানে ঈশ্বর, ‘ভা’ অর্থাৎ উপস্থিতি। সত্যিই ঈশ্বরের উপস্থিতি লক্ষ্য করলাম যেন। সুশীতল ঠাণ্ডা বাতাস, নৈসর্গিক শোভাকে আরও সুন্দর করে তুলেছিল।
যখন রিশপ পৌঁছলাম, তখন পাহাড়ের গায়ে সন্ধ্যে নামছে। কাঞ্চনজংঘার দেখা বিকেলে মিলল না ঠিকই, কিন্তু রাতের আকাশে অসংখ্য তারার দেখা মিলল। জ্বলে উঠল দূরের সিকিম। ছবির মতো দেখতে পেলাম গ্যাংটক শহরকে, জ্বলজ্বল করছে সিল্ক রোড, পেলিং। পাহাড়ের গায়ে কেউ যেন হাজার হাজার মোমবাতি জ্বেলে দিয়েছে। এরই মধ্যে লোডশেডিং হল। অন্ধকার রিশপ থেকে দূরের পাহাড় যেন আলিঙ্গন করছে আমাকে। ‘রিশপ’ কথার অর্থ 'পাহাড়চুড়োয় প্রাচীন বৃক্ষ’ - যেন সত্যি হয়ে উঠল আমাদের কাছে।
সারারাত ঘুমোইনি। অপেক্ষা করেছিলাম ভোরের জন্য। কাঞ্চনজংঘার অপার সৌন্দর্য দেখার আকাঙ্ক্ষা ঘুমোতে দেয়নি। কাঁচের জানলার পর্দা বারবার সরিয়েছি। মেঘ এসে, কুয়াশা এসে ঘিরে ধরেনি তো পাহাড়কে? না, ভাগ্য সুপ্রসন্ন। ঠিক ভোর চারটে থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত কাঞ্চনজংঘার নানা রূপ মুগ্ধ করল। সারা উত্তরদিক জুড়ে পূর্ব হিমালয়ের নানা শৈলশিরা দেখা গেল। উপত্যকাজুড়ে রোদের খেলা। দূরের শহর-গ্রাম সঙ্গীরূপে প্রতিভাত। প্রকৃতি যেন নিজের রূপ-রস-গন্ধ ছড়িয়ে রেখেছে সেখানে। রিশপ যখন ছাড়লাম তখনও হিমালয় স্বমহিমায় বিরাজমান। কালিম্পং হয়ে আমরা ফিরব। দেখে নিলাম ডেলো পাহাড়ের ডেলো বাংলো, অর্কিড ও ক্যাকটাসের নার্সারি, গৌরীপুর ভবন তথা চিত্রভানু। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন চিত্রভানুতে। কালিম্পং-এর সৌন্দর্য তাঁর ভাষাতেই বলি, কথাগুলি খোদিত আছে সেখানে -
"আমার আনন্দে আজ
একাকার ধ্বনি আর রঙ
জানে তা কি এ কালিম্পঙ।"
কালিম্পঙকে টা-টা করে রওনা হলাম নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। তারপর তিস্তা-তোর্সা এক্সপ্রেস ধরে নবদ্বীপ ফেরা।
ডুয়ার্সের হৃদয়ের কথা শুনে বেশ কিছুদিন আনন্দে কাটিয়ে দিতে পারব। ডুয়ার্সও অপেক্ষায় থাকবে আমাদের।
আলোকচিত্রঃ লেখক।