বিবিধ

কৃষ্ণনগরে কাজী (একাদশ পর্ব) [ধারাবাহিক]



ইনাস উদ্দীন


[১৯২৬ সালের জানুয়ারির ৩ তারিখে কবি সপরিবার কৃষ্ণনগর এসেছিলেন, এনেছিলেন হেমন্তকুমার সরকার। কবিকে কেন এনেছিলেন তিনি? শুধুই বন্ধু বলে? প্রতিভাবান কবি বলে? মাস ছয়-সাতেক গোলাপট্টিতে থেকে কবি গ্রেস কটেজে আসেন। ঠিক কবে আসেন তিনি? জুলাই, নাকি আগস্ট? কেনই বা এলেন এই বাড়িতে? ভীষণ দারিদ্র্যের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে নির্জন এক প্রান্তে? অনেক কিছুই আমরা জানি না, জানাও যায় না। এখান-ওখান থেকে জোগাড় করা তথ্য আর তার সাথে খানিক অনুমান মিশিয়ে টুকরো কথার কিছু দৃশ্য সাজিয়ে তোলার চেষ্টা এই কাহিনীতে।]


কৃষ্ণনগরে কাজী নজরুল ইসলাম (১৯২৭ সালে তোলা ছবি)।

পর্ব - ১১

দুটো দিন ঘরে থেকে যেন হাঁপিয়ে উঠেছেন নজরুল।

বিশ্রাম তো নয়, এ যেন সশ্রম কারাদণ্ড। জ্বর যখন আসে তখন সে তো একা আসেনা, সারা শরীরে কাঁপুনি আর তার সাথে মাথায় যেন বিশ মন ওজন। এর মধ্যে একটাই সুখের পরশ - তা হলো কারারক্ষীর স্নেহের শিকল। সকাল থেকে রাত্রি সারাক্ষণ তাকে আগলে রেখেছে, জড়িয়ে রেখেছে, ভরিয়ে রেখেছে - সেবায়, যত্নে, ভালোবাসায়।

বিবাহের দুই বছর হতে চলল দোলনকে এত নিবিড় করে কাছে পাওয়া আগে হয়ে ওঠেনি। কতই বা বয়স, এখনো তো আঠারোই পূর্ণ হয়নি, এখনই যেন এক দায়িত্বশীল স্ত্রী হয়ে উঠেছে। অথচ হুগলিতে এই ক'দিন আগে পর্যন্ত সে তো একটা বালিকাই ছিল। ম্যালেরিয়া আর আমাশয়ের জোড়া ধাক্কায় সংকটাপন্ন বেহাল স্বামীকে সেখানেও সে সেবা যত্ন করেছে, তবুও সেখানে তার ভূমিকা ছিল মায়ের সহকারীর মতো। সঙ্গে ছিল প্রিয় নুরুদার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া অন্ধ ভালবাসা। আবেগ ছিল, মনের মানুষটার জন্য উথাল-পাতাল কান্না ছিল, কিন্তু তাকে আগলে রাখার জন্য অধিকারবোধ প্রয়োগের কোন বহিঃপ্রকাশ ছিল না। কিশোরীর প্রেম তো এরকমই হয়। সে যখন ভালোবাসে তখন সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েই ভালোবাসে। আশপাশের জগত-সংসার সবকিছুই তার প্রেমের সামনে তুচ্ছ হয়ে যায়। জাতি, ধর্ম, কুমিল্লায় তাদের বনেদি পরিবারের অভিজাত্য, সামাজিক মান - কোনও কিছুই তাকে আটকাতে পারেনি। শেষমেষ তার মাকেও এই প্রেমের সামনে হার মানতে হয়েছিল। তবে একটা জায়গায় বড় ধাক্কা খেয়েছিল দোলন। জেঠিমা বিরজা সুন্দরী দেবী যখন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি ছাপিয়ে তাদের বিবাহে অসম্মতি এবং সম্পর্ক ত্যাগের কথা জানালেন, দোলন সেদিন খুব কেঁদেছিল, তুচ্ছ বলে উড়িয়ে দিতে পারেনি। হয়তো ওর মনের কোণে একটা গোপন প্রত্যাশা ছিল - যে জেঠিমা নজরুলকে আপন ছেলের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন, তিনি কখনো তাদের ফেলে দিতে পারবেন না। জেলখানায় গিয়ে না খেয়ে মরতে বসা মানুষটাকে খাইয়ে এসেছেন খবরটা শোনার পর জেঠিমার উপর শ্রদ্ধা আর ভরসা বেড়ে গিয়েছিল দোলনের। অন্যে যাই বলুক - তিনি অন্তত তাদের প্রেমকে মেনে নেবেন।

কৃষ্ণনগরে এসে দশ দিন যেতে না যেতে কিশোরী বালিকাটি যেন এক কর্তৃত্বময়ী নারী হয়ে উঠেছে। প্রবল যন্ত্রণার মধ্যেও দোলনের এই পরিবর্তন নজরুলকে আরাম দেয়। তবু তাঁর ঘর পালানো মনটা যেন দুই দিনেই হাঁসফাঁস করতে থাকে। নির্দিষ্ট কোনও গন্তব্য নেই, অনুষ্ঠান নেই, তবু বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। ঘরের থেকে বাহিরে যেন বেশি আনন্দ। বেশ ক'দিন পার হয়ে গেল, কৃষ্ণনগর শহরটা ঘুরে দেখাই হলো না। ঘূর্ণীর পুতুলপট্টি, রাজবাড়ি, রেসকোর্সের মাঠ, ক্যাথলিক চার্চ - ঘুরে দেখব দেখব করে হয়েই উঠল না। এর মধ্যে অবশ্য এক বিকেলে টাউন হলের জমায়েতে কবিতা আর গান শুনিয়ে এসেছেন। আসলে সব ঝামেলার গোড়া এই জ্বরাক্রান্ত কাহিল শরীরটা। বাউন্ডুলের মতো ঘুরে বেড়ানো সামরিক ট্রেনিং নেওয়া শরীর - কোনও কিছুতে ক্লান্তি ছিল না।

গফরগাঁও সম্মেলনের জন্য চিঠিটা লিখতে হবে। দু'দিন থেকে কলম ধরা হয়নি। লেখা তো তাঁর কলমে ঝড়ের মতো আসে, ভাবনাচিন্তার দরকার পড়ে না, ধৈর্যও থাকে না। সৃষ্টিকর্তা তাঁকে যে এই অদ্ভুত ক্ষমতা প্রদান করেছেন তা নিয়ে নজরুল নিজেই নিজেকে নিয়ে বিস্ময় বোধ করেন। ধুতির উপর পাঞ্জাবি পরে তার উপর শালটা জড়িয়ে বারান্দায় এসে বসলেন। এখানে বসলে কেমন একটা স্বস্তি বোধ হয়। এ রাস্তায় লোক চলাচল এমনিতেই কম, খানিকটা নির্জনতার ভাব আছে। তাছাড়া অল্প হলেও কিছুটা ভিতরে হবার কারণে গোয়াড়ি বাজারের চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ এত দূর পর্যন্ত আসে না। যদিও হৈচৈ কোলাহল কিংবা সামনে লোকজন থাকলেও নজরুলের লেখায় বিশেষ অসুবিধা হয় না। কলম ধরলে মাথায় কোথা থেকে যেন কিছু না কিছু একটা ভাব এসে পড়ে। তখন আশপাশের পরিবেশ তখন আর মাথায় থাকে না, গভীরভাবে লেখার মধ্যে ঢুকে পড়েন।

- তুমি কি কোথাও বেরোবে নাকি?

প্রমীলা দেবী ধীর পায়ে টেবিলের উপর চায়ের গ্লাসটা রাখলেন।

- ভাবছি হেমন্তদার কাছে যাব একবার। সম্মেলনের জন্য একটা চিঠি লিখে দিয়ে আসি। দু'দিনেই মনে হচ্ছে কতকাল বাহিরে বেরোয়নি!

গ্লাসটা তুলে গরম চায়ে একটা চুমুক দিয়ে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালেন নজরুল। আলতো হাসিমুখে কথাটি বলার ভঙ্গিতে একটা যেন অপরাধের ভাব। স্বামীর চোখে কয়েক মুহূর্ত চোখ রেখে তাকিয়ে রইলেন প্রমীলা দেবী। ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির রেখা টেনে বললেন - দূরে কোথাও যেও না। দুপুরের মধ্যে ফিরে এসো। ডাক্তার কিন্তু বারবার বিশ্রামের কথা বলেছেন।

কথাগুলি বলে আর দাঁড়ালেন না। তেমনি ধীর পায়ে ভেতরে চলে গেলেন। বহির্মুখী বোহেমিয়ান এই মানুষটিকে চেষ্টা করেও ঘরে যে আটকে রাখা যাবে না - তা তিনি এতদিনে বুঝে গিয়েছেন। যথেষ্ট কষ্টের সাথে, যন্ত্রণা আর অভিমানের সাথেই বুঝেছেন, মেনে নিয়েছেন। সব জেনেশুনেই তো এই মানুষটার সাথে নিজের জীবনটাকে জড়িয়ে দিয়েছেন।

দোলনের নিঃশব্দে ভিতরে চলে যাওয়া দেখলেন নজরুল। কর্তৃত্বের এই শাসনটুকু ভালো লাগলো তাঁর। এ সংসারে মাসিমা ছাড়া তাকে কেউ শাসনের সুরে কথা বলে না। স্নেহের অধিকার নিয়ে তাকে কেউ শাসন করুক, বকাঝকা করুক - এরকম একটা কাঙালপনা তার ভেতরে আছে - সেটা তিনি অনুভব করেন। বন্ধুমহলে একজনই মাত্র এই দায়িত্ব নিতেন তিনি মুজফফর আহমদ। কলকাতায় পা দেওয়ার পর থেকে প্রচুর গুণগ্রাহী বন্ধুবান্ধব জুটেছে, কিন্তু অভিভাবক বলতে ঐ একজনই ছিল। তিনি জেলে বন্দি না থাকলে দোলনকে নিয়ে সংসারী জীবনের ধারাটা হয়ত কিছুটা হলেও অন্যখাতে বইত। একথা কথা মনে হতেই ভিতরে একটা খুশির বাতাস বয়ে গেল। মুজফফর আহমদ জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কলকাতাতেই আছেন এবং হ্যারিসন রোডে লাঙল-এর অফিসেই উঠেছেন - হেমন্তদা মারফত সে খবর এসেছে। অল্পদিনের মধ্যেই দেখা হবার সম্ভাবনা - কৃষ্ণনগরে পর পর সম্মেলন আছে। সামনে গফরগাঁও - না, এলোমেলো ভাবনা সরিয়ে কালির দোয়াতটা সামনে টেনে লিখতে বসলেন নজরুল।

'আমার প্রিয় ময়মনসিংহের প্রজা শ্রমিক ভ্রাতৃবৃন্দ' সম্বোধন করে লিখতে শুরু অনেকটাই নিজের বাল্যস্মৃতির কথা লিখে ফেললেন। 'এই ময়মনসিংহ জেলার কাছে আমি অশেষ ঋণে ঋণী। আমার বাল্যকালের অনেকগুলি দিন ইহার বুকে কাটিয়া গিয়াছে' - লিখতে লিখতে দরিরামপুরে স্কুলে যাবার পথের দুধারের সৌন্দর্য, রাঢ়বঙ্গে যেসব দৃশ্য মেলে না, খালবিল জলকাদা মাখামাখি পূর্ববাংলার অপরূপতা ইত্যাদি কথা স্রোতের মতো কলমে চলে আসে। কিন্তু না, এ চিঠি তো কৃষক-শ্রমিককে উজ্জীবিত করার উদ্দেশ্য নিয়েই লেখা। ব্যক্তিগত স্মৃতির কথায় ভারাক্রান্ত করা ঠিক হবে না। 'এই আশা করিয়াছিলাম, আমার সেই শৈশব-চেনা ভূমির পবিত্র মাটি মাথায় লইয়া ধন্য হইব, উদার হৃদয় ময়মনসিংহ জেলাবাসীর প্রাণের পরশমণির স্পর্শে আমার লৌহ-প্রাণকে কাঞ্চনময় করিয়া তুলিব; কিন্তু তাহা হইল, দুরদৃষ্ট আমার' - এইটুকু লিখে ভগ্নস্বাস্থ্যের কথা উল্লেখ করে মূল কথায় চলে গেলেন।

লেখার ভিতরেই 'কাজীদা' বলে প্রমোদের প্রবেশ। নজরুল তাকে ইশারায় বসতে বলে আপন মনে লিখে চললেন। লেখা শেষ করে বললেন - বল মঘা, কী খবর?

- শরীর কেমন তাই খবর নিতে এলাম। হেমন্তদাও বললেন, সম্মেলনের চিঠির খোঁজও নিতে বলেছেন।

নজরুল হেসে উঠলেন, 'আমিও অনুমান করছিলাম। এইমাত্র ওই চিঠিটাই রেডি করলাম। দাদা কি বাড়িতে আছেন? দু'দিন বেরোই নি, ভাল্লাগছে না। চল ঘুরে আসি।'

- ঘুরতে যাবেন? বেশ তো, কোনদিকে যাবেন? হেমন্তদা শান্তিপুর থেকে ফিরেছেন কিছুক্ষণ আগে। কাশেমের গাড়ি এখনো বাঁধা আছে দেখলাম। চলুন একটা চক্কর মেরে আসি।

বাতাসে ঠান্ডা থাকলেও পরিষ্কার আকাশে রোদ ঝলমল করছে। মঘা যেন ঠিক সময়েই চলে এসেছে। পথে বেরিয়ে শরীর ও মন দুটোই বেশ ঝরঝরে হয়ে উঠল নজরুলের।

(ক্রমশ)

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।