বিবিধ

খাল-বিলের আখ্যান (অষ্টম পর্ব) [ধারাবাহিক]



মমতা বিশ্বাস


কৃষ্ণনগর-মাজদিয়া সড়কপথের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম আসাননগর। গ্রামটিকে বেষ্টন করে আছে ঝোরনদী, থগবগের খাল, ছয়টি বিল। জেলা শহরের দিক দিয়ে গেলে গ্রামের শুরুতেই পড়বে থগবগের ব্রিজ। অতীতে জায়গাটি ঠগ দস্যুদের আস্তানা ছিল। বর্ষার সময় ঝোরের জল তোড়ে ব্রিজের নীচ দিয়ে বগবগিয়ে খালে পড়ত। ঠগী দস্যুদের ঠগ আর বগবগিয়ের বগ-মিল হয়ে গেল ঠগবগে। ঠগবগে পরিবর্তিত হয়ে থগবগে হয়েছে। থগবগের পাড়ের উত্তর-পশ্চিম দিকে গড়ে ওঠা পাড়া থগবগিয়া পাড়া নামে পরিচিত। থগবগিয়া পাড়ার বাসিন্দা বিন্দু। বিয়ে হলেও বাবার বাড়িতে থেকে গেছে। বিন্দুর একটা হাত অকেজো। শোনা যায় পরীতে নিয়ে গিয়েছিল। এক হাতই দশ হাত হয়ে উঠেছে। সামলেছে সকল দিক। বর ঘরজামাই ছিল। কয়েক বছর থাকার পর কলকাতাবাসী হয়ে বৌ-ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছে বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে। দুই বোন। বাবা ক্ষুদ্র চাষি ছিলেন। হাঁপানির জন্য কাজকর্ম করতে পারতেন না। ভাই না থাকায় লেখাপড়া শেখার সঙ্গে মাঠ-ঘাটের সব কাজ করতে হয়েছে। কাজ মানে কাজ - ছেলে-মেয়ে হিসেবে নয়; অর্থাৎ মাঠ-বাজার ঘাটের সব কাজে পোক্ত হতে হয়েছে। পাকা রাস্তার পাশে বাড়ি। বাড়ির ধ্বজে আপার (ছোটো পুকুর) পাশে থকবগের খাল। আপা ছোট্টো হলেও তাদের সংসারের ভার কিছুটা বহন করে। দেশি মাছের জোগান, ধানচাষের সেচের জল, মাছ বিক্রির টাকায় হাটবাজার ইত্যাদি ইত্যাদি। উষ্ণ শরীরের ও মনের তাপ জুড়ায় আপার জলে অবগাহন করে বা নিরিবিলিতে তার পাশে বসে অশান্ত মনকে শান্ত করে। পায়ের পাতা ডুবিয়ে পা নাচিয়ে তার দুঃখ-কষ্টের ভার খানিকটা হাল্কা করে নেয় মাঝেমধ্যে। জলে পা স্থির করে রাখলে শোল, ল্যাঠা, পুঁটি ঠোকরায়। ছোটো মাছের ঠোকরানিতে পায়ে সুড়সুড়ি লাগে। কয়েকটি বর্শি ফেলা থাকে। চোখ সেদিকে নিবদ্ধ। ফাতনা জলে ডুবতেই লাঠির হাতল ধরে এক ঝটকায় টান দেয়। পাড়ে নিয়ে এসে বর্শি থেকে মাছ ছাড়িয়ে বালতিতে রাখে। ডেয়ো পিঁপড়ের ডিম ছিপে লাগিয়ে জলে ফেলে অন্যগুলোর দিকে নজর দেয়। চালাক মাছ আলগোছে খাবার খেয়ে চলে যায়, ধরা দেয় না। মাছের পছন্দ কেঁচো বা আটার চার।

বর্ষার সময় আপাকে আলাদা করে বোঝার কোনো উপায় থাকত না। জলে একাকার হয়ে যেত। আপার পাশ দিয়ে ওদের কিছু জমি ছিল। জল শুকিয়ে গেলে দুই বোন লাঙলের চাষ হয়ে যাওয়ার পর কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে জমি ঠিক করেছে। বিদে, মই হাতে টেনে কাদা করে বোরোধান চাষ করেছে। থালায় করে আপা বা খাল থেকে জল সেচে ধানচাষ করেছে। টিউবওয়েল চেপে ধানের জমিতে জল দিয়েছে। ঘোড়াপীরতলার মাঠের ও বা৺শবেড়িয়া মাঠের জমি লাঙলে চাষ দেওয়ার পর আল কোদাল দিয়ে কুপিয়ে ঠিক করেছে। গম, ধান, ছোলা, মটর, মুসুরি, সর্ষের ফলন মন্দ হত না। ফসল উঠলে কাকালিতে বা মাথায় করে বাড়ি নিয়ে এসেছে। কাজকে কাজ হিসাবে দেখেছে। লজ্জার লাজুকলতা কখনও ছিল না। ধান-গম ঝাড়ায়-মাড়ায় নিজেদের। চৈত্র-বৈশাখে খালের মাটি ঝুড়ি বোঝায় করে বাড়ির পাড় বেঁধেছে সবাই মিলে। এখন হ্যাণ্ড ট্রাক্টর হওয়ায় এবং আইসিডিএস কর্মী হওয়ায় কঠোর পরিশ্রম এখন আর করতে হয় না। বয়স ষাট ছুঁতে চলল। তিন ছেলে-মেয়ে উচ্চশিক্ষিত।

থগবগের গল্প বিন্দু তার ঠাকুরমা এবং প্রবীন লোকেদের মুখে শুনেছে। সন্ধ্যেবেলায় পাটিতে শুয়ে ঠাকুরমার গলা জড়িয়ে ধরে কত গল্প যে শুনেছে তার ইয়ত্তা নেই। থগবগে ও ঝোর পঞ্চাশ বছর আগে কেমন ছিল, কথার ছবি দিয়ে সাজানো তার। ঝোরের ধারে কাশীপুর পাড়ায় দর্গাতলার ওখানে বিশাল বট গাছের তলায় ষষ্ঠীপুজো, নীল পুজো হত। পয়লা বৈশাখে মেলা বসত। মেলা থেকে রান্নাবাটির খেলনা কিনত ছোট্ট মেয়েরা। সবাই কী আর কিনতে পারত? না। খেটে খাওয়ার মানুষের সংখ্যায় যে বেশি ছিল। দুআনা, চার আনার জিনিস - তাও মহার্ঘ ছিল। কজনই বা জোটাতে পারত! বট-পাকুড় গাছ কিছুই নেই। জায়গাটায় ঈদগা হয়েছে। মালিতাপাড়ার মুসলিমরা নামাজ পড়তে আসে। বিন্দু ছোটোবেলায় রাত্রে ভুলেও তাকাত না ওদিকে। গল্প শুনেছে এক সাহেব নিশুতি রাতে ঘোড়া টগবগিয়ে ঝোরের এপার-ওপার করত জলের উপর দিয়ে। সাওয়ারি মস্তকহীন। সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য কল্পনা করলে ছোটো কেন; বড়োদের হাড় হিম হয়ে যেত। কাশিপুর পাড়ার শেষে ঝোরের ধার দিয়ে বিরাট তিনটে পাকুড় গাছ ছিল। সন্ধ্যের পর আলো জ্বলত আর নিভতো। ভয়ে সন্ধ্যের পরে ওদিক কেউ মাড়াত না। বিন্দু, বাঁশবেড়িয়ার মাঠ থেকে ফিরতে সন্ধ্যে লেগে গেলে ঐ ফাঁকা জায়গায় এসে চোখ বন্ধ করে এক দৌঁড়ে পাঁকা রাস্তায় উঠেছে। 'আলেয়' (আলেয়া) ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে ঘাড় মটকিয়ে দেবে সেই ভয়ে।

থগবগের খালের উৎস স্থানটির গুরুত্ব অতীতেও ছিল, এখনও আছে। অপ্রশস্থ রাস্তার দুই ধারে ঝোপ জঙ্গল। লুকিয়ে থাকত ঠগী দস্যুরা। এই রাস্তাটিই ছিল অবিভক্ত বঙ্গদেশের মানুষদের পায়ে হেঁটে নবদ্বীপে গঙ্গাস্নানে যাওয়া বা মৃতদেহ দাহ করার জন্য অন্যতম একটি রাস্তা। চোর-ডাকাতের খুব উৎপাত ছিল। ঠগী দস্যুরা বা ফাঁসুড়ে ডাকাতরা পথচারী,তীর্থযাত্রী বা শবদাহ করার দলকে রেয়াত করত না। মেরে ধরে কেড়েকুড়ে সব নিয়ে নিত। প্রয়োজনে মানুষ মেরে ফেলতেও দ্বিধা বোধ করত না। থগবগে শুধু ঠগীদস্যুদের আস্তানা ছিল তা নয়, ছিল মহাশ্মশান। বিন্দুদের পুকুর কাটার সময় মাটির স্তরে স্তরে পাটি জড়ানো কঙ্কাল, কাজললতা, মাথার খুলি বেরিয়ে এসেছে। ২০১৪ সালে পুকুর সংস্কারের সময় একটি বিশাল আকৃতির দাঁতসহ মাথার খুলি উঠে আসে। খুলিতে কোপের অস্পষ্ট দাগ ছিল। আগেরবার সংস্কারের সময় রুপোর গহনা পেয়েছিল কিছু।

নিত্যপ্রয়োজনী জিনিপপত্র, চাল, আটা, কয়লা, তেলের টিন, সিমেণ্ট, চিনির বস্তা ইত্যাদি ট্রাক থেকে থকবগেই নামত; তারপর নৌকায় করে চলে যেত বিভিন্ন গ্রামে। আবার সেই সকল গ্রামে উৎপাদিত ফসলাদি নৌকা বোঝায় হয়ে থগবগের খালে এসে নামত। নৌকায় জিনিসপত্র ওঠানো-নামানোর সুবিধার জন্য ঝোরের জলের তোড় থাকায় নৌকা ব্রিজের নীচ দিয়ে থগবগের খালের পাড়ের গাছে দড়া দিয়ে বেঁধে মালপত্র ওঠানো-নামানো করত। একবার থগবগের মাঝে নৌকা ডুবি হয়েছিল। নৌকা যদিও তিন মানুষের বেড় ধরা পাকা রাস্তার পাশের নিম গাছে বাঁধা ছিল দড়া দিয়ে। নৌকায় বোঝায় ছিল তেলের টিন, সিমেণ্ট, চিনি আরো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। নিম গাছে বাঁধা দড়া ছিঁড়ে যাওয়ায় নৌকা ডুবি। তেলের টিন ভেসে গেছিল। চিনি জলে গুলে যায়। জল শুকিয়ে গেলে দেখা গেল বস্তায় সিমেণ্ট জমাট বেঁধে আছে। ১৯৪৬ সাল থেকে থগবগের দুই পারে এক/দুই ঘর মানুষ বসত করতে শুরু করে। পায়রাডাঙা পাড়ার পশ্চিমদিকে প্রথম বাংলাদেশের যশোর জেলার পায়রাডাঙা চকের সনাতন বিশ্বাসের বংশধরেরা বসবাস করতে শুরু করে। তারপর দুই এক ঘর করে বসতে বসতে পাড়া জমজমাট হয়ে ওঠে। সেই সময় শিশু মৃত্যুর হার অত্যধিক ছিল। মৃতদেহগুলি খালের পশ্চিমে পুঁতে দিত। আর রাখত তেমাথা ছেড়ে এসে পতিত জমিতে। যেখানে ধরনী গোঁসাই এর বৈষ্ণব আখড়া গড়ে ওঠে। গোঁসাই এর গানে মুগ্ধ হয়ে পাড়ার মাতব্বররা ঝোপ-জঙ্গল কেটে আশ্রম গড়ে তোলায় হাত লাগায়।

বর্ষার সময় ১৫/২০ ফুট জল হত ব্রিজের মুখে। দল বেঁধে ভেসে আসত বোয়াল মাছ। বিশাল বিশাল আড় মাছ। বোয়াল মাছ সার বেঁধে চলাচল করে। এক বোয়াল আর এক বোয়ালের লেজ কামড়ে থাকে। পলো চাপা দিয়ে ওইসব মাছ ধরত। মাছ ও নেই, পলোর ব্যবহার ও নেই। বিন্দুদের পাশের বাড়ি ছিল রেডিও শিল্পী কমলার বাবার বাড়ি। ওনার মা অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন; কিন্তু কানটি গেছিল বাঘের পেটে। বন্য প্রাণীর আক্রমণের কত গল্প ছড়িয়ে রয়েছে থকবগের দুই পাড়ের পাড়ায়। টিনের ছাপড়ার বারান্দায় শুয়ে ছিলেন বড়োবাড়ির বুড়িমা। শিয়ালে কামড়ে ছিল। কৃষ্ণনগরের খ্রিস্টানদের হাসপাতালে এসে নাভির চারপাশে চৌদ্দটা ইনজেকশন নিতে হয়েছিল। ছোটো শিশু বারান্দায় শোয়ানো আছে। সন্ধ্যেবেলায় পাওয়া যাচ্ছে না। খোঁজ পড়তেই দেখা গেল ঘরের পিছনে শেয়াল মুখ থেকে নামিয়ে রেখে, বাচ্চাটির হাত-পা নাড়া দেখছে। শেয়ালের কামড়ের দাগ থেকে গেল, জন্মদাগের মতো।

ঝোর ও থগবগের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষের পেশা ছিল চাষ আর মাছ ধরা। চাষের কাজের অবসরে মাছ ধরার যন্ত্র তৈরি করত তালের ডাটার আঁশ, লতা আর বাঁশের চটার শলা দিয়ে। মেয়েরা পাট দিয়ে বুনত হরেক রকমের ছিঁকে। পাড়ের সুতো দিয়ে সেলাই করত কাঁথা। মেয়েরা আসন সেলাই,পার্টি বোনা, কাঁটা-ক্রশে উলের জিনিস। বারোমাসে বিভিন্ন ব্রত যেমন ভগবতী পুজো, পুণ্যিপুকুর ব্রত, বৃষ্টি না হলে ব্যাঙের বিয়ে, অক্ষয় তৃতীয়া, বট ষষ্ঠী, মনসা পুজো, বিশ্বকর্মা পুজো, গার্সি, মুলো ষষ্ঠী, পৌষ-পার্বন, ভিটে কুমারী পুজো। বেশির ভাগ ব্রত গল্পকথা। ধীরে ধীরে অনেক পুজো-পাঠ বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে নতুন কিছু সংযোজন হয়েছে।

১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্থানের মুক্তি যুদ্ধের সময় থকবগের ব্রিজের একটা বিরাট ভূমিকা ছিল। ভারতীয় মিলিটারিরা থকবগের ব্রিজের ওখান থেকে নৌকায় করে জলপথে বঙ্গদেশে যাতায়ত করত। শরণার্থীরা থগবগের মাছে অর্ধেক পেট ভরিয়েছে। চাঁদপুর, রামপুর, গোবিন্দপুর, কৃষ্ণপুর, মথুরাপুর, বাঘমারা, সিমলে, নারায়ণপুর, গাটরা, আমঝুপি মোটকথা পলদা, ঝোর ও কলিঙ্গ নদীর দুই তীরে অবস্থিত গ্রামের মানুষের জেলা শহর, উচ্চশিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা-বানিজ্য এবং কৃষিজাত দ্রব্য বিক্রির যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিল থগবগে। নৌকা বোঝায় পাট, উৎপাদিত অন্যান্য ফসল ব্রিজের উত্তর-পশ্চিমে বা পূর্ব-পশ্চিমে নামতো। আসাননগরের পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর দিকের অসংখ্য খাল-বিল, নদীর জল নেমে আসে এই খালে। থকবগে খালের জল প্রথমে পড়ে দুবলোর বিলে, তারপর ঠনঠনের বিলে। ঠনঠনের বিল থেকে সোতার মাঠ হয়ে কৈমারির বিল, তারপর দোবিলে। দোবিল থেকে রতির বিল এবং উসকুমরীর বিল দিয়ে তারিণীপুরের দু'পাশ দিয়ে গিয়ে ভৈরবের খাল হয়ে চূর্ণীতে পড়ে।

(ক্রমশ)

আলোকচিত্রঃ লেখিকার কাছ থেকে প্রাপ্ত।