বিবিধ

শত শতাব্দীর জাদুবিদ্যা (পঞ্চম পর্ব)



জাদুকর শ্যামল কুমার


পুরাকালের জাদুবিদ্যার পুস্তকগুলি থেকে এবং সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে পাহাড়ের গায়ে খোদাইকার্য ও নকশা কাটার নমুনাগুলি দেখে, সাধারণ জাদুকররা সেইসময় ম্যাজিক শিখতেন এবং দেখাতেন।


১৮২১ খ্রিস্টাব্দে রোমে কাপ ও বলের খেলা দেখাচ্ছেন জনৈক জাদুকর। জাদুকর যে আপ্রনের মতো পোশাকটি পরেছেন, সেটিকেই গিবেসিয়ার (Gibeciere) বলা হচ্ছে।

সাধারণতঃ জাদুকরগণ খোলা জায়গায় তাদের কলাকৌশল দেখাতেন। সেখানে রাস্তার উপর ভাঁজকরা টেবিল পেতে বা গ্রাম্য মাঠে তাঁদের খেলা দেখাতেন। তাহাদের কর্মকুশলতার মধ্যে প্রধান ছিল বাটি ও গুটির খেলা (Cups & Balls) এবং তাসের খেলা। এই সকল জাদুকরদের বিশিষ্টতা ছিল আলখাল্লা ধরনের পোষাক। যার সন্মুখভাগে বৃহদাকার পকেট ছিল। এইগুলিকে গিবেসিয়ার (Gibeciere) বলে। এই আলগা পোশাকটি ব্যবহার করা হতো, বল, তাস এবং অন্যান্য ছোটখাটো যন্ত্রপাতি রাখার জন্য। গিবেসিয়ার (Gibeciere)-এর সাহায্যে জাদুকরেরা অপরের অজ্ঞাতে Palmed ball বা অন্যান্য জিনিস ফেলে দিত। এইসব জাদুকরের মধ্যে ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে একজনের চিত্র নকশা কেটে তৈরি করা হয়েছিল যাঁর নাম IL Giocatore di Bussolotti in Roma (The Cups & Balls player in Rome)।

পথে দেখা যায় এমন জাদুকরদের মধ্যে কেউ কেউ ভাগ্য গণনা করতেন। তারা এই কাজের জন্য নিয়মিত পারিশ্রমিক ধার্য্য করতেন। কিন্তু রাস্তায় খেলা দেখানোর জন্য তারা কেবলমাত্র টুপি পেতে পারিশ্রমিক নিতেন। সময়ে সময়ে তাদেরকে বাড়ীতে বা প্রাসাদে আহ্বান করা হতো ভাগ্য গণনার জন্য এবং ম্যাজিক দেখানোর জন্য। এদেরকে খুব সমাদর করা হতো। এইরূপ একটি দৃশ্য সুচারুরূপে খোদাইকার্যর মাধ্যমে দেখান হয়েছে যাকে বলা হয় L' Escamoteur (The Conjurer)। বিশ্বাস করা হয় এই খোদাইকার্য ফিলিপ মার্সিয়ার (Philippe Mercier) নামে একজন ফরাসি শিল্পী করেছিলেন ১৬৮৯-১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে। ছবিতে জাদুকরের কালো মুখমন্ডল দেখে মনে হয় কোনো জিপসি অথবা তার কালো মুখমন্ডল দেখে মনে হয় কোনো এক অলৌকিক জাতির প্রতিচ্ছবি। তাঁকে বিপুল সম্মান প্রদর্শন করা হয় ভাগ্য গণনাকারী রূপে। এর কয়েক বছর আগে জন ম্যুলহল্যান্ড (John Mulholland) তাঁর 'The Sphinx' পুস্তকটি প্রকাশিত করেন। এই পুস্তকে নিম্নলিখিত শ্লোকগুলি পাওয়া যায় ইংরাজী অক্ষরের খোদাইতে।

এটা বাংলা করলে এইরকম দাঁড়ায় -

"কাপ আর বল দিয়ে বাজিকর খেলে
এখানে ওখানে ঘুরে পালাবদল করে
তাস তার কথা শোনে হয়ে লক্ষ্মী
তারা তার তুড়িতে হয়ে যায় পক্ষী
তার ছোট বাক্সগুলি বদলে দেয় শস্য
কৌশল আর কৌশলে প্রতারণা করে অবশ্য
তার ছোট ব্যাগ নাড়ে, সে দেখায় সব সুষ্ঠু
আঙুলগুলি ছড়িয়ে দেখায় নাই কোন বস্তু
তারপর ডাকে বৃষ্টিকে, সোনা বর্ষায়
তার হাতির-দাঁতের ডিমগুলি দুলিয়ে চলায়
কিন্তু তা থেকে যখন মুরগী বেরোয়
বিস্মিত দর্শকেরা হাততালি দেয়।"


১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের কিছু আগে লন্ডনে ইংরেজ জাদুকর জিনগেল (Gyngell) মেলায় ম্যাজিক দেখাচ্ছেন।

মেলা এবং ভ্রাম্যমাণ আনন্দমেলায় প্রদর্শনকারীরা প্রায়শই চার চাকার বড় গাড়িতে (মালটানা গাড়ি) ভ্রমণ করতেন। এই গাড়ির শেষপ্রান্তে একটি মঞ্চ তৈরী করে অথবা পুরোনো পায়াযুক্ত সোজা একখণ্ড কাঠের ফ্রেম, কাঠের তক্তা এবং লম্বা কাঠের পোল (Pole) যার উপর ত্রিপলের আস্তরণ দিয়ে ঢেকে তার মধ্যে খেলা দেখাতেন। উনিশ শতকের এইরূপ একটি গাড়ী যা ওপরে খোদাই ছবিতে দেখান হয়েছে। প্রদর্শনকারী একটি মনোরম পোষাক পরিহিত এবং একটি পৈশাচিক দৃশ্য গোঁফ ও ছাগল দাড়ি দিয়ে নিজেকে সপ্রতিভ করে তুলতে প্রচেষ্ট যা আজকের দিনে কোনো কোনো জাদুকর করে থাকেন। যারা এই দৃশ্য উপভোগ করে তাদের অধিকাংশই শিশু।

সাধারণতঃ এইসব ভবঘুরে জাদুকররা সরল জীবন-যাপন করতেন তাদের টুপি দ্বারা উপার্জনের অর্থে। কিন্তু আইজ্যাক ফকস (Isaac Fawkes) নামক সেই সময়কার একজন ব্রিটিশ অবস্থাপন্ন জাদুকরের একটি নিজস্ব জায়গা ছিল এবং তিনি সেখানেই প্রদর্শনী করতেন। এখানে প্রবেশের জন্য তিনি মূল্য ধার্য করেছিলেন। ১৭৩১ খ্রিস্টাব্দে, ফকস (Fawkes) একজন বিত্তশালী জাদুকর হিসাবে মারা যান। মৃত্যুকালে তিনি ১০,০০০ পাউন্ড রেখে গিয়েছিলেন।

(ক্রমশ)

চিত্রঃ লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে প্রাপ্ত।