বিবিধ

উদ্ভট মিশন



চন্দন সরকার


তখনও আমি আমসত্ত্ব চাখিনি। এমনকি চোখেও দেখিনি। সেবার খুব বায়না করার পর বাবা আমসত্ত্ব এনে দেওয়ায় আমি প্যাকেটটা না খুলেই সোজা রান্নাঘরে। মায়ের হাতে দিয়ে বললুম - ভেজে দাওনা মা। মা প্যাকেটটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে নিয়ে চোখ-নাক ভীষণ কুঁচকে বলল, আমসত্ব? ভাজা? সেটা কি হবে?

- বাবা তো দারুন ছবির ফ্রেম বানায়, বাঁধিয়ে রাখবো।

- তবে রে...

মা তো গরম খুন্তি নিয়ে তেড়ে আসে। উঠোন পেরিয়ে বাথরুম যাচ্ছিল খালি গায়ে লুঙ্গি পরা গামছা কাঁধে খড়ম পায়ে বাবা। হেসে উঠল হো-হো!

- বকছ কেন? বুঝছো না তোমার ছেলে...

ডানপিটে হলেও ছিলুম না অমন ছেলে, যারা কপাকপ মাছি ধরে গপাগপ গেলে। মগজে কিলবিল করত নানারকম পোকামাকড়। তাঁদের আরও চাগিয়ে দিয়েছিল এক বই, যা আসলে ল্যাবোরেটরি, এক্সপেরিমেন্টের ভান্ডার।

রোগাভোগা ছিলুম। সর্দি-হাঁচি লেগেই থাকত। কিন্তু ডিগবাজি খেতে পারতুম না। সর্দি হলেই ডিগবাজি খেতে গিয়ে কতবার মাটিতে ধড়াম আর মাথায় আলু। পাশের বাড়ির রাজার ছিল কাঠের ব্যাট। বাবার সাধের বাগান থেকে ছোট একটা কুমড়ো তুলে এনে আমাদের ক্রিকেট খেলা চলত, যদিও রাজার পিসি-টিসিকে ডাকার সাহস হয়নি। তবে রান্নাঘর থেকে পাউরুটি চুরি করে তাতে ঝোলাগুড় মেখে খাওয়ার আগে পেরেক ঠুকতে গিয়ে মায়ের কানমলা খেয়েছি। বাবা একটু প্রশ্রয় দিত। তার ইজি চেয়ারে খালি বোতল শিশি ঝুলিয়ে রাখলে হেসেই বলত, বেশি বাড়াবাড়ি কোরোনা। তবে যেবার বাবার বন্ধুর টাকে ডাক টিকিট সাঁটতে গেলুম, জোর বকুনি খেলুম। আর বাবার হাতঘড়ি (ট্যাঁক ঘড়ি ছিলনা) ঘিয়ে ডুবিয়ে রাখায় বাবার লাল চোখ আর গম্ভীর মুখ দেখে থরথরিয়ে প্যান্ট ভিজে গেল। এরপর শিরিষ কাগজ দিয়ে বিছানা পাতার ইচ্ছেটাকে চেপে রাখা ছাড়া উপায় কী ছিল?

বাড়ির বিড়াল আর পাড়ার কুকুরদের ভাগ্য ভালো ছিল যে তারা হাঁসজারুদের লিস্টিতে ছিলনা। থাকলে কি যে অনর্থ হতো...

ডাকনাম ছিল বুড়ো। দাড়ি ছিলনা, কিন্তু হাঁড়ি ছিল ঘরে। আগুন জ্বালিয়ে কতবার বন্ধুরা মিলে খেয়েছি আলুপোড়া। আর কাঠ ভিজিয়ে সেই কাঠ জলে ভিজিয়ে সেদ্ধ করে রোদে বসে খেয়েছি একা একা। কোন ফুটো খেতে ভালো, কোনটা বা মন্দ সেসব লিখে রেখেছি খাতায়।

ভীষ্মলোচন শর্মা হতে পারিনি, কেননা গলায় তেমন জোর ছিলনা। তবে পাড়ার এক খুড়োর সাকরেদ হয়ে ‘কল’টি বানিয়ে ফেলেছিলুম। ঘাড়ের সঙ্গে যন্ত্র জুড়ে পাড়াময় ঘুরতে বেরিয়ে ছিলুম। কিন্তু সারমেয়গুলো পিছন পিছন ছুটে এমন চিল্লামিল্লি জুড়ে দিল!

"কেউ জানেনি এসব কথা কেউ বোঝেনি কিছু/ কেউ ঘোরেনি আমার মতো ছায়ার পিছু পিছু।" আর এর জন্য গরমের ছুটির দুপুরগুলোই ছিল বেস্ট টাইম, যখন সবাই ঘুমিয়ে। ঝুড়ি নিয়ে বাগানেই যেতুম ছায়া ধরার জন্য।

বাবার স্বপ্ন ছিল ছোট ছেলে ডাক্তার হবে। বড় হয়ে সেই স্বপ্নকে বিশ বাঁও জলে ফেলে দেয় ছোট ছেলে। তবে ডাক্তারি কেরামত দেখাতে সে ভোলেনি। সব পুতুলই তার রুগী। তাদের ওপরই চলত দেদার অপারেশন।

জ্যাঠা ছেলে ছিলুম, কিন্তু বিড়ি খেতুম না। বাবা খেত তো, গন্ধটা খুব খারাপ লাগত। তবে স্কুলে শ্যামাদাস নতুন ছেলেটিকে গজাল মেরে গোজাবার বেদম চেষ্টা করেছিলুম, বিফল হই। ফুটোস্কোপ দিয়ে মগজের ফুটোটা দেখার ইচ্ছেও পূর্ণ হয়নি।

এরপর সেই ভয়ঙ্কর রাত, তার জন্য দায়ী তিনটি লাইনঃ
"নিঝুম নিশুতি রাতে/ একা শুয়ে তেতলাতে/ খালি খালি খিদে কেন পায়রে?"

আমাদের তো একটাই তলা, তেতলা কোথায় পাবো? কুছ পরোয়া নেই, উঠোন তো আছে। এক নিঝুম নিশুতি রাতে, খোলা আকাশের নীচে, শীতলপাটিতে আমি একা। মাথার নিচে বালিশ, দৃষ্টি আকাশমুখো, বাম হাঁটুতে ডান ঠ্যাং। পেট গুড়গুড়। খিদেতে নয়। খিদে, ঘুম সবই তো লোপাট। শুধু ভয়। চারপাশে ফিসফিস! শিউলি গাছে ওগুলো কাদের মাথা? কোনোওরকমে আঁ-আঁ চিৎকার। তাতেই ছুটে আসে ঘরের লোক।

ব্যাস! সেই আমার উদ্ভট মিশনের সমাপ্তি।

আগাগোড়া মিথ্যে এই 'উদ্ভট মিশন'কে এনজয় করতে হলে পাঠককে অবশ্যই পড়তে হবে - সুকুমার সমগ্র, বিশেষ করে আবোল-তাবোল, যে বই-এর গোড়ায় স্বয়ং স্রষ্টা লিখেছিলেন -
“যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব, তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার। ইহা খেয়ালরসের বই। সুতরাং সে রস যাঁহারা উপভোগ করিতে পারেন না, এ পুস্তক তাঁহাদের জন্য নহে”।

আবোল-তাবোল-এর শতবর্ষে তার স্রষ্টা, বাংলার শ্রেষ্ঠ হাস্যরসের কবি ও শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায়-কে শতকোটি প্রণাম।

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।