ষোল বছরের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যময় দাম্পত্য জীবন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মনোজীবনকে সমৃদ্ধ করেছিল। অপূর্ব প্রেমের কবিতাগুলি তাই তাঁর লেখনীতে বেরিয়ে এসেছিল সুললিত ভাষায় ও ব্যঞ্জনায়।
দীর্ঘসময় স্বামীর জন্য অপরাহ্ন পর্যন্ত না খেয়ে অপেক্ষা করতে দেখে স্ত্রীকে শুধানোর পর যে উত্তর পেয়েছিলেন তা দিয়ে রচনা করলেনঃ
"আমি, সারা সকালটি বসে বসে,
এই সাধের মালাটি গেঁথেছি।
আমি পরাব বলিয়ে তোমারই গলায়,
মালাটি আমার গেঁথেছি।"...
আর সবকিছু ছাড়িয়ে যে গানটি আপামর প্রেমিক-প্রেমিকাকে অনন্ত সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে সেও তার স্ত্রীর প্রেমের জন্য -
"আমরা - মলয় বাতাসে ভেসে যাবো
শুধু কুসুমের মধু করিব পান,
ঘুমাবো কেতকী সুবাস শয়নে
চাঁদের কিরনে করিব স্নান।"
স্ত্রী সুরবালার সঙ্গে যুগল-ছবি।
সৃষ্টি সাফল্যের চরম মুহুর্তে এল নিদারুণ আঘাত। একটি মৃত কন্যাসন্তান প্রসবের সাথে স্ত্রী সুরবালার মৃত্যু সংবাদ। (২৯শে নভেম্বর, ১৯০৩)
তিনি জীবিত অবস্থায় স্ত্রীকে আর দেখতে পাননি তখন সরকারি কাজে ছিলেন মফঃস্বলে।
তার স্ত্রীবিয়োগ ও বাৎসল্যরসের কবিতাগুলি বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করেছে।
"এই তো ছিল দেবীমূর্তি; আলাপ, বিলাপ, হাস্য, রোদন,
করছিল তো কাছে,
কোথায় গেল? ফিরিয়ে দাও হে বিশ্বপতি! দাবী করছি
বল কোথায় আছে?"...
সেই প্রেমিক মানুষটি যিনি লিখেছিলেন -
"সন্ধ্যার মেঘে করিব দুকূল, ইন্দ্রধনুরে চন্দ্রহার
তারায় করিব কর্ণের দুল
জড়াব গায়েতে অন্ধকার।"
তিনি বন্ধুবান্ধবদের সাহচর্যে দুঃসহ ব্যথা ভুলে থাকতে চাইতেন। তাঁর বাড়ীতে অনেক গুণী, সংগীতজ্ঞ ও সাহিত্য রসিক যাতায়াত করতেন।
পুত্র দিলীপকুমার ও কন্যা মায়ার সঙ্গে দ্বিজেন্দ্রলাল।
তাঁদের সাথে আলোচনা করে ১৯০৫ সালের দোল পূর্ণিমার দিন 'পূর্ণিমা মিলন' নামে এক সম্মেলনের প্রতিষ্ঠা করেন।
এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় নিয়ে দেবকুমার রায়চৌধুরীকে চিঠিতে লিখলেন -
"এক নূতন খেয়াল মাথায় আসিয়াছে। ...ইচ্ছা করিয়াছি দেশশুদ্ধ সাহিত্যসেবী ও সাহিত্য অনুরাগীদের একত্র করিয়া, এক এক স্থানে এক একবার প্রতি 'পূর্ণিমা' উপলক্ষ্যে 'মিলন' করা যাইবে। ইহাতে কলিকাতাস্থ সমুদয় সাহিত্যিকদের মধ্যে অবারিতভাবে মেলামেশা, ভাব বিনিময়, প্রীতিবর্ধন ও পরিচয়াদি হবে।..."
দ্বিজেন্দ্রলালের ৫নং সুকিয়া স্ট্রীটের বাসভবনে 'পূর্ণিমা মিলন'-এর প্রথম অধিবেশন বসে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং উপস্থিত হয়ে তাঁর স্বরচিত গান গেয়ে সকলকে মুগ্ধ করেন।
ললিতচন্দ্র মিত্রের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় অধিবেশন। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের 'পুরাতন ভৃত্য' কবিতাটি আবৃত্তি করেন।
ডাক্তার কৈলাশ বসুর বাড়িতে তৃতীয় অধিবেশনে দ্বিজেন্দ্রলাল "এটা নয় বলার ভোজের নিমন্ত্রণ" গানটি রচনা করে সবাইকে গেয়ে শোনান।
ঐ অধিবেশনে নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র 'মেঘনাদবধ কাব্য' থেকে 'সীতা ও সরমার কথোপকথন' অংশটি আবৃত্তি করে শোনান।
* * * *
ষষ্ঠ অধিবেশনে বিচারপতি সারদাচরণ মিত্রের বাড়িতে কান্তকবি রজনীকান্ত সেন স্বরচিত গান গেয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেন। ঐ অধিবেশনে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুরোধে দ্বিজেন্দ্রলাল "সাধে কি বাবা বলি" গানটি গেয়েছিলেন।
এছাড়াও ঔপন্যাসিক দামোদর মুখোপাধ্যায়, রসরাজ অমৃতলাল বসু, শ্যালক ডাঃ জিতেন্দ্রনাথ মজুমদার, ব্যোমকেশ মুস্তাফী, কবি প্রমথনাথ রায়চৌধুরীর বাড়িতে 'পূর্ণিমা মিলন'-র অধিবেশন হয়েছে।
দু'বছর ধরে নিয়মিত অনুষ্ঠান হওয়ার পর দ্বিজেন্দ্রলাল খুলনা বদলি হলে অধিবেশন ক্রমশঃ অনিময়িত হয়ে পড়ে। শেষে একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। 'পূর্ণিমা মিলন' স্বল্পায়ু হলেও একে কেন্দ্র করে তৎকালীন শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালির তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল।
'পূর্ণিমা মিলন'-এর পাশাপাশি দ্বিজেন্দ্রলাল 'ইভনিং ক্লাব'-এর সাথেও যুক্ত ছিলেন। হরিদাস চট্টোপাধ্যায় ও প্রমথনাথ ভট্টাচার্যের অনুরোধে এই সংস্থার সভাপতি হতে রাজি হয়েছিলেন। ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের 'নন্দকুমার', বঙ্কিমচন্দ্রের 'বিষবৃক্ষ' দ্বিজেন্দ্রলালের 'চন্দ্রগুপ্ত' নাটক ক্লাবের সভ্যরা প্রকাশ্য রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করেন। 'সীতা' নাটকে দ্বিজেন্দ্রলাল বাল্মীকির চরিত্রে অভিনয় করেন।
পরিতাপের বিষয় এই ক্লাবটি তাঁর মৃত্যুর পর উঠে যায়।
দুঃখকে ভুলে যেতে 'পূর্ণিমা মিলন'কে আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন, মজা করে তাকে নিয়ে গান রচনা করেছিলেন -
"এটা নয় ফলার ভোজের নিমন্ত্রণ।
শুধু, আছে কিছু জলযোগ
আর চায়ের মাত্র আয়োজন।...
- শুনুন, এটা হচ্ছে সাহিত্যিকী
পৌর্ণমাসী সম্মিলন,
- দোহাই, ধর্বেন না কেউ হ'ল
একটু অশুদ্ধ আজ ব্যাকরণ।"
সেই প্রেমিক মানুষটি পৃথিবী থেকে এবং 'পূর্ণিমা মিলন' থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন প্রিয়তমার কাছে যিনি সারা সকালটি জুড়ে মালা গেঁথে বসে আছেন শুধু তাঁর জন্য।
চিত্রঋণঃ ১) অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত, ২) সমন্বয় আর্কাইভ।