অসীম ও জগৎ
মনে করো একটি বৃহৎ দৈর্ঘ্য স্থির হয়ে রয়েছে, ছোট মাপকাঠি কী করে সেই দৈর্ঘ্যের বৃহত্ত্বকে প্রকাশ করে। না, ক্রমাগতই সেই স্তব্ধ দৈর্ঘ্যের পাশে পাশে চঞ্চল হয়ে অগ্রসর হতে থাকে। সে প্রত্যেকবার অগ্রসর হয়ে বলে, না, এখনো শেষ হলো না। সে যদি চুপ করে পড়ে থাকত তাহলে বৃহত্ত্বের সঙ্গে কেবলমাত্র নিজের বৈপরীত্যটুকুই জানত, কিন্তু সে নাকি চলেছে, এই চলার দ্বারা বৃহত্ত্বকে পদে পদে উপলব্ধি করে চলেছে। এই চলার দ্বারা মাপকাঠি ক্ষুদ্র হয়েও বৃহত্ত্বকে প্রচার করছে। এইরূপে ক্ষুদ্রে বৃহতে বৈপরীত্যের মধ্যে যেখানে একটা সামঞ্জস্য ঘটছে সেইখানেই ক্ষুদ্রের দ্বারা বৃহতের প্রকাশ হচ্ছে।
জগৎও তেমনি সীমাবদ্ধভাবে কেবল স্থির নিশ্চল নয় - তার মধ্যে নিরন্তর একটি অভিব্যক্তি আছে, একটি গতি আছে। রূপ হতে রূপান্তরে চলতে চলতে সে ক্রমাগত বলছে, "আমার সীমা দ্বারা তাঁর প্রকাশকে শেষ করতে পারলুম না।" এইরূপে রূপের দ্বারা জগৎ সীমাবদ্ধ হয়ে গতির দ্বারা অসীমকে প্রকাশ করছে। রূপের সীমাটি না থাকলে তার গতিও থাকতে পারত না, তার গতি না থাকলে অসীম তো অব্যক্ত হয়েই থাকতেন।
অসাম্য ও সমাজ
একজন আইনজীবী হয়ত একখানা দলিলমাত্র পড়ে কিংবা আদালতে দাঁড়িয়ে গরীব মক্কেলের কাছে পাঁচ-সাতশো, হাজার, দু'হাজার টাকা দাবি করেন; সেখানে তারা অন্যপক্ষের অজ্ঞতা, অক্ষমতার ট্যাকসো যথাসম্ভব শুষে আদায় করে নেন। কারখানার মালিক ধনিকেরাও ঠিক তাই করেন। পরস্পরের পেটের দায়ের অসাম্যের ওপরেই তাঁদের শোষণের জোর। আমাদের দেশের কন্যাপক্ষের কাছে বরপক্ষ অসংগত পরিমাণে পণ দাবি করে; তার কারণ, বিবাহ করার অবশ্যকৃত্যতা সম্বন্ধে কন্যা ও বরের অবস্থার অসাম্য। কন্যার বিবাহ করতেই হবে, বরের না করলেও চলে, এই অসাম্যের ওপর চাপ দিয়েই এক পক্ষ অন্য পক্ষের ওপর দন্ড দাবি করতে বাধা পায় না। এস্থলে ধর্মোপদেশ দিয়ে ফল লাভ হয় না, পরস্পরের ভিতরকার অসাম্য দূর করাই প্রকৃষ্ট পন্থা।
অহং
নদীর জল যখন নদীতে আছে তখন সে সকলেরই জল - যখন আমার ঘড়ায় তুলে আনি তখন সে আমার জল, তখন সেই জল আমার ঘড়ার বিশেষত্ব দ্বারা সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। কোনো তৃষ্ণাতুরকে যদি বলি নদীতে গিয়ে জল খাও গে, তাহলে জল দান করা হলো না - যদিচ সে জল প্রচুর বটে এবং নদীও হয়তো অত্যন্ত কাছে। আমার পাত্র থেকে সেই নদীরই জল এক গন্ডূস দিলেও সেটা জল দান করা হল।
বনের ফুলতো দেবতার সম্মুখেই ফুটেছে। কিন্তু তাকে আমার ডালিতে সাজিয়ে একবার আমার করে নিলে তবে তার দ্বারা দেবতার পূজা হয়। দেবতাও তখন হেসে বলেন, হ্যাঁ, তোমার ফুল পেলুম। সেই হাসিতে আমার ফুল তোলা সার্থক হয়ে যায়।
অহং আমাদের সেই ঘট, সেই ডালি। তার বেষ্টনের মধ্যে যা এসে পড়ে তাকেই 'আমার' বলবার অধিকার জন্মায় - একবার সেই অধিকারটি না জন্মালে দানের অধিকার জন্মে না।
সৌজন্যেঃ অনুপ বন্দ্যোপাধ্যায়
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।