।। ৬ ।।
মানব সভ্যতা গড়ে ওঠার প্রাক মুহূর্তে তথা প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষ কেমন ছিল। তারা না জানতো ভাষা, না বলতে পারতো কোনো কথা। এক এক অঞ্চলে এক একটা ছোটো ছোটো দল সংঘবদ্ধভাবে বাস করতো। বন জঙ্গল থেকে সংগৃহীত খাবার তারা সমানভাবে ভাগ করে খেতো, সবাই দলবদ্ধভাবে বন্য জন্তুর আক্রমণ প্রতিরোধ করতো। ঝড় বৃষ্টি রোদ তাদের উপর দিয়ে সমানে বয়ে যেত। তাদের না ছিল কোনো ধর্ম, না ছিলো কোনো মনগড়া দেবতা। সারাটা দিন বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোই তাদের বৈশিষ্ট্য ছিল, এক জায়গায় খাবার ফুরিয়ে গেলে আর এক জায়গায় চলে যেত। সভ্যতা যত এগিয়েছে মানুষের মধ্যে জটিলতা তত বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যক্তিগত সম্পত্তি, লোভ-লালসা এবং লাভ যখনই মানুষের মধ্যে প্রবেশ করেছে ততই মানুষ মানুষের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। ধীরে ধীরে এক শ্রেণিবিভক্ত সমাজের চিত্র ভেসে উঠেছে, আর তারপরই শুরু হয়েছে মানুষে মানুষে বিভাজন, বিভেদ বৈষম্য, হানাহানি। কেউ কাউকে এক ইঞ্চি পরিমাণ জমি ছাড়তে রাজি নয়। তারই উন্নততর রূপ আজকের সমাজ, সভ্যতা সংস্কৃতি ও ধর্ম। সবই মানুষের সৃষ্টি অথচ তার ফাঁদে পা দিয়ে মানুষ নিজেদের জীবনকে জটিল করে তুলেছে।
আমি আর আরশাদ যখন আমাদের গন্তব্যে পৌঁছালাম তখন বারোয়ারী মন্দিরে বেশ ভিড়, পুরোহিত মশাই ঘোষণা করলেন - প্রত্যেকে প্রস্তুতি নিন এখন অঞ্জলি দেওয়া হবে। কয়েকটি অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে গঙ্গা জলের পাত্র হতে নিয়ে সবার হাতে হাতে অল্প অল্প করে দিয়ে দিচ্ছে। সবার হাতে জল দেওয়া হলে পুরোহিত মশাই বললেন - হাতটা ধুয়ে নিন আর আমার সাথে সাথে উচ্চারণ করুন - “পবিত্র অপবিত্র বা যৎ স্মরেৎ পুণ্ডরীকাক্ষং সবাহ্য অভ্যন্তরং সূচী, ওঁ নমো বিষ্ণু, নমো বিষ্ণু, নমো বিষ্ণু।“এবার যারা গুরুদেবের নিকট থেকে দীক্ষা নিয়েছেন তারা মাথায় হাত রেখে গুরুমন্ত্র উচ্চারণ করুন।
সবাই একসাথে পুরোহিত মশাইয়ের নির্দেশ পালন করলেন। তারপর মূলমন্ত্রে প্রবেশ করলেন। একে একে অঞ্জলি দেওয়া হলে সবাই চরণামৃত গ্রহণ করে জায়গা ছেড়ে চলে গেলেন। এভাবে পরপর চারবার অঞ্জলি দেওয়া হলো। তারপর ছেলেমেয়েরা এক একটা পিতলের রেকাবি হাতে নিয়ে পুরুতঠাকুরের দক্ষিণা সংগ্রহ করতে লাগলো। দক্ষিণা সংগ্রহ হলে ওগুলো নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে ওরা প্রসাদ বিতরণের কাজে হাত লাগালো। আরশাদের কাছে শুনেছি এই গ্রামে নামমাত্র কয়েক ঘর হিন্দু আছে, তারা মাহিষ্য সম্প্রদায়ের, আর বেশির ভাগ মুসলিম। এখানে এসে বুঝতে পারলাম না কে হিন্দু আর কে মুসলিম। এ প্রশ্ন মনে উঁকি দিলেও এখন উত্থাপন করা যাবে না, তাহলে সাধের প্রাণটা নিয়ে আর বাড়ি ফেরা হবে না। অতএব জয় এখন যা চলছে তা শুধু দেখে যাও, পরে তোমার প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করো। ওরা এসে আমাকে এবং আরশাদকে প্রসাদ দিল। অনেকক্ষণ পেটে কিছু পড়েনি, একটু ফল মিষ্টি পেটে পড়তেই ক্ষিদেটা যেন চনমনিয়ে উঠলো। ফিসফিস করে আরশাদকে বললাম - বুঝলি ভাই, ক্ষিদেটা যেন আরও বেড়ে গেল। আসলে সেই কোন সকালে বেরিয়েছি তো, তাই আর কি...
- তা এতক্ষণ বলিসনি কেন?
- না আসলে এখানে এসে এমনিতেই মনটা ভরে গেছে। তারপর যা দেখলাম আর শিখলাম তাতে খাবার কথা মাথায় আসেনি। কিন্তু প্রসাদটা খেয়ে...
- ঠিক আছে, ঠিক আছে। অত বাহানা করে কাজ নেই, যা বোঝার আমি বুঝে নিয়েছি।
আমাদের কথাবার্তার মাঝে একটা দশ বারো বছর বয়সের ছেলে এসে বললো - দাদা তোমরা কোত্থেকে আসছ, নিশ্চয় অনেক দূর থেকে? সে তোমাদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তা তোমরা কী খিচুড়ি খাবে? তাহলে আর দেরি না করে স্কুল মাঠের পিছনে চলে এসো। ওখানে প্যান্ডেলে বেঞ্চ পাতা আছে। এখনই খিচুড়ি দেওয়া শুরু হবে।
খিচুড়ির কথা শুনে মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। একে তো প্রচণ্ড ক্ষিদে পেয়েছে তার ওপর আমার প্রিয় খিচুড়ি। আমার আর তর সইলো না। আরশাদ কে টানতে টানতে নিয়ে গেলাম। দেখলাম অনেকেই বসে আছে, আমরাও একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বসে পড়লাম। পেটে রসদ পড়তেই মনটাও চাঙ্গা হয়ে উঠলো, আরশাদকে বিষয়টা বলতেই দেখি ওরও একই অবস্থা। আসলে অনেক সকালে বেরিয়েছি তো। একটা ছোটো ছেলে খিচুড়ি বিতরণ করছিল ওকে জিজ্ঞেস করলাম
- হ্যা রে খোকা একটু জল হবে?
- হবে। আর আমার নাম খোকা নয়, আলম। আমার আব্বুই তো এই পুজোর সেকেটারি। আর ও পাড়ার গণেশ কাকা হলো এই পুজোর ক্যাশির। আমার আম্মু ওই যে প্যান্ডেলে বসে আছে। উনি তো ফল মিষ্টি ফুল সব গুছিয়ে দেন। আমরা সবাই একসাথে মিলেমিশে থাকি। এটা অনেক দিন থেকেই চলে আসছে।
শুনে বেশ ভালো লাগলো। সত্যি এমনটা দেখা যায় না, এটা দেখাও ভাগ্যের ব্যাপার। আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। আরশাদ একটু অন্যমনস্ক ছিল, তাই আমাদের কথোপকথন শুনতে পায়নি। আমাদের খাওয়া শেষ হলে আলম দুটো গ্লাস ভর্তি জল নিয়ে এলো। জলপান করে ওকে জিজ্ঞেস করলাম - আলম তুই কোন ক্লাসে পড়িস।
আলম জানালো যে, ও ক্লাস থ্রিতে পড়ে। পাড়ার একটা দিদি, যে নাকি দৈয়ের বাজারের হাইস্কুলে পড়ে সে প্রতিদিন এই বারোয়ারীতলায় বসে অনেকগুলো বাচ্চাকে পড়ায়, যারা পারে তারা সামান্য কিছু পারিশ্রমিক দিদিকে দেয়, যারা পারে না তারা দেয় না। অনেকেই টাকা পয়সা দিতে পারে না। দিদি কাউকে জোর করে না, শুধু বলে - কেউ পড়া কামাই করবে না।
সত্যি সত্যি কেউ কামাই করে না। দিদি সবাইকে খুব ভালোবাসে। আলমের সঙ্গে কথা বলে বেশ ভালো লাগলো। একবার ইচ্ছে হলো দিদিটার সাথে কথা বলতে। কিন্তু মনের ইচ্ছেটা মনের ভেতর চেপে রাখতে হলো। গাঁ গঞ্জের ব্যাপার, কোথায় কী বিপদ লুকিয়ে আছে বলা যায় না। ধীরে ধীরে বেলা গড়িয়ে যেতে লাগলো। আরশাদ এবার ফেরার জন্য তাড়া দিল। হ্যা, এবার ফিরতে হবে, অনেক বেলা হলো। গ্রামের আরও দু’একটা বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখলাম, কথা বললাম। অত্যন্ত সহজ সরল স্বভাবের মানুষগুলোকে দেখে প্রাণটা ভরে গেল। ফিরতে মন চাইছিল না, তবু ফিরতে হবে। ফেরার সময় আলমের সঙ্গে আর একবার কথা বললাম। ওর হাতে পাঁচটা টাকা দিয়ে বললাম - কিছু কিনে খাস।
ও নিতে চাইছিল না, আমি জোর করেই দিলাম। ও বললো - আবার এসো।
বলেই একগাল হেসে ছুটে চলে গেল । আমরা বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম।
প্রায় সপ্তাহ খানেক বাদে বনগাঁ থেকে দিদি এলো। দিদি বললো - কীরে জয়, তুই বাড়ি থেকে চলে এলি। একটু মানিয়ে নিতে পারলি না? এখন তো দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করার সময়।
- দিদি তোর শরীর কেমন আছে? তোর ছেলেরা ভালো আছে তো? ওরা তো পড়াশোনা করলোনা, তা এখন কী করছে?
- আর ওদের কথা বলিস না। বড়োটা যাও বা কাজকর্ম শিখছে, ছোটোটা একেবারে বাউণ্ডুলে হতচ্ছাড়া। সারাদিন কোথায় ঘুর ঘুর করে, খাওয়ার সময় খেতে আসে, আর সাংঘাতিক মেজাজ তার। ওর বাবার মতো, ভীষণ কুঁড়ে, বড়ো ছেলেকে বললে ও বলে, ছেড়ে দাও মা। ভাই এখন ছোটো, ওর যা মনে চায় করুক, বড়ো হলে ঠিক হয়ে যাবে। আমি আর কিছু বলতে পারি না, ওর বাবাকে তো পাত্তাই দেয় না। এই দেখ আমি কেবল আমার কথাই বলছি।
- দিদি, আমি ভালোই আছি, আমাকে নিয়ে তোরা ভাবিস না। এখন আমি আমার মতো করে নিজেকে তৈরী করতে পারবো। কারোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে না। নিজে টিউশনি করি, রান্না বান্না করে খাই, কারোর কথা শুনতে হবে না। যাক সেসব কথা, অনেক সকালে বেরিয়েছিস কিছু তো খাসনি কী খাবি বল।
- না রে, আমি এইমাত্র খেয়ে এলাম।
আমি একটা প্লেটের ওপর একটু মিষ্টি, ভুজিয়া আর চানাচুর সাজিয়ে দিলাম। দিদি মিষ্টিটা তুলে দিল। চানাচুর আর ভুজিয়াটা খেল। তারপর এক গ্লাস জল খেয়ে দিদি চলে গেল। আমিও আমার কাজে লেগে গেলাম। আপাতত এসব ছোটো-ছোটো বিষয় নিয়ে না ভাবলেই চলে।
(ক্রমশ)