"কি বলতে চাও তুমি? সব দায়িত্বই কি শুধু আমার একার? সব কাজ কি আমাকেই করতে হবে?" এক শ্বাসে ঝাঁঝিয়ে বলে ওঠে পায়েল। ঋতমও থেমে থাকে না -
- "তবে কে করবে শুনি? আমি করবো আমি? আমি ছেলে হয়ে সারাদিন পরে অফিস থেকে ফিরে আবার রান্না করবো, ঘরের সব কাজ করবো?"
- "কেন? এক আধ দিন করলেই বা। আর আমি মেয়ে বলে কি আমাকেই করতে হবে? আমি অফিস করে, সারাদিন বাড়ির বাইরে পরিশ্রম করে আসিনি?"
- "কে বলেছে তোমাকে চাকরি করতে? ছেড়ে দিলেই তো পারো।"
- "তুমিই তো বিয়ের সময় চাকরি করা মেয়ে খুঁজেছিলে, তখন মনে ছিলনা? এখন আবার বড় বড় বাত ঝাড়ছো।"
- "হ্যাঁ হ্যাঁ আমার জানা আছে, কি কাজ কর অফিসে। তাই প্রতিদিন ফিরতে এত রাত কেন হয় তা কি বুঝিনা আমি।আর ক'টা টাকাই বা পাও যে এত দেমাগ।"
- "যাই পাইনা কেন, মাসের প্রথমে তো হাত পেতে নিতে ছাড়না। আর তোমারই বা ফিরতে প্রতিদিন এত দেরী হয় কেন? মাঝে মাঝেই তো মদ খেয়ে ঘরে ফেরো। আমি কি গন্ধ পাইনা ভেবেছ?"
- "সে তো আমার অফিসের পার্টি থাকে, তাই মদ খেতে হয়। আর তুমি কি কর, তা তো আমি ভালো করেই জানি, বসের গায়ে গা ঘষে ঘুরে বেড়াও, বসকে খুশী করতে ছুটির পর ঘুরতে যাও।"
- "একদম বাজে কথা বলবেনা বলে দিলাম । নিজের বৌকে সন্দেহ কর, লজ্জা করে না তোমার?"
- "না করে না, কারণ আমি যা বলছি, তা ঠিকই বলছি।"
- "ছোটলোক কোথাকার, অশিক্ষিত, ইতর। আবার এসব বললে মেরে দাঁত ভেঙে দেব।"
- "ওওও... তাই নাকি? নিজের স্বামীর গায়ে হাত তুলবে? আর আমি ছেড়ে দেবো ভেবেছ?" প্রতিদিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পর এটাই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে ঋতম আর পায়েলের মধ্যে। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলেনা। দুজনেই নিজের নিজের ইগো নিয়ে নিজের গুরুত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করে। দুজনের মাঝে পড়ে টুয়া মানে ওদের একমাত্র সন্তান যে প্রতিনিয়ত একটু একটু করে ক্ষয়ে চলেছে তার খোঁজ ওরা কেউই রাখেনা। দুজনের মধ্যে ঝগড়া একেকদিন প্রায় হাতাহাতির পর্যায় চলে যায়, ছোট্ট টুয়া ভয়ার্ত চোখে একবার বাপির দিকে, একবার মামনির দিকে তাকায়। একবার ছোট ছোট হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে কাতর স্বরে -
- "ও বাপি, বাপি তুমি চুপ করোনা।" আর একবার মা'কে -
- "মামনি ও মামনি, তুমি চুপ করোনা। আমার খুব ভয় করছে।"
- "তুই থামবি? থামবি তুই?" এক চড় মারে ঋতম ছোট্ট টুয়ার ঐ নরম কচি গালে।
- "তুমি একদম অমানুষ হয়ে গেছ। ঐভাবে কেউ মারে ঐটুকু বাচ্চার গালে? আমি কালকেই টুয়াকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাব। তোমার সঙ্গে আর থাকবই না।" টুয়া ভয় পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে অন্য ঘরে চলে যায়।
সবাই ঘুমিয়ে পড়লে টুয়া অনেক রাত অবধি বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। বাবা-মা কেউই ওর কান্না কোনও দিন দেখতে পায়না, ওরা কেউ ওর কষ্টটা বোঝে না। টুয়া কিছুতেই বুঝতে পারে না, বাপি আর মামনি কেন নিজেদের মধ্যে সবসময় এত ঝগড়া করে। আসলে টুয়ার বাবা-মা নিজেদের চাকরী নিয়ে, পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া করে এতটাই ব্যস্ত থাকে যে টুয়াকে সঠিকভাবে সুন্দর একটা সময় দিতে পারে না। এমনিতে টুয়া স্কুল থেকে ফিরে সারাদিন রানুদির কাছেই থাকে। স্কুল থেকে ফিরলে রানুদিই ওকে স্নান করিয়ে, ভাত খাইয়ে, গল্প শুনিয়ে দুপুরে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। তাই রাণুদি টুয়ার কাছে এক অনন্ত ভালোবাসার জায়গা। ওর জন্মের পরেই রানুদি এ বাড়িতে আসে ওকে দেখভাল করার জন্য। টুয়ার বাবা-মা অফিস থেকে বাড়ি ফেরার কিছু পর রানুদি নিজের বাড়ি ফিরে যায়। তাই মাঝে মাঝে টুয়া ওর রানুদির কাছেও জানতে চায়
- "রানুদি বাপি আর মামনি এত ঝগড়া করে কেন গো? আমার একদম ভালো লাগে না, খুব ভয় লাগে।"
- "কি করে বলবো বল? আমি তো নিজেও কিছু বুঝতে পারিনা।"
- "এর পরেরবার দাদানরা বা দাদুনরা এলে আমি ওদেরকে তাহলে জিজ্ঞেস করে দেখবো। ওদেরকে আমি সব বলে দেবো, বাপি আর মামনি কেউই আমাকে আর ভালোবাসে না, একটুও আদর করে না, খালি ঝগড়া করে।"
বিয়ের পরেই ঋতম, পায়েলকে নিয়ে ওর পরিবার থেকে আলাদা হয়ে নিজেদের সংসার পাতে, যদিও ওদের দুজনেরই বাবা-মা মাঝে মধ্যেই ওদের কাছে এসে ঘুরে যায়। দুজনেই চাকরি করার জন্য টুয়ার জন্মের পরে রানুদিকে রাখা হয় ওকে দেখাশোনা করার জন্য। সেই ছোট্টটি থেকে রানুদিই টুয়াকে কোলে পিঠে নিয়ে বড় করে তুলেছে। টুয়ার কষ্ট তাই রানুদিকেও খুব কাঁদায়, কিন্তু ও কিছু করতে পারেনা ওর জন্য।
এইভাবেই দিনের পর দিন টুয়া তার মা-বাবার চোখের আড়ালেই একটু একটু করে ক্ষয়ে যেতে থাকে। একদিন ঋতম অফিস থেকে বেশ কিছু আগেই বাড়ি ফিরে আসে। সেদিন আসলে অন্যদিনের মতো অফিসের কোনও ক্লায়েন্টের সাথে কোথাও যাওয়ার ছিল না। হাফ্ ইয়ার্লি টার্গেট কয়েকদিন আগেই পূরণ করা হয়ে গেছে আর তাছাড়া শরীরটাও ভালো লাগছিল না। বাড়ি ফিরে পায়েলকে পাবে না জেনেও একটু মেজাজটা গরমই হয়ে যায় পায়েল না ফেরাতে। ঘরে ফিরে একটু জিরিয়ে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয় ঋতম। ভাবে যে রানুদিকেই একবার চা বানাতে বলবে, তারপর নিজেই চা বানাতে কিচেনে যায়। কিচেন থেকেই কলিংবেলের আওয়াজটা কানে আসে। রানুদি দড়জাটা খুলে দেওয়ার পর গলার শব্দে বুঝতে পারে যে পায়েলও ফিরে এসেছে। ভালো লাগে পায়েল তাড়াতাড়ি ফিরে আসাতে। দু'কাপ চা ট্রেতে করে নিয়ে ঋতম বেডরুমে গিয়ে দেখে পায়েল ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। ঋতমকে চা করে আনতে দেখে একটু অবাকই হয় পায়েল, ভালোও লাগে।
- "কি হলো, তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে আজ অফিস থেকে?"
- "ক্লায়েন্ট মিট ছিলনা আজ, তাছাড়া শরীরটাও ভালো লাগছিল না। তুমি যে তাড়াতাড়ি ফিরে এলে?"
- "বস্ একটা জরুরী মিটিংয়ে বিকেলেই বেরিয়ে গিয়েছিল, তাই আমিও বেরিয়ে এসেছি।"
দুজনে আজ অনেক দিন পর একসাথে বসে চা খাচ্ছে।হঠাৎই ওদের টুয়ার কথা মনে পড়ে, দুজনেই একসঙ্গে খুঁজতে খুঁজতে ওর পড়ার ঘরে গিয়ে দেখে টুয়া টেবিলের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। পায়েল হঠাৎই খেয়াল করে টুয়ার মাথার নীচে একটা খোলা খাতা, তাতে গোটা গোটা অক্ষরে পেন্সিলে কিছু লেখা। আলতো করে খাতাটা বের করে দেখে একটা চিঠি... দুজনেই সাগ্রহে চিঠিটা পড়া শুরু করে...
ডিয়ার গড,
তুমি জানো, আমার কত কষ্ট? আমার বাপি আর মামনি আমাকে একদম ভালোবাসে না। খালি নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে আর আমাকে বকে, মারে। সারাদিন ওরা বাড়িতে থাকে না। রাতে ফিরে এসেই খালি ঝগড়া করে, আমার খুব কষ্ট হয়, কান্না পায়। আমি কতবার বলি, বাপি তুমি ঝগড়া কোরোনা, মামনিকে সরি বলো, মামনি তুমি ঝগড়া কোরোনা, বাপিকে সরি বলো। ওরা শোনে না, আমাকেই খুব বকে। রাতেও ওরা ঘুমিয়ে পড়ে আমাকে আদর না করে। গড, তুমি জানো আমি রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কত রাত অবধি কাঁদি, কেউ জানতে পারে না, কেউ না, তারপর কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন সকালে উঠে স্কুলে গিয়েও আমার ঘুম আসে, একটুও পড়তে ভালো লাগে না। স্কুলে মিসরাও খুব বকে আমাকে। স্কুল থেকে ঘরে ফিরে এলে রানুদিই আমাকে খাইয়ে দেয়, গল্প বলে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। খুব ভালোবাসে আমাকে রানুদি। জানো, জানো গড সেদিনকে মামনি বলছিল, আমাকে নিয়ে নাকি মামনি দাদুনের বাড়িতে চলে যাবে। কিন্তু তাহলে তো আমি আর বাপিকে দেখতে পাবোনা। আমি তো বাপিকে খুব ভালোবাসি, মামনিকেও খুব ভালোবাসি। আমি তো বাপি-মামনি দুজনের সাথেই থাকতে চাই গড। বাপিকে ছেড়ে চলে গেলে যে আমার আরও কষ্ট হবে। আমি যাব না দাদুনের বাড়ি মামনির সাথে। একটা কাজ করো না গড, আমাকে তোমার কাছে নিয়ে চলো। আমি তোমার কাছেই থাকবো, বাপি আর মামনি কারোর কাছেই থাকবো না। তুমি শুধু আমাকে আদর কোরো, কষ্ট দিওনা তাহলেই হবে। আর কিছু চাইনা আমার...
চিঠিটা এখানেই শেষ, বিভিন্ন জায়গায় টুয়ার চোখের জল শুকিয়ে দাগ হয়ে রয়েছে। আর থাকতে পারে না পায়েল ঋতমের বুকের উপর ঝাপিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে -
- "সরি ঋতম সরি..."
- "সরি পায়েল...আমাকে ক্ষমা করে দাও।"
দুজন দুজনকে জড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ কাঁদতে থাকে, হালকা হয়।
- "এরকমভাবে আমরা সরি বললে তো হবেনা ঋতম।"
- "হুম্ ঠিক তাই। আজকে কি পায়েল, তোমার মনে আছে?"
- "মনে আছে বলেই তো তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম। কিন্তু তোমার মনে আছে? কোনও বার তো থাকে না।"
- "না গো, মনে ছিল না। কিন্তু তুমি যখন কাঁদতে কাঁদতে আমার বুকের উপর ঝাপিয়ে পড়লে, তখনই সব মনে পড়ে গেল। বিয়ের পর প্রথমবার যখন তোমাকে আমি তোমার বাপের বাড়িতে ছেড়ে এসেছিলাম, তখন তুমি এরকম করেই কেঁদেছিলে আমি চলে আসার আগে।"
- "হ্যাঁ, মনে আছে আমার।"
- "দাঁড়াও, টুয়াকে এখনই ঘুম থেকে ডেকো না, আমি একটু দোকান থেকে আসছি।"
কিছুক্ষণ পরেই ঋতম ফিরে আসে, সাথে একটা বড় কেকের বাক্স। বাক্স থেকে কেকটা বার করে টুয়ার পাশ দিয়ে টেবিলের উপর রেখে তাতে একটা মোমবাতি বসিয়ে জ্বালিয়ে দিয়ে, ঘরের আলো নিভিয়ে দেয় -
- "পায়েল, এইবারে ডেকে দাও ওকে।"
- "টুয়া ও টুয়া, এবার ঘুম থেকে উঠে পড় মামনি। দেখ আমি আর তোর বাপি অফিস থেকে ফিরে এসেছি।"
মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙে টুয়ার, কিন্তু অন্ধকার ঘরের মধ্যে বাপি বা মামনি কাউকেই দেখতে পায়না। হঠাৎই খেয়াল করে পাশে রাখা কেকটাকে, মোমের আলোয় দেখে তাতে লেখা রয়েছে - 'হ্যাপি ওয়েডিং অ্যানিভার্সারি অফ টুয়া'স মামনি এণ্ড বাপি।' চোখে জল চলে আসে টুয়ার। এমন সময় ঘরের আলো জ্বলে উঠলে দেখে ওর মামনি আর বাপি দুজন দুজনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। টুয়া ওদের দিকে তাকাতেই দুজনেই একসাথে - "সরি টুয়া, উই আর ভেরি সরি..." - বলে দুজনে দু'হাত বাড়িয়ে টুয়াকে ডাকে। টুয়াও বাপি-মামনির কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুজনকেই জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে -
- "বাপি মামনি তোমরা সব সময় এরকমই থেকো, আর কোনোদিনও ঝগড়া কোরো না, আমার খুব কষ্ট হয়।"
- "না রে মা, আমরা আর কোনোদিন ঝগড়া করবো না, প্রমিস। এবার থেকে আমরা তিনজনেই এইরকম হাসি-খুশিতে আর আনন্দে থাকবো।