"অনু... অনু... কোথায় থাকিস বলতো? আর তোর মনটাই বা কোথায় থাকে? ডেকে ডেকে অস্থির হয়ে যাচ্ছি...। আজ এখনও অবধি গাছে জল দিলি না? এবার তো ক্লাসে বেরিয়ে যাবি। কাল যে বলে রাখলাম, জল দেবার আগে শুকনো পাতা আর পাপড়িগুলো পরিষ্কার করে দিস...; কি যে ভাবিস বাবা অত জানি না।"
এতগুলো কথাতে অনু সম্বিত পেল যেন। অনু, মানে অনুভূতি সেন। এম.এ. ফার্ষ্ট ইয়ারের ছাত্রী। এতটাই অনুভূতিপ্রবণ মেয়ে যে বাবা ওর নাম ত্রিধা থেকে বদলে অনুভূতি রেখেছিল। সে এখন মা ও অনেকের কাছে শুধুই অনু।
"এই যা! একদম ভুলে গেছি মা।"
"ভোলার আর কি দোষ, যত আজগুবি, অদ্ভুত চিন্তায় ডুবে থাকবে। বাস্তবে আয়, নইলে জীবনে কষ্ট পাবি।" কথাগুলো বলেই নিতু আবার রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। মা-ও অনুকে ঠিক বোঝে না। মনে মনে অনু বলে, মা, তোমাকে দেখে বাস্তবকে যে প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি মা, শুধু তুমি সেটা বুঝতে চাও না। অনু বললো, "তুমি তো বাস্তবেই নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিলে মা, তবে তোমার..."
কথা শেষ করতে দেয় না নিতু। বিরক্ত প্রকাশ করে বলে, "আআআ... কতবার বলেছি অনু, এ নিয়ে আর একটা কথাও বলবি না।"
"কেন নয়, মা?"
"কারণ আমি চাই না তাই" বেশ রেগে নিতু উত্তর দেয়।
"ভালো লাগে না এসব আমার আর।"
"সত্যিই কি ভালো লাগে না, মা? না, সত্যিগুলো প্রকাশ করতে ভয় পাও?" জোর দিয়ে বলে ওঠে নিতু,
"কিসের ভয়? সেই কোন্ কালে মা-বাবা সবাইকে ছেড়ে এসে এ সংসারেই বেশী সময়টা কেটে গেলো। আজ আর নিজের ও কথাগুলো, অনুভূতিগুলো জানাতে, ভাবতে ভালো লাগে না অনু। দোহাই তোকে, এসব নিয়ে আর কথা নয়, আমাকে একটু ভালো থাকতে দে। কটা বাজে চেয়ে দ্যাখ। গাছেও জল দিলি না, এবার ক্লাসও আর হবে না মনে হচ্ছে।"
"তুমি খেতে দাও মা, আমি জামাটা পাল্টে আসছি..." বলেই অনু নিজের ঘরে চলে যায়।
'নিজের ঘর' এ শব্দটা অনুর কাছে বড় প্রিয়। অনুভূতির নিজের মনের মতো একটা ঘর। অনুভূতি দিয়েই ঘরটা ও নিজের মতো করে সাজিয়েছে, কেউ বাধা দেয়নি ওকে। ওর সব অনুভবরা ঘরের চারদিক জুড়ে আছে, দেওয়ালে, ঘরের কোণায়, টেবিলে, খাতায়, ফুটে উঠেছে।
বেশ মনে আছে ওর, যখন পুরোনো বাড়িটাকে নতুন করে আরও তিনটে ঘর বাড়িয়ে বড় করা হল, ছোটকা বলেছিল, "কিরে অনু, তোর একটা ঘর চাইতো? এই বেলা বলে দে, প্ল্যানটা স্যাংশান করিয়ে নেবো দাদার কাছ থেকে।" দাদা মানে অনুর বাবা। অনু তো লাফিয়ে উঠেছিল। "তাহলে, আমার একটা নিজের ঘর হবে, ছোটকা?" ছোটকা সোৎসাহে বলেছিল, "হবে, হবে, আর ক'টা দিন শুধু অপেক্ষা কর।" বড় আমুদে আর প্রাণখোলা মানুষ ছোটকা। এখনও যদি ছোটকারা একসাথে থাকতো কি ভালোই হতো! পরে অনুভব করেছিল অনু, এই একসাথে না থাকাটা কতটাই ভালো হয়েছে। তাই হয়তো ছোটকা আগের মতোই থাকতে পেরেছে এখনও। ছোটকার জন্যই অনু নিজের একটা ঘর পেয়েছে। ঘরে এলেই এখনও কথাটা সবসময় মনে হয় অনুর।
অনুর ঘরে ঢুকলেই কেমন যেন একটা ভালোলাগা জড়িয়ে যায়। কী সু্ন্দর সাজানো ঘর! ঘরের কোথাও বাহুল্যতা নেই কিন্তু স্নিগ্ধ সৌন্দর্য্য আলস্য ভুলিয়ে দিতে পারে। ঘরের দরজার দু'পাশে ফুল আর পাখি মিলিয়ে, সাজিয়ে দুটো স্ট্রিং, অনুর নিজের হাতে বানানো। হাওয়ায় দুললে খুব মিষ্টি শব্দ তোলে। ঘরের একদম বাঁদিকের কোণে ওর আলমারি, জলপাই কালারের, ওর পছন্দের রঙে। আলমারির ঠিক আগেই তিনপেয়ে একটা শৌখিন শেল্ফ। একেবারে ওপরে একটা শৌখিন টবে একটা গাছ, কে বলবে ওটা আর্টিফিসিয়াল! পুবদিকে বড় জানলা, সেখানে মানিপ্ল্যান্টটা কেমন রোদমুখী হয়ে পরম আনন্দে আছে। তার পাশে ফুলের আর পাতাবাহারী গাছ দুটো। তিনটে গাছই অনুর হাতের যত্নে যেমনই ঝকঝকে তেমনি চনমনে। পশ্চিমের দেওয়ালের ঠিক মাঝে একটা পেন্টিং, এক দিদির সাহায্য নিয়ে ওটা অনুরই করা। ছবিটার দিকে ভালো করে তাকালে বোঝা যায় মানুষের জীবনের আবেগগুলো কি গভীরভাবে ধরা পড়েছে ছবিতে, অদ্ভুত সুন্দর ছবিটা। তবে অনেকের চোখে ওটা শুধুমাত্রই একটা আর্ট হয়তো বা। তা হোক, ওটা অনুর বড় প্রিয়। ঘরে ঢোকার মুখের পাপসটা যেন একটা ফুটে থাকা সাদা গোলাপ, শান্তির বার্তা নিয়ে যেন ডাক দেয়।
বেঁচে থাকার যত সুখ-আনন্দ-বেদনা-যন্ত্রনা সব অনু গাছদের দিকে তাকিয়ে রোজ অনুভব করে। বাঁচার প্রাণশক্তি পায়। ফুলের মধ্যে রঙিন আকাঙ্খা খুঁজে পায়। ফুল ওর কাছে বর্ণময় আশ্বাস। তাকিয়ে দেখে মানিপ্ল্যান্টটা কেমন এগিয়ে যাবার আকুতিতে রোদের দিকে রোজ মুখ বাড়ায়। তার মানে আশার আলোয় বেঁচে থাকতে চায়। অনু জীবনের সাথে মেলায়, জীবনও তো তাই চায়। তাই রাতের পরিবৃত্তে বড় হওয়া গাছ অনুর পছন্দ নয় মোটেও। সময় পেলে অনু পাতাবাহারী গাছটার পাতাগুলোতে হাত বুলোয়। কেমন প্যাঁচানো তবুও কত রঙ, কত প্রাণ। মানুষের জীবনের জটিলতার মধ্যেও যেমন রঙ আছে ঠিক যেন তেমনটি। হাজারো কষ্টে যেমন মানুষ আলোর ঠিকানা আঁকড়ে বাঁচতে চায় গাছগুলোও ঠিক যেন তেমন। অনু অনুভব করে পাতা ঝরে গেলেও গাছ থামে না, পাপড়ি ঝরে গেলেও আবার নতুন কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটে, গাছ তো প্রাণেরই নামান্তর। মানুষের কান্না দেখা যায়, কিন্তু গাছেদের দেখা যায় না। আর মানুষ প্রত্যাশা করে তাই কষ্টও পায়, গাছ শুধু দিয়ে যায়, বিনিময়ে সে কিছুর প্রত্যাশী নয়।
একটা ছোটো কলসীতে অনু কালো ছাড়া সব রঙ দিয়ে নক্সা এঁকেছে। এক একটা রঙ এক একটা আবেগ-অনুভূতিতে পরিপূর্ণ ওর কাছে। মায়ের চেপে রাখা কথাদের ও নীল রঙে খুঁজে পায়, ও রঙটা কেমন মিশে যায় নোনা জলেও। তাই ওই রঙটাকে ও দূরে রাখতে চায়। সবুজে সে প্রাণ খুঁজে পায়। আর কমলা, হলুদ মানে তো আলো, আশা, এগিয়ে যাবার বার্তা ঐ দুই রঙে। রোজ ডায়েরী লেখে অনু। এক এক দিন এক এক রঙের কালিতে সে দিনলিপির সাথে তার উপলব্ধিদের পাতা বন্দী করে। আবেগদের শব্দে-কথায় ধরে রাখে। শব্দ আর কালিই অনুর অনুভূতিতে আঁচড় কাটতে পারে, অনুভূতির নাগাল চট করে কেউ পায় না, এমনকি তার মা-ও না।
একটা জোরে চিৎকার কানে আসে..., মায়ের গলা।
"গালে হাত দিয়ে ভেবেই যা ক্লাস-ট্লাস সব মাথায় তুলে।"
অনু জামা পড়ে, ব্যাগ গুছিয়ে রেডি। ওড়না গলায় দিতে গিয়ে রুমিপিসির কথা মনে পড়লো। নিজের একটা পছন্দের কাপড় কেটে ওড়নাটা রুমিপিসি সুন্দর করে বানিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, "তোকে বড্ড ভালোবাসি অনু। মন চাইলেও সাধ্য কিছু দিতে বাধ সাধে। বড় সাধ করে তোর জন্য এটা বানিয়েছি, নিবি তো?" অনু আজও সেটা নেয়। রুমিপিসি আজ আর নেই কিন্তু তার সবটুকু স্নেহ-ভালোবাসা এই ওড়ানাতে এখনও লেগে আছে। খুব যত্ন করেই এটা ব্যবহার করে, স্নেহের যে গন্ধটা এখনও পায় সেটাও তো একটা অনুভূতিই। এটা গায়ে জড়ালেই রুমিপিসির হাসিমুখটা মনে পড়ে যায়। স্মৃতির অনুভবই কি কিছু কম?
মায়ের জমাট কষ্টটা অনু অনুভব করতে পারলেও তা থেকে মা'কে বার করবার রাস্তা পায় না। বোঝে মায়ের অসময়েও এক চোট শ্রাবণী বৃষ্টি খুব দরকার, যেটা জমে থাকা বারুদের স্তূপটাকে একেবারে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
ও চায় মা ওর সাথে রঙ দিয়ে আলপনা আঁকুক। নীল রঙটাকে শুধু ও বাদ রাখবে। লাল-হলুদ-কমলা রঙে তুলি ডুবিয়ে একটা বড় সূর্য আঁকবে। আর সবুজে সবুজ করে ক্যানভাস ভরে যাবে নতুন নতুন পাতায়। তুলিটা ওর হাত থেকে মা নেবে, কিন্তু কবে?
মায়ের চিৎকার আবার কানে যেতেই অনু ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে চটি গলিয়ে "মা আসছি..." বলে বেরিয়ে যায়। অনুর খাবারটা টেবিলে পড়ে থাকে, মা দরজার দিকে অনুর যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে। অনুর অনুভূতিগুলোও অনুর মন ধরে হাঁটতে থাকে।
চিত্রঃ লেখায় ব্যবহৃত ছবিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) ব্যবহার করে কাল্পনিকভাবে তৈরি।