প্রবন্ধ

তুমি কৈকেয়ী [পুস্তক আলোচনা] (চতুর্থ পর্ব)



কাকলী দেব


।। ৪ ।।

এলেন রাজা, তার লোক লস্কর, নিয়ে! তাকে রাজকীয় সম্মান জানিয়ে অভ্যর্থনা করা হল। তোমার প্রিয় দাসী এসে তোমাকে খবর দিল। লোকমুখে তুমি শুনেছো, তার আসল নাম হচ্ছে, 'নেমি', পিতা অজ এবং মা ইন্দুমতী র ছেলে। পরবর্তী কালে, পরাক্রমী যোদ্ধা বলে এবং রথ চালনায় নিপুনতার কারণে, 'দশরথ' নামে খ্যাত হন।

তোমাকে সাজগোজ করানোর জন্য প্রাসাদের দক্ষ দাসীরা এল। এতকাল তুমি, নিজের সাজসজ্জার ব্যাপারে ছিলে উদাসীন। কোনরকম অঙ্গ সজ্জাকেই বাহুল্য মনে করেছ।

আজ তোমার পরনে মহার্ঘ্য লাল সিল্কের কাপড়! তোমার লম্বা কালো একরাশ চুল বেশীরভাগ সময়ই চূড়ো করে বাঁধা থাকত, আজ তা মনোহারী বেনীর আকারে সজ্জিত! রাশি রাশি গয়নায় ঢেকে গেল তোমার অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ, শরীর! চোখে দেওয়া হল ঘন করে কালো সূর্মা, ঠোঁটে গাঢ় লাল রঙ! এতদিনের শরীর চর্চার ফল হিসেবে, ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে,অন্য নরম সরম রমনীরা, গয়নার ভারেই নুব্জ হয়ে যেত!

দর্পনের সামনে এসে, যেন নিজেকেই অচেনা ঠেকল! অপূর্ব সুন্দরী এক নারীকে দেখলে! সভাকক্ষ আলো করে রাজা দশরথ, পারিষদগন, রাজা অশ্বপতি, তার গোটা মন্ত্রী, অমাত্য গন বসে আছেন। দ্বাররক্ষী তোমার সভায় প্রবেশের কথা ঘোষনা করল! তুমি দৃপ্ত ভঙ্গীতে সভাকক্ষে প্রবেশ করলে। সবচেয়ে প্রথমে তুমি লক্ষ্য করলে, দশরথ তোমার, পিতার থেকে বয়সে অনেক ছোট! নমনীয় অথচ ব্যাক্তিত্ব পূর্ণ চেহারা তার। তুমি প্রথমে বাবাকে, তারপর তোমার সম্ভাব্য ভাবী স্বামীকে অভিবাদন করলে। যুধাজিত উদ্বিগ্ন মুখে পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তুমি চোখের ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করলে, এই বলে যে, আজ পর্যন্ত কৈকেয়ী যেমন সবার সমস্ত কথা মেনে চলেছে, আজও তার অন্যথা হবেনা।

কিন্ত হঠাৎই তোমার মনে হল, 'এত সহজে কেন আমি ধরা দেব? কি নেই আমার? আমার রূপ আছে, মন্থরার বর্ণনা অনুযায়ী, আমি সর্বগুনান্বিতা, আমি শাস্ত্র এবং শস্ত্র দুই বিদ্যায় পারদর্শিনী। তাহলে এত সহজেই কি আমাকে পাওয়া যায়?'

বাবা, সভায় উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ্য করে দশরথের ভূয়সী প্রশংসা করলো, তারপর তোমার দিকে ফিরে বলল," রাজা, তোমার পানিগ্রহনে ইচ্ছুক, তোমার সম্মতি জানাও।" সভাস্থ সমস্ত দর্শককে উপেক্ষা করে তুমি আচমকা সরাসরি দশরথকেই নম্র কন্ঠে জিজ্ঞেস করলে, "মহামান্য রাজা, আপনি তো আমাকে তৃতীয় স্ত্রী হিসেবে পেতে চান, তাই না?" রাজা অবাক হলেও, তা দেখালেন না, বললেন, "হ্যাঁ, দেবী।" আবারও প্রশ্ন করলে তুমি, নিজেও অবাক হলে, এত সাহস হঠাৎ কী করে হচ্ছে ভেবে! "আপনার কোনও পুত্র সন্তান হয়নি এখনও, তাই তো?" দশরথ এবার একটু কাছে এগিয়ে এলেন যেন, আস্তে করে বললেন, "হ্যাঁ, দেবী।"

বাবার হতবাক, ক্রুদ্ধ মুখের দিকে আড়চোখে দেখে নিয়ে আবারও বললে, "তাহলে আমার একটা শর্ত আছে। আমার যদি পুত্র সন্তান হয়, তবে আপনার পরে সেই হবে অযোধ্যার রাজা। যদিও আমি আপনার তিন নম্বর স্ত্রী হব, আর আপনার অন্য রাণীদেরও পুত্র সন্তান হতে পারে পরে, কিন্ত এই শর্তে রাজী থাকলে, তবেই আমি আপনার পাণিগ্রহন করব।" তোমার হাতের তালু ঘেমে উঠছে, শরীরটা যেন থরথর করে কাঁপছে, কোন সাহসে ভর করে যে এসব কথা বলে ফেললে তা নিজেও বুঝতে পারছনা। এর পরিনাম কী হতে চলেছে, তাও জানো না। সভাসুদ্ধ সকলের অবাক চোখের সামনে ঘটে গেল ঘটনাটা!

একটা পিন পড়লেও শব্দ শোনা যাবে, এমন সময় রাজা বলে উঠলেন, "তাই হবে দেবী, যেমনটা তুমি চাও।" রাজার দয়ালু চোখের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে তুমি বললে, "তাহলে, আমি আপনার।"

সভাস্থলের চারিদিকে জয়ধ্বনি উঠল, তুমি পাশে দাঁড়ানো দাসীর হাতের বরণডালা থেকে বরমাল্য তুলে নিয়ে রাজার গলায় পরিয়ে দিলে। রাজা অশ্বপতি অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তোমাদের দুজনকেই জড়িয়ে ধরল। যুধাজিত এবং অন্য ভাইরা সবাই তোমাদের ঘিরে ধরে আনন্দ প্রকাশ করল!

রাজা দশরথের সঙ্গে তোমার বিবাহের যজ্ঞ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হল। দুই দেশের পুরোহিত গণ নিজের নিজের জ্ঞান, বুদ্ধি, পরম্পরা প্রদর্শন করলেন।

দশরথকে, অতিথি মহলে বিশ্রাম কক্ষে নিয়ে যাওয়া হল। আর তুমি শেষবারের মত নিজের ঘরে, নিজের বিছানায় তোমার ক্লান্ত দেহ এলিয়ে দিলে। খুব কম সময়ে তোমার জীবনে অনেক ঘটনা ঘটে গেল। মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে তোমার! মন্থরা তোমাকে যেমন ভাবে ঋতুমতী হবার পরে যা যা করণীয় সবই বুঝিয়ে দিয়েছিল, গত কয়েক দিন ধরে তেমনই, বিবাহ পরবর্তী স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে তোমাকে তৈরী করতে চাইছিল। নিজে অবিবাহিত হয়েও, তার পক্ষে এই কাজ দুরূহ মনে হয়নি। কিন্ত হয়তো মা, থাকলে নিজের ভয়, উদ্বেগ আরও একটু হালকা হত! তবে তোমার জীবনে মন্থরার অনুপস্থিতি তুমি ভাবতেও পারোনা। তাই মন্থরা তোমার সঙ্গেই অযোধ্যা যাবে, এমনটা তুমি নিজের মনে ভেবে রেখেছো। আগামীকাল এই ব্যাপারে দুই রাজারই অনুমতি নিতে হবে। পুরুষের অনুমতি ছাড়া তো নারীর এক পা এগনো সম্ভব নয়!

কালকে শেষ বারের মত একবার নিচের গ্রন্থাগারের পুঁথিগুলোর থেকে কিছু তার সংগ্রহে নিয়ে যেতে হবে। তার প্রিয়, ছাই রঙের ঘোড়াকে আদর করে দিয়ে আসতে হবে আস্তাবলে গিয়ে! ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে তোমার, এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল, আলতো করে দরজা খুলে মুখ বাড়ালো যুধাজিত! তুমি উঠে বসলে, সত্যিই তো যুধাজিতের সঙ্গে একবার শেষবারের মত মন প্রাণ খুলে কথা না বলে কি কেকয়া ছেড়ে চলে যাওয়া যায়?

 

গ্রন্থের নামঃ কৈকেয়ী (Kaikeyi: A Novel)
লেখিকাঃ বৈষ্ণবী প্যাটেল (Vaishnavi Patel)
ভাষাঃ ইংরাজী
প্রকাশকঃ রেডহুক (Redhook)
বাঁধাইঃ পেপারব্যাক
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৫১২ পাতা
মুদ্রিত মূল্য (ভারতীয় মুদ্রায়): ১,৭৩৪ টাকা

(ক্রমশ)