পিতলের সানকিতে কামিনীসরু কিম্বা জিরাভোগ চালের ভাত, চারধার দিয়ে পাঁচ-সাত রকমের ভাজা-ভুজি আর সানকির চারধার দিয়ে অগুন্তি পিতলের বাটিতে নানান পদের রান্না যার সামনে, সে নিশ্চয়ই শাশুড়ির অতি আদরের জামাই-রাজা - তা বুঝতে আর কারো দেরি হবার কথা নয়। আদর করে এত খাবার দিয়েও শাশুড়ির তৃপ্তি হয়না, যতক্ষণ-না তিনি একটা তালপাতার পাখা নিয়ে একটা পিঁড়িতে বসে হাওয়া করছেন আদরের জামাইকে। না, শুধু জামাই সেবাই নয়, প্রতিদিন খাবার সাজিয়ে দিয়ে সব স্ত্রীরাই তাঁর স্বামী সন্তানকে তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করছেন - এটা অতি পরিচিত ঘরোয়া দৃশ্য। বা বলতে পারি বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গ। তো এই বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গ এই হাতপাখা নিয়েই আজকের আলোচনা করব।
হাতপাখা তৈরির মূল উপাদান তালপাতা। পশ্চিমবঙ্গে বিশেষত গ্রামবাংলায় তালগাছের অভাব নেই। একসময় বড় বড় দীঘির পাড় দিয়ে সারি সারি তালগাছ দেখা যেত। অনেক গ্রাম আছে যেখানে পুকুরের নামকরণ করা হয়েছিল তালগাছ দিয়ে - তালপুকুর, তালদীঘি ইত্যাদি। সুতরাং বলা যেতেই পারে, তালপাতার পাখা তৈরির কাঁচামালের অভাব কোন সময়েই ছিল না। যদিও এখন পাখা তৈরির ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের সিটের বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারণ গ্রামের দিকে আগের মত আর তালগাছ সহজলভ্য নয়। ক্রমশঃ গজিয়ে ওঠা ইটভাঁটা ও মাছের ভেড়ির জন্য নির্বিচারে তালগাছ কাটা পড়ছে।
যাইহোক, তালপাতার পাখা অর্থাৎ তালপাখা তৈরি করতে প্রথম এবং প্রধান উপকরণ তালপাতা। এছাড়াও লাগে বাঁশ আর কাপড়। শৌখিন তালপাতার পাখা তৈরিতে রঙিন সুতো ব্যবহার করা হয়। তালগাছের গোল-গোল পাতা দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন তাঁর ‘তালগাছ' কবিতাটি।
“তালগাছ -
এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে।
* * *
তাই তো সে ঠিক তার মাথাতে
গোল গোল পাতাতে
ইচ্ছেটি মেলে তার।”
দশ থেকে বারো বছর বয়সি তালগাছের নরম পাতা কেটে গোল করে নেওয়া হয়। এরপর কাঁচা তালপাতাকে শুকিয়ে নেওয়ার আগে পাথর, ইট ও জাঁতার মতো ভারী বস্তু পাতার ওপর চাপিয়ে কিছুদিনের জন্য ফেলে রাখতে হয়। এই পদ্ধতির নাম জাঁক দেওয়া। জাঁক না দিলে পাখা তৈরী করা যাবেনা। তালপাতার পাখা এমনিতে বেশ ঢেউ খেলানো। তাই জাঁক দেওয়ার মাধ্যমে ঢেউ খেলানো তলকে সমান করে নেওয়া হয়। শুকিয়ে গেলে আর সমান করা যাবে না। পাতার গোড়াতে যে ডাঁটি থাকে তাকে সমান করে কেটে নিয়ে পাখার হাতল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পাতার ওপরের তল সমান হয়ে গেলে গোল করে চারদিকটা কেটে সমান করে নিলেই মোটামুটি হাতপাখা তৈরির কাজ শেষ। তারপর লাল শালু দিয়ে পাখার চারধার ঝালরের মতো করে সুতো আর বাঁশের কাঠি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়।
এছাড়াও খেজুর পাতা দিয়েও পাখা তৈরি করা যায়। চাটাই যেভাবে বোনা হয় সেইভাবে গোল, আয়তক্ষেত্রাকার, বর্গাকার বিভিন্নভাবে খেজুর পাতা বুনে নিয়ে বাঁশ দিয়ে তৈরি বাতার মাধ্যমে হাতল প্রস্তুত করা হয়। এক ধরনের বাঁশ আছে, যার ভিতর দিকটা ফাঁপা ও ফাঁকা। এই বাঁশকে বলা হয় ‘মুলি বাঁশ।' পূর্ববঙ্গে বলে ‘নলি বাঁশ।' এই বাঁশ পূর্ববঙ্গে বেশি জন্মায়। পশ্চিমবাংলাতে উত্তরবঙ্গে এই বাঁশ দেখা যায়। এছাড়াও অসম, ত্রিপুরাতেও দেখা যায়। হাতপাখার হাতল হিসেবে এই ফাঁপা ও ছোট বাঁশের চাহিদা খুব।
হাতে তৈরি এই হাতপাখা নানা রকমের দেখতে পাওয়া যায়। সাধারণ হাতপাখা ছাড়াও আছে রিভলভিং পাখা, ফোল্ডিং পাখা, নকসি পাখা, সুতোর পাখা, ময়ূর পালকের পাখা ইত্যাদি।
হাতপাখার হাওয়া খেতে হাতকেই এদিক-ওদিক ঘোরাতে হয়। যদি সরু বাঁশের তৈরি হাতল ব্যবহার করা যায় তাহলে হাতকে এক জায়গায় স্থির রেখে ৩৬০° পর্যন্ত ঘোরানো যায়। এই পাখার হ্যান্ডেলটা একটা সরু নলের মধ্যে ঢোকানো থাকে। এই ধরণের বাঁশের হাতলের সাহায্যে একসঙ্গে অনেকে হাওয়া খেতে পারেন।
মনে পড়ে যায়, ছোটবেলার গরমের দিনগুলির কথা। তখনও আমাদের বাড়িতে বিজলিবাতি আসেনি। গরমের দিনে একমাত্র অবলম্বন ছিল হাতপাখা। মাদুর পেতে গ্রীষ্মাবকাশের দিনগুলিতে দুপুরবেলায় মাটির দালানে। আমার ঠাকুরমা ক্রমাগত হাওয়া করে যেতেন। সেই মধুরতম স্মৃতি আজও আমার চোখের সামনে ভেসে আসে। মনে হয় এইতো সেই দিন! সেইসব সোনালি অতীত দিনের কথা স্মৃতির ফ্রেমে বন্দি হয়ে আছে। হাওয়া খাওয়ার কাড়াকাড়ি হতো আমার ভাই আর আমার মধ্যে। মাঝেমাঝে পাড়ার ডানপিটে ছেলে ব্যোমকেশও আসত এই হাওয়া খাওয়ার কাড়াকাড়ির মধ্যে। সেইসব খুনসুটি আজকের দিনে আর দেখতে পাওয়া যায় না। তালপাতা বা খেঁজুর পাতার হাত-পাখার হাওয়া ছিল একসময়ে দুপুরের ভাতঘুমের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
তালপাতার পাখার ওপর কারুকার্য করার চল বহুদিনের। সুন্দর হস্তাক্ষরে পাখার ওপর নানারকমের শ্লোক, কবিতা, ছড়া, গানের কলি, মহাপুরুষদের উক্তি লেখা হতো একসময়। এছাড়াও পাখার ওপরের অংশে ফুল, পাখি, ফল, পাতা প্রভৃতির ছবি আঁকা থাকত। তবে বর্তমানে এসি সর্বস্ব যুগে তালপাতার পাখার প্রচলন আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে।
ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে দেখা যাক, মোগল আমলের বহু চিত্রতে দেখা যায় সম্রাট বসে আছেন তাঁর সিংহাসনে। সিংহাসনের দু'পাশে দাঁড়িয়ে আছে দু'জন পাখাধারী মানুষ। তাদের হাতে ধরা আছে বড় পাখা। সম্রাট আরামে শাসনকার্য পরিচালনা করছেন। পর্তুগিজরা প্রথম দিকে একধরণের পাখার উদ্ভাবন করেছিল যা পরবর্তী সময়ে ইংরেজরা ভারতবর্ষ শাসন করতে এসে সেই পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন। পদ্ধতিটি হল, ঘরের সিলিং থেকে মোটা কাঠের সঙ্গে বাঁধা কাপড়ের ঝালরকে ঝুলিয়ে রেখে দড়ি দিয়ে বেঁধে চাকা ও পুলির সাহায্যে দোলানো হতো। বাইরের বারান্দায় বসে এক ব্যক্তি সারাদিন সেই দড়িকে টেনে যেত আর ঝালরের পাখার হাওয়ায় সাহেবের চোখে নেমে আসত দিবানিদ্রা। কাজ রসাতলে যেত। সাহেবদের দেখাদেখি কলকাতার বাবু সম্প্রদায়ের ভিতরেও এই বিলাসিতার চিত্র দেখতে পাওয়া যায়।
তালপাতার পাখার প্রচলন ঠিক কবে ঘটেছিল এবং এই পাখার স্রষ্টা কে তার কোনও প্রামান্য ইতিহাস নেই। বৈদিক যুগে আশ্রমিকরা তালপাতার পুঁথি তৈরি করতে নিমগ্ন ছিলেন। মনে হয়, তাদের শরীর ও মনে শীতলতা এনে দিত তালপাতার হাতপাখা। বৈদ্যুতিক পাখার প্রচলন তো এই সেইদিনের কথা বা ঘটনা বলা যেতে পারে। আমরা ভারতীয়রা ক্রান্তীয় মৌসুমী অঞ্চলে বসবাস করি। তাই এই অঞ্চলের মানুষদের ঠান্ডা বাতাস দিয়ে ক্লান্তি দূর করে আসছে তালপাতার পাখা।
প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এখনও হয়তো বা আটচালা চন্ডীমন্ডপ বা দুর্গামন্ডপ আছে। আজও গ্রীষ্মের দিনে সেইখানে বসে বয়ঃজ্যেষ্ঠদের মজলিস। দুপুরবেলা বা সন্ধ্যার সময় তাস, দাবা বা বৈঠকী গল্পের আসর বসে। প্রত্যেকের হাতে থাকে তালপাতার পাখা। ঠান্ডা হাওয়া তাঁদের মনে ও দেহে এনে দেয় এক সুখকর অনুভূতি। যে অনুভূতি ভাষাতে প্রকাশ করা যাবে না। ছোটবেলাতে বাবা-মা'র হাতে পাখার বাটের মার খায়নি এমন ছেলে-মেয়ে খুব কমই আছে। একসময় রান্নাঘরে দেখা যেত তালপাতার ভাঙা পাখা, যা একসময় মা-ঠাকুমারা ব্যবহার করতেন উনুনের আঁচ তোলার ক্ষেত্রে।
এই বৈদ্যুতিক-বিপ্লবের যুগেও হাতপাখার ভূমিকা অপরিসীম। রাতে-দিনে যখন-তখন লোডশেডিং একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এই সময় যখন গরমে প্রাণ হাসফাস করে ওঠে তখন খোঁজ পড়ে অনাদরে ফেলে রাখা ভাঙা-চোরা হাতপাখাটির। এর আরও একটি সুবিধা হল একে হাতে নিয়ে যেখানে খুশি চলে যাওয়া যায়।
বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে তালপাতার পাখা প্রবেশ করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ’ঘরে-বাইরে' উপন্যাসে দেখা মেলে তালপাতার পাখার। শোনা যাক ঘটনাটি - "মা যখন বাবার জন্যে বিশেষ করে খোসা ছাড়িয়ে সাদা পাথরের রেকাবিতে জলখাবার গুছিয়ে দিতেন, বাবার জন্যে পানগুলি বিশেষ করে কেওড়া জলের ছিটে দেওয়া কাপড়ের টুকরোয় আলাদা জড়িয়ে রাখতেন, তিনি খেতে বসলে তালপাতার পাখা নিয়ে আস্তে আস্তে মাছি তাড়িয়ে দিতেন, তাঁর সেই লক্ষীর হাতের আদর, তাঁর সেই হৃদয়ের সুধারসের ধারা কোন অপরূপ রূপের সমুদ্রে গিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়ত সে যে আমার সেই ছেলেবেলাতেও মনের মধ্যে বুঝতুম।"
চলচ্চিত্র জগতেও বেশ কিছু তালপাতার পাখার দৃশ্য দেখা যায়। '৭৪৷৷ (সাড়ে চুয়াত্তর)'- এ আমরা দেখতে পাই একটি অপরূপ দৃশ্য। খাটের উপর বসে আছেন তুলসী চক্রবর্তী, হাতে তাঁর একটি হাতপাখা। দ্রুততার সঙ্গে হাতপাখা নেড়ে চলেছেন আর অন্য দিকে অভিমানী মলিনা দেবীর উদ্দেশ্যে তিনি কথা ছুঁড়ে দিচ্ছেন। এইভাবে তিনি হাতপাখার মাধ্যমে একটি হাস্যরসের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন 'সাড়ে ৭৪'-এ।
হাতপাখা তৈরির সঙ্গে যুক্ত নদিয়া, দুই ২৪ পরগনা, দুই মেদিনীপুর জেলা, পুরুলিয়া, হুগলি জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষেরা। পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক থানার একটি গ্রামের নাম পাখা-গ্রাম। আসলে এর নাম পাকুড়িয়া। কিন্তু এই গ্রামের অধিকাংশ মানুষের জীবিকা চলে পাখা তৈরি করে, তাই এর এমন নাম। সারা বছর ধরে শিল্পীরা সৃষ্টি করেন তালপাতা, খেজুর পাতার হাতপাখা।
ছোটবেলাতে দেখেছি গরমের দিনে হাটে বিকেলবেলায় হাতপাখা বিক্রি হতো। আর বিক্রি হতো যে-কোনো মেলায়। যারাই মেলা থেকে ফিরতো তাদের হাতে আর কিছু না-থাক অবশ্যই একটা পাখা থাকতো। কিন্তু সে সব এখন স্মৃতি। পাড়ায়-পাড়ায় দুপুরবেলাতে পাখা বিক্রি করে গৃহস্থকে শীতল বাতাস যেন সরবরাহ করতেন পাখা বিক্রেতারা।
তালপাতার পাখার শৈল্পিক দিককে তুলে ধরা যেতেই পারে সরকারের পক্ষ থেকে। পাখাশিল্প একটি কুটীর শিল্প। যদি শৈল্পিক দিকটা তুলে ধরা যায় তাহলে গ্রামীণ কর্মসংস্থানের উপায় ভালোভাবেই হতে পারে। আর্টওয়ার্ক হিসেবে হাতপাখাকে তুলে ধরাই যায়। গতিময় ভোগসর্বস্ব যুগে সবাই আমরা এসি-র ঠান্ডা হাওয়াতেই মজে আছি তাই ধীরগতির তালপাতার পাখার হাওয়াতে আর সুখ নেই। মনোকষ্ট থেকে বলা যেতেই পারে - "তালপাতার পাখা তোমার দিন গিয়াছে।" মেঝের ওপর হাতে তৈরি মখমলের আসন পেতে প্রিয়জনকে পাখার বাতাস করে খাওয়ানোর চিরাচরিত চিত্র আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ। সেই অঙ্গহানি ঘটেছে বেশ কিছু যুগ আগেই। তালপাতা, খেজুরপাতার পাখার ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেলে চিরতরে একটি সংস্কৃতি লুপ্ত হয়ে যাবে। তাই পাখা-শিল্পীদের জীবিকার কথা ভেবেই হাতপাখাকে বাঁচিয়ে রাখা সরকারের কর্তব্য। তাই বলি নতুন আঙ্গিকে স্বপ্নের উড়ানে ডানা মেলুক হাতপাখা। কেননা এত মিঠে-হাওয়া আর কিছুতেই মেলেনা।
চিত্রঋণঃ ১) গ্রাফিক্সঃ গৌরব মুখোপাধ্যায়, ২) অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।