বিবিধ

কৃষ্ণনগরে কাজী (দ্বাদশ পর্ব) [ধারাবাহিক]



ইনাস উদ্দীন


[১৯২৬ সালের জানুয়ারির ৩ তারিখে কবি সপরিবার কৃষ্ণনগর এসেছিলেন, এনেছিলেন হেমন্তকুমার সরকার। কবিকে কেন এনেছিলেন তিনি? শুধুই বন্ধু বলে? প্রতিভাবান কবি বলে? মাস ছয়-সাতেক গোলাপট্টিতে থেকে কবি গ্রেস কটেজে আসেন। ঠিক কবে আসেন তিনি? জুলাই, নাকি আগস্ট? কেনই বা এলেন এই বাড়িতে? ভীষণ দারিদ্র্যের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে নির্জন এক প্রান্তে? অনেক কিছুই আমরা জানি না, জানাও যায় না। এখান-ওখান থেকে জোগাড় করা তথ্য আর তার সাথে খানিক অনুমান মিশিয়ে টুকরো কথার কিছু দৃশ্য সাজিয়ে তোলার চেষ্টা এই কাহিনীতে।]

পর্ব - ১২

কাজীদাদা ঘুরতে যাবেন শুনে কাশেম আলি দ্বিগুণ উদ্দীপ্ত। এমনিতেই সে সদা চঞ্চল। মুখের কথাও তার ঘোড়ার মতো টগবগিয়ে ছোটে - সেকথা দরকারের চেয়ে তিনগুণ অদরকারি।

মঘার আবার সবকিছুতেই একটা গা-জোয়ারি ভাব, কথার মধ্যে একটা কর্তৃত্বের স্বর প্রকাশ পায়। হেমন্তদাকেও বলা নেই, বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে সটান কাশেম আলিকে বলল, কাকা তোমার সারেঙ্গিকে রেডি কর। কাজীদাকে একটু ঘুরিয়ে আনি।

- সারেঙ্গি আমার সবসময় রেডি। তার উপর আমাদের কাজীদাদা ঘুরতে যাবে, দেখো সারেঙ্গি কেমন নাচতে নাচতে ছোটে।

- আর বোলোনা তোমার সারেঙ্গির কেরদানি। চারজনের জায়গায় পাঁচজন হলেই ওর পা ওঠেনা, ঘাড় বেঁকিয়ে যায়।

- ওসব মেয়েমানুষের ছলাকলা গো বাপু, তোমরা বুঝবা না! সওয়ারী পছন্দ না হলে ওরকম করে। এই যে ভোরবেলা বাগআঁচড়া ঠেলে এসছি, বললে আরও তিনবার ও বাগআঁচড়া ঘুরিয়ে আনতে পারে।

স্লিম চেহারার স্ত্রী-ঘোড়াটির পক্ষে কাশেম আলির সওয়াল শুনে নজরুল হো হো করে হেসে উঠলেন। কাশেম ভাই, আপনার ঘোড়া, মানে সারেঙ্গি সওয়ার চিনতে পারে? আর সারেঙ্গি নামটাই বা এলো কী করে?

গোলাপট্টি থেকে গাড়ির মুখ ঘোরাতে ঘোরাতে কাশেম আলি তার ঘোটকীর জন্মকাহিনী সহ নানান বৃত্তান্ত শুনিয়ে দিলেন। বাবাও ঘোড়ার গাড়ি চালাতেন। নেশা ছিল সারেঙ্গি বাজানো, নেদেরপাড়ার যাত্রা-থেটারে বাজিয়ে বেড়াতেন। জন্মের পর থেকেই সারেঙ্গি ছিল বাবার খুব নেওটা। গাড়ি জুড়লে সেও পিছন পিছন যাবে। মা বলত এ আরেক সারেঙ্গি।

- কাকা, কোনদিক দিয়ে ঘুরি বলো তো? চার্চের পাশ দিয়ে চাঁদসড়ক হয়ে রায়পাড়া আনন্দময়ীতলা হয়ে একেবারে রাজবাড়ি ঘুরে আসব।

- গোয়াড়ি-কেশনগর তো আছেই, কোম্পানি বাগান দেখতে হবে না? বেরিয়েছি যখন সবটা ঘুরে আসব।

টুংটাং করতে করতে গাড়ি জলঙ্গীর পাড় ঘেঁষে চলতে থাকে। এখানে সবাই বলে খ'ড়ে নদী। শীতের ঝিকিমিকি রোদ্দুর গায়ে মেখে বয়ে চলা শান্ত স্রোতস্বিনীটিকে ভারি পছন্দ হলো নজরুলের। আসলে সুন্দরের পিয়াসী মন - যাকে ভালো লাগে তার জন্য মুগ্ধতায় আর কৃপণতা থাকে না। এপাশে চাপড়া তেহট্ট ওপাশে পলাশী অগ্রদ্বীপ কাটোয়ার লোকে নবদ্বীপ ঘুরে খ'ড়ে ধরে গোয়াড়ি বাজারে আসে। কেশনগর তো রাজার তৈরি, তার সীমানা ঐ আমিনবাজার নেদেরপাড়া পর্যন্ত। নদীর ধারের এই এলাকায় তো গরু চরত, তাই নাম হয়েছে গোয়াড়ি। কাশেম আলির বকবকের ফাঁকে ফাঁকে মঘা মাঝে মাঝে ইতিহাসের কথা ব্যাখ্যা করে শোনায়। পলাশীর যুদ্ধের আগে থেকেই কেশনগর ছিল ইংরাজদের ঘাঁটি। গোয়াড়ির পশ্চিম দিকটায় তারা ঘরবাড়ি অফিস-কাছারি বানিয়েছে, গির্জা বানিয়েছে।

মালোপাড়ার পাশ দিয়ে গাড়ি কলেজের মাঠে এসে পড়ল। টালি আর টিনের ছাপরা দেওয়া ঘরবাড়ি।

- কাজীদা, মালোপাড়ার সঙ খুব বিখ্যাত। চড়কে, জগদ্ধাত্রীর ঘট বিসর্জনের সময় মালোপাড়ার সঙ বেরোয়। নতুন নতুন গান বাঁধে, সঙ সেজে ঢোলক বাজিয়ে গেয়ে বেড়ায়, মঘা বলে।

নজরুল বলেন - তাই নাকি? দেখতে হবে তো?

ইতিমধ্যে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়লে মঘা বলে - কাকা, দাঁড়ালে কেন? একেবারে খ্যাপা সাহেবের বাড়ির সামনে চলো।

'দাদাবাবুর নাইট স্কুলটা দেখাই'। রাস্তার ডানপাশে একটা একতলা বাড়ি দেখিয়ে কাশেম আলি বলেন - 'দাদাবাবু আর সুভাষ বাবু মিলে নাইট স্কুলটা বানিয়েছেন'। বিস্মিত নজরুল বললেন - সুভাষ বাবু এইখানে নাইট স্কুল বানিয়েছেন?

- তখন সুভাষবাবু কেশনগরেই বেশি থাকতেন গো কাজীদাদা। দাদাবাবুর সাথে তো সন্ন্যাসী হয়ে দুইজনে তো জঙ্গলে না পাহাড়ে অনেকদিন পালিয়ে গেছিলেন! তা ওকে তো ইংরাজরা কোথায় কোন কালাপানিতে নাকি জেলে আটকে রেখেছে।

'হ্যাঁ, মান্দালয় জেলে', নজরুল বলেন। 'তা এখন কি চলছে স্কুল?'

- কী করে চলবে? হেমন্তদার সময় কই? এতো ব্যস্ত। এখন চাষাপাড়ায় তারকদা নাইট স্কুল চালাচ্ছে। সেখানেই এখন আমাদের আড্ডাখানা।

পাশেই লালরঙের রেলিং ঘেরা খ্যাপা সাহেবের বাংলো বাড়ি, সেকালের সাহেবি কেতায় বানানো বেশ বড়সড়ই বাড়িটা। মঘা জানালো ওটা স্যার উইলিয়াম জোন্স সাহেবের বাড়ি। ১৭৮৫ সাল নাগাদ উনি বাড়িটি কিনেছিলেন।

- কিনেছিলেন? তার মানে, তার আগে থেকেই এরকম বাড়ি ছিল? সেসব বাড়ি আবার বিক্রিবাটাও হতো? নজরুল আশ্চর্য হলেন।

মঘা বলে, পুরো নদীয়াকেই তো নীলকর সাহেবেরা শোষণ করে অত্যাচার করে ছিবড়ে করে দিয়ে গেছে। ওরা তো পুরো শহরই বসিয়েছিল এখানে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি জোন্স সাহেব ১৭৮৫ সালে কৃষ্ণনগর আসেন সংস্কৃত শিখতে। টোলের পণ্ডিতরা ম্লেচ্ছকে সংস্কৃত শেখাতে কেউ রাজি হয়নি। এলাকা ছেড়ে ভয়ে কেউ কেউ নাকি লুকিয়ে পড়েছিল। এর আগে কাশীও গিয়েছিলেন, সেখানেও এক অবস্থা। শোনা যায় শেষমেশ রামলোচন নামে এক পণ্ডিত সাহেবকে সংস্কৃত শেখাতে রাজি হন। কোর্টের ছুটিছাটা আর ফাঁকে ফাঁকে প্রায়ই তিনি এখানে চলে আসতেন। পাঁচ কি ছয়বছর একনাগাড়ে তিনি সংস্কৃত শেখেন। মেমসাহেব নাকি খ'ড়ের ধারে বসে ছবি আঁকত। এসব খ্যাপামির জন্য বাড়িটাই খ্যাপা সাহেবের বাড়ি হয়ে গিয়েছে।

বাংলার ভেতর এরকম পুরো সাহেবপাড়া কলকাতাতেও বোধহয় পাওয়া মুশকিল। নজরুল বিস্ময় প্রকাশ করেন।

ঠিকই তাই। এই আশপাশের পাড়াগুলোয় বেশিরভাগই খ্রিস্টান। মঘা বলে। ওদের কাজ করতে আসা গরিবগুর্বো মানুষগুলোকে প্রলোভন দেখিয়ে ওরা খ্রিস্টান বানিয়ে দিত।

- এদিকটা ছিটেন পাড়া, আর ওদিকটা ওমান-কাতলি? কাশেম আলি যোগ করে।

- মানে? নজরুল বিস্ময় প্রকাশ করেন।

মঘা বুঝিয়ে বলে যে কলেজ মাঠের এপাশটায় প্রোটেসট্যান্ট খ্রিস্টানদের আধিক্য - সেটা হয়েছে ছিটেন পাড়া। ওপাশটা পুরনো, রোমান ক্যাথলিকদের বিশাল এলাকা, বিশপ থাকেন। ওটা লোকের মুখে হয়েছে ওমান-কাতলি।

জজ সাহেবের বাংলো, কালেকটারের বাংলো, পুলিশ সুপারের বাংলো - বাড়িগুলো যে খুব বিশাল তা নয়, কিন্তু একেকটি বাড়ি যেন দুর্গম এবং বিশাল জঙ্গলে ঘেরা। রাস্তায় লালমুখো সাহেবদের ঘোরাঘুরি। আক্ষরিক অর্থেই সাহেবদের এলাকা। সেসব ছাড়িয়ে কাশেমের গাড়ি গিয়ে ঢুকল এক বিশাল আম-কাঁঠালের বাগানে - কোম্পানি বাগান। কোম্পানি আমলে এখানে নাকি ঘোড়ার রেস হতো, পোলো খেলাও হতো। কাশেম আলি বিজ্ঞের মতো বর্ণনা করেন - পলাশীতে যাওয়ার আগে ক্লাইভের সৈন্যরা তো এখানেই ঘাঁটি গেড়েছিল।

প্রমোদরঞ্জন কিছুটা বিরক্ত। এই বাগান আর ইংরাজদের রাজত্বের ইতিহাস দেখে কী হবে? 'কাকা, বাগান-টাগান আর ঘুরতে হবে না, শহরে ফিরে চলো'। নজরুল অবশ্য অখুশি নন, শীতের দুপুরে এই ঘোরাঘুরিটা তিনি ভালোই উপভোগ করছেন। বললেন, বেশ তো লাগছে রে মঘা, শহরের ইঁট-কাঠ তো রোজই দেখি। কত রকমের পাখি দেখেছিস? একটু কান পেতে শোন, মনে হবে গাছের সাথে, পাতার সাথে ওরা কথা বলছে, গান করছে, আড্ডা দিচ্ছে।

- আপনি কবি মানুষ দাদা। ওসব উচ্চমার্গের অনুভূতি। আমরা কি আর ওসব বুঝি?

- বুঝতে লাগে না রে! এর মধ্যে বোঝাবুঝির কিছু নেই। এই গাছপালা, পাখির ডাক, নির্জনতা - সবগুলোকে একটা জীবন্ত সত্ত্বা বলে ভাব, একটু অনুভবের চেষ্টা কর। দেখবি তোর ভিতরেও ভালো লাগা তৈরি হচ্ছে। সে ভালো লাগা সবসময় যে খুব সুখের মনে হবে তা নয়, একটা দুঃখের অনুভূতি, একটা বেদনাময় ভালো লাগা।

- দুঃখের সঙ্গে ভালো লাগা? কী জানি, সে কিভাবে হয়। সেটা বুঝলে তো আমিও আপনার মতো কবি হয়ে যেতাম। যাইহোক, এবারে ফিরতে হবে। বৌদি কিন্তু দুপুরের আগে ফিরতে বলে দিয়েছেন।

নজরুল হাসলেন। প্রকৃতির জগত থেকে যেন বাস্তবের সংসারে ফিরে এলেন। বললেন, হ্যাঁ, কাশেম ভাই, চলো ফেরা যাক।

ফেরার পথে মোংলাপুকুর যুগীপাড়া হয়ে গির্জার পথ ধরেছে কাশেমের সারেঙ্গি। ঘাট বাঁধানো পুকুরটা দেখে মনে হলো এক্ষুনি নেমে খানিক সাঁতার কেটে আসি। নজরুলের উৎসাহ দেখে কাশেম আলি সোৎসাহে শুনিয়ে চলে - এই যুগীরাই এ তল্লাটের পুরনো বাসিন্দা গো দাদাবাবু। শুনেছি রাজা কেশনগর বসানোর আগে থেকে যুগীরা এখানে বসবাস করছে। বয়স অল্প, সচ্ছল ডাক্তার পিতার স্কুল পালানো দেশোদ্ধার করে বেড়ানো ডানপিটে ছেলে হলেও প্রমোদরঞ্জন ওরফে মঘা অনেক খবরই রাখে। কৃষ্ণনগরের নাম কিন্তু রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নামে হয়নি। রাজার পূর্বপুরষদের আসল জমিদারি ছিল মাটিয়ারিতে। বারো ভূইয়াদের বিপক্ষে মুঘলদের সাহায্য করে বেশ পসার করেছিলেন তারা। চারপুরুষ আগে রাজা রাঘব রায় রাজধানী সরিয়ে নিয়ে এসে এখানে শহরের পত্তন করেন। তখন নাম ছিল রেউই। তাঁর কৃষ্ণভক্ত পুত্র রুদ্র রায় রাজধানীর নাম দেন কৃষ্ণনগর। যুগীপাড়ায় সেইকাল থেকেই নাথ যোগীদের বাস, আগে মনে হয় বৌদ্ধদের বাস ছিল। তবে ইংরাজদের সাথে ভালো দহরম মহরম থাকায় পলাশীর যুদ্ধের আশপাশের সময় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে রাজবাড়ির খুব প্রতিপত্তি বাড়ে। নবাব মীরকাশেম তো খাজনা না দেবার জন্য একবার রাজাকে আটক করে রেখেছিলেন।

বলতে বলতে চাঁদসড়ক রায়পাড়া ঘুরে রাজবাড়ির পাশ দিয়ে কাশেম আলির সারেঙ্গি যখন গোলাপট্টিতে জ্ঞান সরকারের ডাক্তারখানার সামনে এসে দাঁড়ালো - নজরুল দেখলেন তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো প্রাণতোষ - গৃহস্থ যেমন অতিথিকে স্বাগত জানাতে বেরিয়ে আসে, সেইরকম মুখে একগাল হাসি নিয়ে ধাপির মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

(ক্রমশ)

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।