'থগবগে' খালের জল যে সব বিল বাহিত হয়ে ভৈরবের খালে গিয়ে পড়ে, সে সমস্ত বিলগুলো বর্তমানে আবাদ যোগ্য কয়েক হাজার একর জমি। পরির চোখের সামনে বিলগুলো এক ফসল থেকে দো-ফসলি/তিন ফসলি চাষের জমি হয়ে গেল। মাছ ধরতে গিয়ে জানা হয় বিলের জমির দখলদারির ইতিহাস। কাজের চাপ না থাকলে ছিপ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। চাষা, অফিসার, ব্যবসায়ী, মাস্টার- চারজনের দল। এই চতুর্ভুজ গোটা ত্রিশেক খাল- বিলে মাছ ধরতে যায়। বাহন সাইকেল। দূর হলে মোটর বাইক। নেশায় ছুটে বেড়ায়! মাছ ধরার নেশা বেজায় নেশা! মাছ ধরতে যাওয়ার জোটটা প্রাইমারিতে পড়ার সময়ই হয়েছে। এই নেশায় তাদের বেঁধে রেখেছে।
বিস্তৃর্ণ অঞ্চলটি ওপার বাংলার মানুষ আসার আগে গভীর জঙ্গল আর জলাভূমি ছিল। হিংস্র পশু নির্ভয়ে বিচরণ করত। থগবগের খালের দক্ষিণ- পশ্চিমে ডিগ্রীর বিলের চারপাশ দিয়ে ফরেস্ট। ফরেস্টের উত্তর -পূর্ব দিক দিয়ে ছিল খড়ের মাঠ। হয়ে গেল খেড়ো দাড়ি। তখন খড়ের খুব চাহিদা ছিল। খড়ের ছাউনির আটচালা ঘর করার ক্ষমতা খুব কম লোকের ছিল। খড়ের চালের ঘর গরমে ঠাণ্ডা, শীতে গরম। একবার ছাইতে পারলে ৪/৫ বছর নিশ্চিন্ত। খড়ের চালের ঘর আর ঘরামি এখন গল্প কথা। 'ঘরামির ঘরে শোন থাকে না' প্রবাদ প্রবচনটির খুব চল ছিল; কারণ ঘরামি লোকের ঘর ছাওয়ার কাজে এত ব্যস্ত থাকত যে, নিজের ঘর ছাওয়া হয়ে উঠত না। ওপার বাংলা থেকে অনেকে এসে খড়ের মাঠ কিনে ব্যবসা করে পরিবার প্রতিপালন করেছে। পিলপিলিয়ে ওদেশের মানুষ আসার ফলে বন-বাদাড় সাফ হতে থাকে। বাড়তে থাকে চাষের জমি। বেনা ঝাড় আর খড়ের শিকড় থেকে মাটি ছাড়াতে কালঘাম ছুটে গেছে চাষির, দিন-মজুরের। লাঙলের ফালে উঠে আসা এক এক চাঙড় মাটি ভেঙে টুকরো করতে ন্যাংটের মতো মার্কেনি ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। খড়ের মাঠের জমির দাম কম ছিল; কারণ ফসল চাষের উপযোগী হয়ে উঠতে বেশ কয়েক বছর লেগে যেত। মাঠে গো- চারণের ফলে মাটি ছিল উর্বর। রাসায়নিক সারের ব্যবহার ছিল না। উলুখড়ের শিকড় নিকেশ করতে পারলেই একহাত শিষের আমন ধান। বয়ষ্কদের গল্প শুনে পরি এসব জেনেছিল। গোবিন্দ জেঠা কাছারি ঘরে বসে পাড়ার বয়ষ্ক লোকেদের সঙ্গে ওদেশ থেকে এদেশে এসে বসতি গড়ে তুলতে কত যে কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে, সেই আলাপ-আলোচনা করত হুঁকো টানতে টানতে। বালক পরি গল্প শুনত আর হুঁকোর কল্কেয় রান্নাঘর থেকে ঘসির আগুন নিয়ে আসত। একদেশ থেকে অন্যদেশে আসার যন্ত্রণার আঁচ বালক হৃদয়কে ব্যথিত করত।
বড়ো বাড়ির রাখাল থাকার সময় দেখেছে বিলের ধান কেটে গোলায় তোলার জন্য আসত মুর্শিদাবাদের দাওয়াল(মুসলিম দিনমজুর)। খামারের এক কোনায় বাঁশ বেঁধে তাবু টাঙিয়ে থেকে যেত মাসখানেক। গৃহস্থকে দিতে হবে চাল, ডাল, আনাজপাতি। সঙ্গে করে আনা হাঁড়িতেই রান্না করত ভাত, ডাল, তরিতরকারী । ভোরবেলায় আর সন্ধ্যেবেলায় দুবার। নাদায় ডাল আর ধামায় বা ঝুড়িতে ভাত। বিলের হাঁটু/ কোমর সমান জলে আঁটি আঁটি ধান কেটে ডাঙায় আনার কঠোর পরিশ্রমের ক্লান্তি ভুলতে সন্ধ্যে বেলায় খাওয়ার আগে ও পরে আগুন পোহানোর সঙ্গে সুর ধরত মানিকপুরের গানের। পরি গলা মেলাত ওদের সঙ্গে। ধানের আঁটি স্তরে স্তরে সাজিয়ে মলন ঘোরাত তিন/ চারটি গরুর গলার দড়ি পরস্পরের সঙ্গে বেঁধে দিয়ে। ঘুরতে ঘুরতে পরির ঘোর লেগে যেত।
ধান কাটা শেষ হয়ে গেলে কোনো কোনো বার যত জল, তত মাছ। ধান ডাবসে ওঠার পর থেকেই পাখিদের আনাগোনা। দেশি ও পরিযায়ী পাখি। মাছরাঙা, শামুখখোল, হাঁস পাখি, ডোমকুর, বক, কাদাখোচা, কামপাখি, ফিঙে (ফ্যাচা), ভরুই... ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি । তারা শা-আ-আ করে উড়ে গিয়ে চক্কর লাগাত আকাশে। পরি হাঁ করে চেয়ে থাকত। মাছের মতো পাখি যারা জালে ধরত পরি তাদের একদম সহ্য করতে পারত না। তাই- সুযোগ পেলেই জাল কেটে কত পাখি ছেড়ে দিয়েছে। পরিযায়ী পাখিরাও আর আগের মতো আসে না; চারিদিকে কারেণ্টের আলো আর মাছ ধরার লোকের চলাচল বেশি হওয়ায়। পাখিদের নিরিবিলিতে ডিম পেড়ে; ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা তোলার কাজটি ব্যাহত হয়; বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বিলুপ্তির এটাও একটা কারণ। তার উপর পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাবে পরপর তিন বছর বিল ফেটে চৌচির। ভূ-গর্ভের জল তুলে চাষ হচ্ছে; সরকারি নিয়মকে অগ্রাহ্য করে। পরিরা ভাবে সরকারি নিয়ম মানতে গেলে না খেয়ে মরতে হবে। আজ তো বাঁচি। কালকের ভাবনা কাল ভাববে। দোকান- বাজারের জিনিসের দর আকাশ ছোঁয়া।
বিলগুলো নাব্যতা হারানোয় অকাল বর্ষণ না হলে যথা সময়ে জল শুকিয়ে যায়। পলি সমৃদ্ধ জমিতে পেঁয়াজ, রসুন চাষ হয়। লাভজনক পেঁয়াজ চাষই বেশি। সর্ষে, কালো জিরে, ধনে, ফুল চাষ হয় অল্প পরিমাণে। ২০২১ সালে সারাবছর বৃষ্টির কারণে পেঁয়াজ, রসুন, কালো জিরের চাষ মার খেয়েছিল। উঁচু জমিতে পেঁয়াজ বীজ চাষিরা একাধিকবার ছড়িয়েছিল। বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে গেছে। সেবার বিলের জমিতে বীজ বুনতে বা চারা লাগাতেই পারল না। একবিল থেকে অন্য বিলে জল বেরিয়ে যাবার জায়গায় বড়োবড়ো মাছের ভেড়ি, বাঁধাল। সরু নালা দিয়ে ধীরে ধীরে জল বের হতে দেয়। এই বিলের জমিগুলোতে চৈতালি ফসল ওঠার পর ধান, পাট চাষ হয়। আগাম জোরালো বৃষ্টি হলে ধান-পাট সব নষ্ট হয়ে যায়; বৃষ্টির জল বেরিয়ে যেতে না পারায়। বোরোধান অধিক ফলনশীল হওয়ায় আমন ধানের চাষ উঠে গেছে কবেই। তাছাড়া মোটা ধানের লাল চালের ভাত হজম করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে আধুনিক মানুষ। বর্তমানে পেঁয়াজ চাষ লাভজনক হওয়ায় বোরো ধানের চাষ প্রায় উঠে গেছে। এই দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের চারপাশ ঘিরে আছে কুড়ি/ বাইশটি গ্রাম। অবস্থাপন্ন চাষী বাড়িতে গোলার পরিবর্তে পেয়াজ সংরক্ষণের বড়ো বড়ো টিনের বেড়ার ও চালের ঘর। হাঁসখালি, কৃষ্ণগঞ্জ বিডিও অফিস পেঁয়াজ সংরক্ষণের এই প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সরকার থেকে যারা পায়নি; নিজে থেকে করে নিয়েছে। গোলার সংখ্যায় চাষীর আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির দিন শেষ। উঠতি চাষীদের স্বপ্ন ছিল উঠোনে থাকবে সার সার গোলা ও গোয়াল। শোবার ঘর থাক না কেন পাটকাঠির বেড়ার। তখন গোলা দেখেই বাপ-জ্যেঠারা মেয়ের বিয়ে দিত। ধান্যলক্ষ্মীর কদর কমে গেছে; পয়সার পেঁয়াজের কাছে।
নিধিরপোতার হঠাৎ পাড়ার কাছে রানীর দীঘি বা পদ্মদীঘির পাশ দিয়ে পাঁচ-সাতটা বিলের জল বেরিয়ে ভৈরবের খালে পড়ে; তারপর চূর্ণীতে। জল তারিণীপুর ঢোকার আগে খালের জল বেরিয়ে আসে হাত দেড়েক নালার মধ্যে দিয়ে। নালার মুখেও বাঁশের চটার বেড় ও নেট পাতা। পাশ দিয়ে কোন রকমে জল বেরিয়ে যাচ্ছে। সেই নালাতেও আবার বাঁধাল। গুটি কয়েক বাহুবলীর লাভ এতে। ক্ষতি গ্রস্থ হচ্ছে হাজার হাজার চাষী। ভেড়িগুলো প্রভাবশালী ব্যক্তির বা তাদের মদত পুষ্ট ব্যক্তিদের, দাদনদারদের। কোন্ চাষীর ঘাড়ে ক'টা মাথা আছে যে, ভেড়ির পাড় কেটে জল বার করার কথা ভাববে? এখন পল্লিসমাজের মহানুভব ছোটোবাবুরা গ্রামে ফিরে আসে না। কারো ফেরার ইচ্ছা থাকলেও স্ত্রী, সন্তানরা ফিরে আসতে চায় না। বেচারারা পড়ে যায় মহাফাঁপড়ে। চাষীদের মধ্যে সুর উঠছে থকবগের খাল থেকে ভৈরবের খাল পর্যন্ত বিলগুলোর ভিতর দিয়ে একটা খাল হলে খুব ভালো হয়। প্রকৃতির খাম-খেয়ালিপনায় নাহলে পতিত জমি পরিণত হয়ে যাবে আবাদ যোগ্য হাজার হাজার বিঘে জমির মাঠ।
পরপর দুই বছর খাল- বিল জলশূন্য। বৃষ্টি হয়নি। পাট নিয়ে চাষীর দূর্গতির শেষ নেই। অধিকাংশ পাট জমিতে দাঁড়িয়ে পুড়েছে। রাসায়নিক সার ও ঔষধের দাম আকাশ ছোঁয়া। এবছরও তাপপ্রবাহে জনজীবন জেরবার। পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছে জগৎ- সংসার। পরিপড়ন্ত বিকালে এমন পরিস্থিতিতেও আড় বাঁশিতে সুর তোলে। বাঁশির মিঠে সুর ভেসে যায় দূর হতে দূরে। এ-তার সুন্দরের সাধনা। অসুন্দরের মাঝে খুঁজে নেয় তার সুন্দরকে।
‘মানব জমিন’ বিল পাড়ায় মহান ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করল। তিনটি মঞ্চে হারিয়ে যেতে বসা লোক সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারা পরিবেশিত হয়। অমর ভাষা শহিদ মঞ্চে পরির বংশীধ্বনি তাক লাগিয়ে দিয়েছে দর্শকদের। রঞ্জন রায়ের পরিবেশনায় এই মঞ্চে পরিবেশিত হয় পুতুল নাচ। অনেক বছর পর বহু মানুষ একসঙ্গে প্রাণ খুলে হাসল । আসলে পটলবাবুর চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। পরি পুতুল নাচ ছোটোবেলায় দেখেছে প্যাণ্ডেলের বাইরে দাঁড়িয়ে টিনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে। একের পর এক তিনটি মঞ্চে আলোচনা সভা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিজ্ঞান ঝাপানগান, ঝুমুর গান, ভাদু গান, টুসুগান, নাটক, কবিগান, লোকগান, পালাবাউল, লালন গীতি- সকাল আটটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত।
আইলা বিবি ও ফুলটুসি সম্প্রদায় গাইতে এসেছিল বিয়ের গান। তারা দুপুরে পৌঁছে গেলেও আসর পেতে বিকেল গড়িয়ে গেল। লোকগানের বংশীবাদককে খুব চেনা মনে হল। মনের অতল থেকে উঠে আসছে কেউ একজন। যে তাকে বাঁশির সুরে বেঁধে ছিল। পরিদা! কিন্তু তখন পরির গায়ের রং কুচকুচে কালো ছিল। তামাটে নয়। এই সেই পরি, নিশ্চিত হল মাইকে নাম ঘোষনা হওয়ার পর।
পরি আগেই জেনেছিল কিশোর পরির প্রথম কদমফুল আসছে বিয়ের গান গাইতে। গান শেষে ফুলটুসিকে সামনাসামনি পরি জিজ্ঞাসা করে, ‘কী- চিনতে পার?’
‘পেরেছি । তুমি পরিদা। তোমার বাঁশি আবার শুনব স্বপ্নেও ভাবিনি। আশার আলো সংগঠনের দাদা- দিদিদের উৎসাহে বিয়ের গানের দল গড়ে তুলেছি। এই সংগঠন গ্রামবাংলার প্রাণভোমরা খাল-বিল, জলাশয় বাঁচানোর সংগঠন গড়ে তুলেছে। আমাদের পলদা বিল বাঁচানোর কমিটিতে আমি আছি। তোমরাও দল গড় খাল-বিল বাঁচানোর। ঝোর বাঁচলে চূর্ণী বাঁচবে।’
‘ঠিকই বলেছো। সুর আমাদের এদিকেও উঠেছে ।জোট বাঁধছে সব। ভোটের আগেই বিশ গ্রামের মানুষ ডাকা হবে। যোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে নদী- নালা, খাল-বিল, জলাশয় বাঁচানোর সংগঠনের সঙ্গে। প্রশাসনকে জোর ধাক্কা দেওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে।
(চলবে)
আলোকচিত্রঃ লেখিকার কাছ থেকে প্রাপ্ত।