সত্যবতীর সাথে শান্তনু। শিল্পীঃ রাজা রবি ভার্মা
'মহাভারত' এক অত্যাশ্চর্য কাহিনী। মূল সূত্র যদি ধরে নেওয়া যায় ক্ষাত্র ধর্ম এবং ধর্ম অধর্মের লড়াই, তাহলেও তার প্রতিটি পরতে রয়েছে দৈব নির্দিষ্ট কিছু ঘটনা, যা মহাভারতের ঘটনা পরম্পরাকে জটিলতর এবং নির্মম করে তুলেছে।
ব্যাসদেব বিরচিত 'মহাভারত'-এ প্রথম জটিলতার সৃষ্টি হয় গঙ্গাকে কেন্দ্র করে। তিনি তাঁর পুত্র গাঙ্গেয় দেবব্রতকে চন্দ্রবংশীয় নরপতি শান্তনুর উপযুক্ত উত্তরাধিকারী করে পুনরায় অন্তর্ধান করেন। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত দেবব্রতকে নিয়ে হস্তিনাপুরের রাজা এবং প্রজারা যখন আহ্লাদিত, ঠিক তখনই ব্যাসদেবের রচনায় ভেসে উঠল আরও একটি রমণী চরিত্র। তিনি আর কেউ নন, ধীবর কন্যা সত্যবতী এবং ব্যাসদেব তাঁর কানীন পুত্র (অর্থাৎ বিবাহ পূর্বের সন্তান)। যমুনা নদীতে নৌকা চালানোয় মগ্ন সত্যবতীকে দেখে ঋষি পরাশর ব্যাকুল হয়ে পড়েন। ধীবর কন্যার গায়ে মাছের গন্ধ। মৎস্যগন্ধা এই কন্যাকে তিনি পদ্মগন্ধ সুরভিতা করে তাকে গ্রহণ করলেন। এরই ফলশ্রুতি ব্যাসদেব। সত্যবতী তাঁর এই পুত্রকে বড়ো করে তোলেননি। গঙ্গার মতো তিনি বিদগ্ধা ছিলেন না। পুত্রের দায়িত্ব নেন পরাশর মুনি। ফলে ব্যাসদেব হয়ে ওঠেন ধীমান ও শাস্ত্রজ্ঞ। অবশ্য তিনি রূপবান ছিলেন না। বরং বলা যেতে পারে কুৎসিত দর্শনই ছিলেন।
সত্যবতী তাঁর প্রাক বিবাহ জীবনে এই ঘটে যাওয়া অধ্যায়টিকে কিভাবে গ্রহণ করেছিলেন, সেই বিষয়ে মহাভারতের স্রষ্টা নীরব। এই মাতৃত্ব বা মুনির সান্নিধ্য তাঁকে কোনওরকম আলোড়িত করেছিল কিনা তাও জানা যায় না। এমনকি যাঁরা মহাভারতের বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন, তাঁরাও সত্যবতীকে নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাননি। খানিকটা উপেক্ষিতাই তাঁকে বলা চলে সুধীজনের দৃষ্টিতে।
একথা ভুললে চলবে না যে মহাভারতকে মূলত নিয়ন্ত্রণ করেছেন তিন নারী - প্রথম পর্বে গঙ্গা, দ্বিতীয় পর্বে সত্যবতী, এবং অন্তিমে ধর্ম, অধর্ম ও ক্ষাত্রতেজের লড়াইয়ে শেষ পেরেকটি পুঁতে দিয়েছেন দ্রৌপদী। মহাভারতের ঘটনাপ্রবাহ সরলরেখায় কখনই এগুতে পারেনি এই তিন নারীর জন্য।
সত্যবতীর জীবন চলছিল মৃদুমন্দ লয়ে। তিনি ধীবরকন্যা, কৃষ্ণাঙ্গী, রূপবতী এবং মুনির প্রসাদে পদ্মগন্ধা। প্রৌঢ় শান্তনু তাঁকে দেখে মুগ্ধ হলেন। অথচ বৃদ্ধবয়সে কিশোরী ধীবরকন্যার প্রতি এই অসম প্রেম পুত্র দেবব্রতর সম্মুখে প্রকাশ করতে লজ্জা পেলেন। ফলে শান্তনু মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেন। ব্যাসদেব পুনরায় 'মহাভারত'-এর কাহিনীতে আরও একটি জটিলতার সৃষ্টি করলেন।
পিতার মনোবেদনা ও ভগ্নস্বাস্থ্যের মূল কারণ অনুসন্ধান করে দেবব্রত ধীবর রাজের গৃহে উপস্থিত হলেন। পিতার জন্য সত্যবতীকে প্রার্থনা করলেন। ধীবর রাজ বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। মনে হলো তাঁর রূপসী কন্যার জন্য এই ধরনের সম্বন্ধই আসা উচিত। হস্তিনাপুরের যুবরাজের প্রস্তাবে কিন্তু তিনি আহ্লাদে আকাশের চাঁদ পেয়েছেন এমন ভাবও প্রকাশ করলেন না। উপরন্তু বললেন তাঁর মেয়ে রাজমহিষী হবেন ভালো কথা, কিন্তু তিনি রাজমাতাও হবেন। দেবব্রত বীর এবং নীচতা তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য নয়। তাই তিনি ধীবর রাজের প্রস্তাবে এতটুকু ইতস্তত না করে সম্মতি দিলেন। ধীবর রাজ উন্নতমনা নন। মেয়েকে প্রৌঢ় রাজার মহিষী করার আগে তাঁর কন্যার অবস্থানকে পাকাপোক্ত করে নিতে চান। হাজার হোক তিনি মেয়ের বাবা। তাই কূটবুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন করলেন দেবব্রত তো যুবরাজ। সিংহাসনে তো সেই বসবে। দেবব্রত প্রতিশ্রুতি দিলেন তিনি রাজা হতে ইচ্ছুক নন। ধীবর রাজ আরও কৌশল করলেন। দেবব্রত বিবাহ করলে তাঁর পুত্র সিংহাসন পেতে পারে। দেবব্রত ভীষণ প্রতিজ্ঞা করলেন তিনি আজীবন ব্রহ্মচর্য পালন করবেন। ধীবর রাজের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলো। দেবতারা ধন্য ধন্য করে উঠলেন এবং এই ভীষণ প্রতিজ্ঞার জন্য তাঁর নাম হলো ভীষ্ম।
ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা।
এইভাবে হস্তিনাপুরের রাজনীতির রন্ধ্রে আরও গভীর জটিলতার সৃষ্টি হলো। কিশোরী সত্যবতী রাজ অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন। শান্তনু আত্মহারা, প্রজাবৃন্দ হতাশ এবং রাজ কর্মচারীরা হতবাক। একমাত্র নির্লিপ্ত ভীষ্ম। তিনি অবিচল চিত্তে তাঁর নির্দিষ্ট কাজ করে যেতে লাগলেন। শান্তনু তাঁর কৃতকর্মের জন্য ভীষ্মর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে অনুনয় করলেন ভীষ্ম যেন তাঁর এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেন এবং রাজকার্য পরিচালনা করেন। ভীষ্ম প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু সিংহাসনে না বসেও রাজাকে সর্বতোভাবে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দেন। যতদিন তিনি জীবিত থাকবেন তিনি স্বধর্মচ্যুত হবেন না।
ভীষ্ম হস্তিনাপুরের দেখভাল করার সাথে সাথে তাঁর বিমাতাকে রাজ পরিবারের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট হন। সত্যবতী মেধাবী এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্না। ধীরে ধীরে তিনি হস্তিনাপুরের উপযুক্ত রাজমহিষী হয়ে ওঠেন। মহারাজ শান্তনু তখন প্রায় বৃদ্ধ এবং রাজকার্যে উদাসীন। সত্যবতীর সান্নিধ্যে অন্তঃপুরেই অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেন।
কালক্রমে সত্যবতীর দুই পুত্রসন্তান হয় - চিত্রাঙ্গদ এবং বিচিত্রবীর্য। রাজমহিষী সত্যবতী এবার অদূর ভবিষ্যতে রাজমাতা হবেন। ভীষ্ম হস্তিনাপুরের মেরুদণ্ড হয়ে থাকবেন। এইরকম সুখের সময়ে শান্তনুর মৃত্যু হয়। স্বাভাবিকভাবে চিত্রাঙ্গদ রাজা হলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন উদ্ধত এবং অহংকারী। যোদ্ধা হিসেবে বিশেষ নিপুণ ছিলেন না। ধর্ম অধর্মের ভেদাভেদ নিয়ে তাঁর বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না। গন্ধর্বদের সাথে যুদ্ধে তাঁর মৃত্যু হয়। তখনও তিনি নিতান্তই তরুণ এবং অবিবাহিত। অতঃপর সিংহাসনে বসেন বিচিত্রবীর্য। তিনি উচ্ছৃঙ্খল, সুরাপ্রিয়, রাজকার্যে অনাগ্রহী এবং লাম্পট্য বিশারদ। রাজমাতা সত্যবতী এইবার অন্তঃপুরের থেকে বাইরে এসে হস্তিনাপুরকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেন। ভীষ্ম এবং সত্যবতী মিলে স্থির করলেন বিচিত্রবীর্যর বিবাহ দেওয়া দরকার। অম্বিকা এবং অম্বালিকা এই দুই রাজকন্যার সাথে বিচিত্রবীর্যের বিবাহ সম্পন্ন হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে বিচিত্রবীর্য বিচিত্র কামনা বাসনায় নিমজ্জিত থেকে ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হন এবং মৃত্যুমুখে পতিত হন। কিশোরী দুই বধূ স্বামীহারা হন এবং হস্তিনাপুরের রাজ সিংহাসন উত্তরাধিকারীহীন হয়ে পড়ে। ভীষ্ম রাজবংশের প্রতিনিধিরূপে রাজকার্য পরিচালনা করতে থাকেন।
এই অবস্থায় ব্যাসদেবের লেখনীতে আর একটি নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়। সত্যবতী ভীষ্মকে পুনরায় সিংহাসনে বসার অনুরোধ করেন। ভীষ্ম সম্মত হন না। এই প্রথম সত্যবতী তাঁর সপত্নী পুত্রকে তাঁর বিবাহ পূর্ব জীবনের এক নিগূঢ় তথ্য জানান। পরাশর মুনির ঔরসে সত্যবতীর গর্ভে ব্যাসদেবের জন্মকাহিনী। প্রাচীনকালে নিয়োগ প্রথা ছিল শাস্ত্রসম্মত। সত্যবতী ভীষ্মকে জানালেন অম্বিকা ও অম্বালিকাকে ব্যাসদেবের মাধ্যমে সন্তানবতী হওয়ার কথা। ব্যাসদেব ঋষি, শাস্ত্রজ্ঞ, উন্নতচেতা এবং ধার্মিক। ভীষ্ম রাজী হন। ব্যাসদেবকে এই প্রথম সত্যবতী স্মরণ করেন। মাতা তাঁকে তাঁর ইচ্ছার কথা জানান। ব্যাসদেবের এই ভূমিকা অম্বিকা বা অম্বালিকার কাছে কাম্য ছিল না। তিনি কুদর্শন, প্রৌঢ় এবং রুক্ষকান্তি। অম্বিকা ভয়ে চোখ বুজে থাকেন। ব্যাসদেব সত্যবতীকে জানান পুত্র জন্মগ্রহণ করবে কিন্তু সে হবে দৃষ্টিহীন। অম্বালিকা সত্যবতীর নির্দেশ মতো চোখ বন্ধ করে না কিন্তু অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়ে। ফলে পুত্র হলো পাণ্ডুবর্ণ। রাজ অন্তঃপুরের এক দাসী অম্বালিকার অনুরোধে অম্বালিকার ভূমিকায় ব্যাসদেবকে সেবা করে। ব্যাসদেব দিব্যদৃষ্টিতে বুঝতে পেরেছিলেন সবই। তবুও তাঁর এই পুত্র হলো দিব্যকান্তি, ধার্মিক ও স্থিতধী। দাসীপুত্রের নাম হলো বিদুর।
"মহাভারতের কথা অমৃত সমান,
কাশীরাম দাস কহে শুন পুণ্যবান।।"
হস্তিনাপুরের রাজবংশে যাঁরা রাজত্ব করতে এলেন তাঁরা শান্তনুর রক্তের নন। যিনি শান্তনুর পুত্র, তিনি রইলেন ব্রহ্মচারী, আর দুই সন্তান অকালমৃত। পরবর্তীকালে কুরু পাণ্ডব বলে যে দুই গোষ্ঠী, তারা ব্যাসদেবের ঔরসজাত সন্তানদের প্রজন্ম। ধীবরকন্যা হস্তিনাপুরের রাজমহিষী সত্যবতী হস্তিনাপুরের রাজবংশের অভিমুখ এইভাবে পরিবর্তিত করে দিলেন।
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।