বিবিধ

বাঙালিয়ানা যাপন



বিপ্লব ভট্টাচার্য


এক কবিতার আড্ডায় এক প্রিয় কবি বন্ধু বলেছিলেন, শালা মরার আগে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতাটা আমিই লিখে যাব, দেখে নিস। তার চশমার কাঁচ ছিল মোটা, মাথাভর্তি বিক্ষিপ্ত চুলের রমরমা।

মাঝে মাঝেই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের "আমি যত দূরেই যাই।/ চোখের পাতায় লেগে থাকে/ নিকোনো উঠোনে/ সারি সারি/ লক্ষ্মীর পা..." কবিতাংশটি আউরাতে শুনেছি।

সুভাষ মুখোপাধ্যায় বরাবর বিশ্বাস করতেন, ইংরেজির সর্বাত্মক আগ্রাসনেও ‘মুখে মুখে বাংলা ভাষা বেঁচে থাকবে'।

পূর্বদিকের দেশ বাংলাদেশের বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও ব্যবহারের যে সাফল্য বা স্বাচ্ছন্দ্য তাদের দৈনন্দিন জীবনচর্চাকে সরসর করে এগিয়ে নিয়ে চলেছে বাংলাভাষী হিসেবে সেটা যে শ্লাঘার বিষয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘আমি কি বাঙালি?’ গ্রন্থে 'ইতিহাসের পরিহাস' শীর্ষক নিবন্ধে লেখেনঃ “পাকিস্তানের একটা অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ হয়েছে। তবু বাঙালি জাতির মিলনের কোনো চিহ্ন নেই এবং দূরত্ব আরও বাড়ছে। ...বাংলার মিলনের সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতে আছে বলেও মনে হয় না। কেউ সে কথা উচ্চারণ করে না...।"

আগে সবাই বাঙালি তারপরে আমাদের বাংলাভাষা।

সুনীল প্রকারান্তরে হয়ত বলতে চেয়েছিলেন বাঙালি যারা মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলবে। এপারের বাঙালিরা যেমন স্যুট টাই পড়ে ইংরেজীতে বক্তৃতা দেবেন আর সেই সময় বাংলাদেশের বাঙালি তার বক্তৃতা করবেন বাংলাতেই।

ঠান্ডা পানীয় পান করার উচ্ছ্বাস এপারে 'চীয়ার্স' নামক চীৎকারে আর ওপারে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে 'উল্লাস' বলে একই উন্মাদনা ব্যক্ত করবেন।

বিষয়টা বাঙালিয়ানা তুমি কোথায়? বাঙালিয়ানা শব্দটা প্রায়শই শোনা যায়। কিন্তু কী এই বাঙালিয়ানা, কেনই বা সে শব্দ নিয়ে প্রতিনিয়ত এত চর্চা? চিত্রপরিচালক গৌতম ঘোষ বাংলার সম্পদ এবং ইতিহাসের গৌরবের কথা বলেন। এখন আমরা বলতে শুনি, বাঙালির কোনও সম্পদ নেই। কিন্তু ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখলে বোঝা যায় সোনার বাংলা কী ছিল। মুঘল বা সুলতান আমলে সব থেকে বেশি আয় আসত এই বাংলা প্রদেশ থেকেই। ব্রিটিশ আমলের প্রথম দিকেও কিন্তু বাংলা প্রদেশ থেকে অনেক আয় হতো। সেই কারণেই সোনার বাংলা বলা হতো। আমাদের বাংলা একটি কৃষিপ্রধান দেশ। কিন্তু ব্রিটিশদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে আমাদের কৃষকদের সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। বাংলার উপর দিয়ে অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা গিয়েছে, এ মত অনেক বাঙালিয়ানার পৃষ্ঠপোষকের।

তাহলে সে বাঁচবে কোন পথে? যেভাবে যোগাযোগের মাধ‌্যমের অবিসংবাদী জনপ্রিয়তা হাতের মুঠোয় চলে এসেছে, তাতে বাঙালিয়ানা কতোটা হারিয়েছে সেটা গবেষণার বিষয় কিন্তু ভাষার ওপর দিয়ে যে জটিল ঝঞ্ঝা বইছে, সংস্কৃতির এক অভূতপূর্ব মিশ্রণ এই বাঙালিয়ানাকে যুগের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে বাঙলা ভাষাকে তার মায়ের কোল থেকে কোথায় নিয়ে নামাবে, এখনই তা বলা যাচ্ছে না।

এমনই এক আড্ডায়, যাবতীয় বয়স্কদের সমাগমে, উল্লেখ্য সকলেই বাঙালি, জনাতিনেক আবার বাঙাল। এক ষাট পেরোনো তরুণ প্রশ্ন ছুঁড়লেন, অবসর যাপনের নতুন সংজ্ঞা নিরুপণ করা যায়? কিভাবে? আরেক তরুণতর ঝটিতি বললেন, কথা বলতে হবে। আমাদের অনেক কথা বলার আছে। ফোনে বলব, দেখা হলে বলব, কাগজে লিখে রাখব, ভেবে রাখব যা বলতে হবে। পিন পতন নীরবতা।

একমাত্র নবতিপর যিনি, ধীর সংযত কন্ঠে তিনি বললেন, ভালো, কিন্তু সবকথার ভাষা হবে বাংলা।

সবাই সহমত। বাঙালিয়ানার আপন যাপন।

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।