বাংলার প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনার মানসে ও সচেতন, উদার, যুক্তিবাদী রাজনৈতিক পরিমন্ডলে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ যে অসংবেদনশীল, অমানবিক, জনবিরোধী, বর্বর এবং সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবিত রায়দান করে ২৫,৭৫৩ জনের নিয়োগ বাতিল করেছেন, তার সঙ্গে চাকুরী করাকালীন সমস্ত বেতন ১২% সুদসহ ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, সেটা গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে চিরকলঙ্ক হয়ে থাকবে। এটা ভাবা যায়! পরিশ্রম করে পারিশ্রমিক পেয়েছে, সেটাও নাকি সুদসহ ফেরত দিতে হবে? এসব শুধু সম্ভব হবু রাজা গবু মন্ত্রীর দেশে।
কেন্দ্রের অঙ্গুলিহেলনে 'বিচারের নামে প্রহসনে'র কুৎসিততম নাটক যখন সুপ্রীম কোর্টে জোর ধাক্কা খাবে এবং এই কলঙ্কজনক রায়ের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ পাবে, তখন বাংলার অগ্রচারী সমাজসচেতন নাগরিকের একটাই দাবি থাকবে এই দুই বিচারপতিকে যেন অবিলম্বে বরখাস্ত করা হয় এবং এদের যাবতীয় বেতন ১২% সুদসহ যেন ফেরত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তখন বুঝবে, ঠ্যালার নাম বাবাজী!
পৃথিবীর বিচারব্যবস্থার মধ্যে একটা নিত্য সত্য আছে, তা হল - "একজন অপরাধী সাজামুক্ত থাকতে পারে কিন্তু বিচার ব্যবস্থা একটা জিনিস অবশ্যই নিশ্চিন্ত করবে যে একজন নিরপরাধীও যেন সাজা না পায়।"
উপরোক্ত মামলার বিচারপতিরা ভালো করে জানতেন ২০১৬ সালের তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের অধিকাংশ যোগ্যতার নিরিখে চাকরি পেয়েছেন। তবুও এই ধরনের যুক্তিহীন সিদ্ধান্তের পেছনে হয় কোনো গোপন ষড়যন্ত্রমূলক অভিসন্ধি আছে অথবা ওঁনারা ভালো করে জানেন সিবিআইয়ের পক্ষে তথ্যনিষ্ঠ যুক্তি প্রমাণাদি সহযোগে অপরাধী সনাক্তকরণ শুধু দুরূহ নয়, প্রায় অসম্ভব। তাই কোনো এক মহলের এজেন্ডা বয়ে বেড়ালে যদি রাজ্যসভার সাংসদ পদ জুটে যায় বা নির্বাচনের টিকিট, মন্দ কী? তা নাহলে বিরোধী দলনেতা রায় বেরোনোর আগে আগাম বোমা ফাটান কী করে?
বোমা মানে যদি হয় প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি চলে যাওয়া, সেই বোমা বানানোর সঙ্গে যুক্ত সমস্তস্তরের কারিগরদের উদ্দেশ্যে রাজ্যের সুধী নাগরিকবৃন্দ অবশ্যই সুতীব্র ধিক্কার জানাবে। সবশেষে বলি ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি চলে গেলে বা তাদের সামাজিক সম্মান নষ্ট হলে যারা খুশি হয়, আনন্দিত হয়, উল্লসিত হয়, তারা আদতে মানুষ নামের যোগ্য কিনা সে বিষয়ে গভীর সন্দেহ অবশ্যই আমাদের থাকবে। আজ এরাই পিঠ বাঁচাতে আদালতের সঙ্গে গলা মিলিয়ে সরকারকে অবিলম্বে পুনর্নিয়োগের আবেদন করছে। দোষী, নির্দোষ তারতম্য করার ক্ষমতা যদি সিবিআইয়ের না থাকে, আদালতও যদি কারা অপরাধী চিহ্নিত করতে না পারে, তাহলে বোঝাই যায় এই ধরণের জো হুজুর রায়ের মাধ্যমে এরা সব বিশেষ এক রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বয়ে বেড়াচ্ছে।
ডঃ বি. আর. আম্বেদকর বলেছেন, "সংবিধানের ভালো, মন্দ হয় না, সংবিধান কাদের হাতে পড়েছে, সেটাই বড় কথা।" জরুরী অবস্থার সময়েও বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন যে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে চলেছিল, আজকের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে সেটাও করা সম্ভব হয়ে উঠছে না।
বিরোধীদলের নেতা যখন বলেন, "রাজ্যপাল আমাদের, হাই কোর্ট আমাদের, কেন্দ্রীয় বাহিনী আমাদের, কেন্দ্রীয় এজেন্সি আমাদের, দেখি কী করে ওরা রাজ্য চালায়?" তখন বুঝতে হবে দেশের গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো আজ চূড়ান্ত রূপে ভেঙ্গে পড়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে সিবিআই লম্ফঝম্ফ করে একজনকেও দোষী সাব্যস্ত করতে পারল না। সিবিআই-এর চূড়ান্ত ব্যর্থতাকে আড়াল করতে, কোনো চাকুরিজীবীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে একতরফাভাবে চাকরি বাতিলের তুঘলকি সিদ্ধান্তকে রাজ্যের সচেতন, সংবেদনশীল নাগরিকেরা কোনো অবস্থাতেই মেনে নেবে না। তারই সঙ্গে বাংলার শিক্ষাব্যবস্থার ওপর এহেন সুপরিকল্পিত আক্রমন সচেতন রাজ্যবাসী কখনও বরদাস্ত করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না। আশা করি, এবারের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের মানুষেরা এর যোগ্য প্রত্যুত্তর দেবে এবং জনবিরোধী নীতির কারণে সারা দেশ থেকে এই প্রতিক্রিয়াশীল চক্রকে চিরকালের জন্য বিদায়ের ব্যবস্থা করবে।