গল্প ও অণুগল্প

আমার মা (সপ্তম পর্ব) [ধারাবাহিক উপন্যাস]



অচিন্ত্য সাহা


।। ৭ ।।

রেজাল্ট আউট হতে আরও দু’সপ্তাহ বাকি। ইতিমধ্যে আমার ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। শিক্ষক হিসেবে অনেকেই আমার প্রশংসা করতে শুরু করেছেন। এক অপরিসীম আনন্দে ভরে ওঠে আমার মন।

অনেকদিন আগে থেকেই আমার স্বপ্ন কৃষ্ণনগর সরকারি মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হবো। মনে পড়ে আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। সরকারি মহাবিদ্যালয়ের খোলা মাঠে খেলা করতে যেতাম। স্কুল থেকে ফিরে বইখাতা রেখে হাত পা ধুয়ে পোশাক পাল্টে চলে যেতাম মাঠে। কখনো হকি, কখনো ফুটবল, কখনো ক্রিকেট খেলে সময় কাটাতাম। কিছু না হলে একটু দৌঁড়ে নিতাম। তারপর সন্ধ্যে হলে বাড়ি ফিরে পড়তে বসা। মাঝে মাঝে আমাদের পাশের বাড়ির মেজদিকে নিয়ে কলেজ মাঠের ওপর দিয়ে নগেন্দ্রনগরে মামার বাড়িতে পৌঁছে দিতে যেতাম। দিদি বলতো - আমি চাই তুই একদিন এই কলেজে ভর্তি হবি আর তোর বন্ধুদের কাছে আমার কথা বলবি। আমি মনে মনে সেই ইচ্ছে পোষণ করতাম। রেজাল্ট বের হলে প্রথমেই সরকারি মহাবিদ্যালয় থেকে আবেদন পত্র সংগ্রহ করবো। আশা করি প্রথম বারেই সুযোগ পেয়ে যাবো।

ঘরে বসে বসে নানান কথা মনের মধ্যে ভেসে উঠছে - শৈশবের দিনগুলো কত ভালো ছিলো। সবাই মিলে একসাথে থাকা, সারিবদ্ধভাবে খেতে বসা, তারপর যার বাসন তাকেই ধুয়ে নেওয়া এবং খাওয়া শেষ হলে একসাথে আসন করে বসা। বড়দের সাথে ভয়ে ভয়ে কথা বলা, বাবার গলা পেলে ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া। তারপর যে যেদিকে পারে ছুটে লুকিয়ে পড়া - যেন একটা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। তারপর স্কুল ছুটি পড়লে গামছার খুঁটে চিঁড়ে মুড়ি বেঁধে পঁচিশ ত্রিশ কিলোমিটার দূরে দাদুর বাড়িতে যাওয়া। না, কোনো গাড়ি ঘোড়াতে নয় একেবারে পায়ে হেঁটে। ওখানে মাসখানেক কাটিয়ে আবার বাড়ি ফিরে আসা - এক অনন্য অভিজ্ঞতা। আমার জ্ঞান হওয়ার অনেক আগেই দাদু মারা গেছেন। মামা ভীষণ খুশি হতেন, ভালোও বাসতেন কিন্তু মামিকে ঠিক বুঝতে পারতাম না। আর দিদা তো আমাকে সহ্য করতে পারতেন না। মামার বাড়িতে অনেক জায়গা জুড়ে উঠোন। সেখানে ধান ঝাড়াইয়ের কাজ চলতো। তিনদিকে তিনটি ঘর, পূর্বদিকে গোয়ালঘর, পশ্চিমদিকে রান্নাঘর আর উত্তরদিকে শোবার ঘর। শোবার ঘরে অর্ধেকটা জুড়ে থাকতো ধান চাল ডাল সরষে এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি। আর অর্ধেকটাতে শোবার খাট, বিছানা তৈরির জায়গা। ঘরের সামনে বিরাট বারান্দা। তার অর্ধেকের বেশী অংশে বাঁশের বাঁখারি দিয়ে তৈরী মাচা। এখানেও বড়ো বিছানা করে দিদা এবং মামার ছেলে মেয়েরা থাকতো। আমরা গেলে বারান্দার খোলা জায়গায় বিছানা করে শুতে হতো। তাতে আমাদের কোনো অসুবিধে হতো না। কেননা আমাদের বাড়িতেও ওই রকম ব্যবস্থা ছিলো। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা আমাদের এইভাবেই কেটে যেত। তাই মামাবাড়ি গিয়ে অতিরিক্ত কোনো সুযোগ সুবিধা পাওয়ার আশা করতাম না। আমার বেশি মজা হতো কালীপুজোর সময়। মামা বাড়ির আশেপাশে অনেকগুলো পুজো হতো। বেশ বড়ো বড়ো কালীঠাকুরের মূর্তি, সেই উপলক্ষে মেলাও বসতো। মেলাতে মামার বড়ো ছেলে পাঁপড় ভাজা, চানাচুর এবং লজেন্স নিয়ে বসতো। দুদিনের মেলায় প্রায় দুশো টাকা লাভ হতো। একবার আমাকে ওর সাথে বসতে হয়েছিল, বলেছিল যা লাভ হবে তা থেকে আমাকেও কিছু টাকা দেবে। টাকার অঙ্কটা বলেনি, তবে মনে হয়েছিল অন্তত কুড়ি পঁচিশ টাকা তো দেবেই। সেবার এত মানুষের সমাগম হবে ভাবতে পারিনি, প্রায় শ'তিনেক টাকা লাভ হয়েছিল। পরের দিন ছিলো ভাইফোঁটা, আমার বাড়ি ফেরার তেমন তাড়া ছিলো না। কেননা দিদি তখন বাড়িতে ছিলো না, একমাত্র দিদি তাই ফোঁটা দেওয়ার মতো কেউ নেই। এদিকে মামা বললেন - জয়, বাড়ি যাস না বাবা, তোর নয়নদি ফোঁটা দেবে। ফোঁটা নিয়ে আজ থেকে, কাল সকালে খাওয়া-দাওয়া করে তারপর বাড়ি ফিরিস।

মামার আদেশ অমান্য করার সাহস ছিলো না, অগত্যা থেকে গেলাম। মামাতো দাদা অমৃতকে বললাম - কই আমাকে কিছু টাকা দিবি বলেছিলি তা দে, আজ ভাইফোঁটার দিন। নয়নদি আমাকে ফোঁটা দেবে ওকে তো একটা কিছু দেওয়া উচিত। কাল রাতে দিবি বলে দিলি না, এখন দে আমি নয়নদির জন্য একটা উপহার কিনবো।

আমার কথা শুনে একপ্রকার তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠার মতো - কীসের টাকা, অ্যাঁ, কীসের টাকা? তুই দোকানে বসেছিস বলে টাকা চাইছিস?

আমি একটু ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে বললাম - আসলে তুই বলেছিলি দেব, তাই চাইলাম, না দিলে না দিবি, তাই বলে এমন দাঁত খিচিয়ে কথা বলবি? আমি কী টাকার কাঙাল, না কী?

পাশ থেকে দিদা হঠাৎ বলে উঠলো - কাঙাল না তো কী? হাড়হাভাতে ভিখিরির বাচ্চা, এখানে এসে প্রতি বছরই দুই এক মাস কাটিয়ে যাস। আমরা জানিনা খাবার লোভেই তো আসিস, বাড়িতে খাবার জোটে না তাই এখানে এসে পড়ে থাকিস। একটু দোকানে বসেছিস বলে টাকা চাইছিস লজ্জা করে না?

কেন জানিনা দিদা আমাকে পছন্দ করে না। ইতিপূর্বে বহুবার এখানে আসি বলে নানাভাবে আমাকে অপদস্ত করেছে, হেয় করেছে, অপমান করেছে। আমি ছোটো ছিলাম অতশত বুঝতাম না, কিন্তু এখন বোঝার মতো যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তাই দিদার কথা বলার ধরন এবং কদর্য ভাষায় আক্রমণ বড্ড পীড়া দিল আমায়। বিশেষ করে বাবাকে টেনে এনে আক্রমণ আমি মেনে নিতে পারলাম না। মৃদু প্রতিবাদ করে বললাম - দেখো দিদা এর আগেও তুমি অনেক আজেবাজে কথা বলেছ, আমি কিছু মনে করিনি। লোক বলে “মামার বাড়ির আবদার” আজ তুমি যা বললে তাতে মামার বাড়ির মানেটাই আমার কাছে বদলে গেল। আমি তো ইচ্ছে করে টাকা চাইনি, ও দিতে চেয়েছিল সেটা স্মরণ করিয়ে দিলাম। আর এ ব্যাপারে তোমাকে তো কেউ কথা বলতে বলেওনি, তুমি আগ বাড়িয়ে এতসব আজেবাজে কথা বলছ কেন আমি তো বুঝতে পারছি না।

আমার কথা শুনে দিদা ছুটে এসে আমার গালে ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দিয়ে বললেন - ছোটো মুখে বড়ো বড়ো কথা। দূর হয়ে যা আমার বাড়ি থেকে, জীবনে কোনোদিন এদিকে পা রাখবি না। যদি আসিস তাহলে তোর ঠ্যাং ভেঙে দেবো। দাঁড়া, তোর মাকে জানাচ্ছি, কেমন ছেলে সে পেটে ধরেছে। আমার নাতি হবার যোগ্যতাই তোর নেই। দূর হয়ে যা চোখের সামনে থেকে। নাহলে আমি...

- কাউকে কিছু বলতে হবে না। আমি এখনই চলে যাচ্ছি। জীবনে কোনোদিন এখানে আসবো না, যদি আসি তাহলে মনে করবে আমি... না থাক আমি কঠিন শপথ করতে চাই না।

সেদিন কিছু মুখে না দিয়েই চলে এসেছিলাম। দিদার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পরও আমি মামাবাড়ি যাইনি। বাস্তবিক আর কোনোদিন সেখানে যাওয়ার কথা মনেও আসেনি।

(ক্রমশ)