(১)
বালিয়াড়ি ধরে মুহুর্মুহু ভেঙে পড়ে ঢেউ। আকিবের বাবা একটা সিঙ্গেল বেড চৌকি মাঝখানে কেটে দুটি টুকরো করে বালিতে দুটো দোকান সাজিয়েছে। একটায় সাদা, ঈষৎ বাদামি শঙ্খ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সাইজের কড়ি, জলশঙ্খ, ঝিনুকের সমাহার। অন্যটায় আকিব ওর আম্মির সাথে ভুট্টা নিয়ে বসেছে। আম্মি জলে সেদ্ধ করা ভুট্টা ছাড়িয়ে নুন, লেবু মাখিয়ে প্লাস্টিকের গ্লাসে বিক্রি করছে। আবার অনেকে কয়লার উনুনে সেঁকা ভুট্টাও কিনছেন। আম্মি, ভুট্টার গায়ে প্রথমে একটা খোসা দিয়ে ভালো করে ডলে পরিষ্কার করে তারপর নুন লেবু মাখিয়ে দিচ্ছে। এসব আকিব রোজ দেখে। তবুও ওর খুব ভালো লাগে। প্রত্যেকদিন আম্মির কাজের হেরফের না থাকলেও কাস্টমার তো আলাদা থাকে! তাই সেই দশ কিলোমিটার দূরের গ্রাম থেকে রোজ ও আব্বু-আম্মির সাথে সমুদ্দুরে চলে আসে। বাড়িতে নানীর কাছে থাকতে একদম নারাজ। ভুট্টা বোঝাই ভ্যানে আম্মির কোল ঘেঁষে চুপ করে বসে থাকে আর আব্বুর প্যাডেল ঘোরানো দেখে। এইসব ঘূর্ণন, ভ্যানের চেনের শব্দ, আব্বুর গলায় ঝোলানো গামছা দিয়ে মাঝে মাঝেই কপাল ঘাড় মুছে নেওয়া, রোজ একইরকমভাবে আম্মির মণিতে ঢেউ আছড়ে পড়া ওকে মুখরিত করে তোলে। আভ্যন্তরীণ শব্দের তোলপাড় শশব্যস্ত করে তোলে আকিবকে। ও চেঁচিয়ে বলতে চায়, 'আব্বু, দাঁড়িয়ে একটু পানি খাও!' পারে না। ঠোঁট নড়ে। অথচ শুধু হাওয়া বেরিয়ে আসে। নিঃশব্দের কলতান। আম্মির শাড়ি ধরে জোরে জোরে ঝাঁকায়। চোখ মুখ উঁচিয়ে, আঙুল নির্দেশ করে বোঝানোর চেষ্টা করে যে আব্বুর কষ্ট হচ্ছে। কোনোদিন হয়তো পারে। কিন্তু বেশিরভাগ দিনই সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দের সাথে ফিরে যায় ওর ব্যর্থ চেষ্টা অতলের গহ্বরে। রেখে যায় বালি। জমে জমে পার গড়ে ওঠে। ওই পারে আকিবের আব্বু আর আম্মি আবার শঙ্খের পসরা সাজিয়ে বসে। এবছর বড় বিটিয়ার নিকাহ করতেই হবে। আকিব সমুদ্রের দিকে তাকায়। ছোট্ট চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। মনে মনে বলে, 'একদিন আমার শব্দ এই ঢেউয়ের শব্দকে ছাড়িয়ে যাবেই!' কাস্টমার এলে অর্ডার বুঝে ভুট্টা এগিয়ে দেয় আম্মির দিকে। আম্মি খুশি হয়। খুব খুশি। আকিব বুঝতে পারে আম্মি খুশিতে ভেতরটা হাসছে ওরই মতো। অথচ বাইরে দেখাতে পারছে না। আম্মির জন্য ওর খুব কষ্ট হয়। অনেক রাতে বাড়ি ফেরার পথে ভ্যানে ও আম্মিকে জড়িয়ে ধরে। সমস্ত মুখ, কপাল, গাল ভরে ওঠে মায়ের আদরে। 'এই তো! এটাই তো আম্মির সেই খুশিটা!'... এসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন আকিব ঘুমিয়েও পড়ে।
(২)
অগ্নিমিত্রা সিংহ 'ভিক্টরিয়া হোটেল'এর এ.সি. ডিলাক্স থেকে দু'হাতে দুই ছেলেমেয়ের হাত ধরে লিফ্ট দিয়ে নেমে সোজা সামনের গ্যাজেবোতে এলেন। 'ঘরে বসে থাকার জন্য তো এতদূরে আসিনি! ওরা থাকুক। চল আমরা বিচে ঘুরে আসি। মোবাইল সাথে আছে। দরকার হলে ডেকে নেবে।' আর্য আর আর্শিয়ার ঠোঁটের কোল থেকে উপচে উঠলো সাদা আনন্দ মেশানো সমুদ্রের ঢেউ। নীল চিনোস আর দুধ সাদা হাকোবা ক্রপটপ পরিহিতা ছিপছিপে মেদহীন অগ্নিমিত্রা একটি প্রাইভেট ব্যাঙ্কের পলিসি কনসালট্যান্টএর চার্জে আছে। যমজ ছানাদের বয়স প্রায় সাত। রাস্তা পেরিয়ে এপাশের বিচ লাগোয়া ফুটপাতে এসে হাফ পাঁচিলের ওপরে দু'জনকে কোলে তুলে বসিয়ে দিলেন। 'এখানে বসো। কী সুন্দর হাওয়া! আমি একটু চা খাই।' পাশেই বালির ওপরে চায়ের দোকান। মাটির ভাঁড়ে গরম চা'এ শব্দ করে এক লম্বা চুমুক। 'আহঃ'... এক কাপ শেষ করে আরেকবার ভাঁড় বাড়িয়ে দিলেন। ওরা দুজনে সমুদ্র ছেড়ে, ফুটপাতের ‘গ্যাঞ্জাম’ ছেড়ে মায়ের দিকে অপলক তাকিয়ে। এমনটা খুব কমই দেখেছে। 'মাম্মা, স্ট্রিট ফুড খাচ্ছ!'... অগ্নিমিত্রা হেসে চায়ের দাম মিটিয়ে ওদের নিয়ে বালিতে নেমে গেলেন।
সন্ধ্যার এই সময়টা রামধণু ছাতা আর লেড লাইট বালির বুকে রঙধনু ছড়ায়। বিচ যেন জল ঢেকে ছোটখাটো মেলা। জনসমাগমও এসব দোকানের দিকেই বেশি। আঁধার ঘেরা সমুদ্রে ঝাপসা ঢেউ দেখতে বেশিরভাগই নারাজ। যাকে ছোঁয়া যায়, ইচ্ছেমতো ঝাঁপিয়ে ছিন্নভিন্ন করে অবগাহন করে আনন্দের লুটেরা হওয়া যায় তাকে শুধুমাত্র চাক্ষুস করাতে কী সুখ আছে! আর্য মায়ের দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলো, 'মাম্মা, আরেকটু এগিয়ে যাই। প্লিজ।' অগ্নিমিত্রা ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে তার আছড়ে পড়াগুলো দেখছিল। কত মরমীয়া জলের কোন্দল! যত তর্জন গর্জনে এগিয়ে আসছিলো আছড়ে পড়ার মুহূর্তে ততটাই ম্রিয়মান হতাশ শব্দেরা। এক বুক বালি ঢেলে ফিরে যাওয়ার সময়ই পেছনের আরেকদল জলজীবন তার লহরী নিয়ে উপস্থিত। মুখোমুখি সংঘর্ষ। একতাল ফেনাসহ ঢেউয়ের মৃত্যু। আর্যর কথায় হুঁশ ফিরতেই সজোরে 'না না, একদম না। এখন ভিজলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে পাপ্পা' বলে উঠলেন। তাকিয়ে দেখলেন আর্শিয়ার দৃষ্টি পাশের দিকে নিবদ্ধ।
ওদিক থেকে একজন হকার কাঁধে বড় ব্যাগ নিয়ে একহাতে লাঠি আর অন্যটায় একমুঠো সলতে ধরে ওদের দিকেই এগিয়ে আসছেন। আসতে আসতে ভুল করে বিচে বসা টেম্পোরারি মুড়িমশলাওয়ালার সাথে লাঠির ধাক্কা। কিন্তু লোকটি একটুও না রেগে হাত ধরে হকারটিকে অন্যদিকে এগিয়ে দিলেন। হকারটি ক্রমশঃ ওদের দিকে এগিয়ে এসে অগ্নিমিত্রা আর আর্শিয়ার মাঝখান দিয়ে লাঠি ঠুকঠুক করতে করতে বেরিয়ে গেলেন। অগ্নিমিত্রা মেয়ের কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালেন। 'হি ইজ ব্লাইণ্ড মাম্মা। সি, হাউ ডিফিকাল্ট হিজ লাইফ ইজ! স্টিল হি ইজ ফাইটিং।' আর্শিয়া বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে দেখছিল অন্ধ মানুষটার চলে যাওয়া। ক্রমশঃ ভিড়ে সে অবয়ব অস্পষ্ট হয়ে এলে ও ওর মাকে জড়িয়ে ধরে। 'মাম্মা, কান্ট উই হেল্প হিম?'... অগ্নিমিত্রা ঝটপট ব্যাগ থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে মেয়ের দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
– গো। সলতে কিনে নিয়ে এসো।
– সলতে?
– ওই যে, উনি যেটা সেল করছিলেন!
আর্শিয়া একছুট্টে এগিয়ে গেল সামনে। নাঃ, বেশিদূর যাননি! একবার পেছনে তাকিয়ে দেখলো আর্য আর মাম্মাও তাড়াতাড়ি আসছে। অতএব, ও হারিয়ে যাবে না। বালিতে দৌঁড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বলে উঠলো, 'সলতে দাও।' লাঠির ঠুকঠুক মুলতুবি হয়েছে। যে হাতে এক গোছা সলতে ধরা সেই হাতে লাঠিটিকে গুঁজে ডান হাত গুটিগুটি ঢুকলো কাঁধের ব্যাগের ভেতরে।
'ইয়ে ওয়ালা বিশ রূপাইয়া, ইয়ে দশ। কৌনসা দু?'
ততক্ষণে অগ্নিমিত্রা প্রায় হাজির মেয়ের কাছে।
'পঁচাশ রূপাইয়া কা', অগ্নিমিত্রা পাঁচটা দশটাকার সলতে নিয়ে মেয়েকে ইশারা করলেন টাকাটা বাড়িয়ে হাতে দিতে। এক ঢেউ তার বালি ফেলে ফিরে গেল নিজের পথে। অন্য ঢেউ সহস্র আনন্দ আর খুশির বুদবুদ নিয়ে মিশে গেল সেই বালিতে। অগ্নিমিত্রা দেখলেন কয়েক মাইল ধরে দৃশ্যত সেই বালুচরে অজস্র কাঁকড়ার ছিদ্র ফুটফাট করে জাগছে। সৌজন্যে যেন হাওয়া ভরে দিচ্ছে বালির প্রাণে। হঠাৎই বেজে উঠলো মোবাইল।
– হ্যালো।... হ্যাঁ। আমার সাথে আছে।... কালকের পুজো দেওয়ার সলতে কিনতে বেড়িয়েছি। একটু পরে ফিরছি।
দুই হাতে সন্তানদের হাত ধরে আবার এগিয়ে চললেন জলের দিকে। বিচে এসে একবার পা না ভেজালে হয়!