সেপ্টেম্বরের ছ' তারিখ রাত আটটার মধ্যে হাওড়া স্টেশন পৌঁছে যাই। আটটা পঁচিশ ডুন এক্সপ্রেস ছাড়ার কথা। এসি টু টিয়ার কোচ আপার বার্থ নির্দিষ্ট সীটে বসে পড়ি। আসার সময় ঘর থেকে রাতের আহার একবারে সেরে এসেছি। ট্রেনে দুটো ব্যাপারে স্বছন্দ নই। লাঞ্চ বা ডিনারের মত ভারী খাবার খেতে আর চলমান গাড়িতে ঘুমানো। এ দুটো ট্রেনে ঠিকমতো হয়ে ওঠে না। তাই রাতের সঙ্গী মোবাইল আর বই। এ ছাড়া সারা রাতের পিপাসা মেটাতে ফ্লাস্ক ভর্তি চা আর কাগজের কাপ থাকবেই।
প্রায়শ অফিসের কাজে বাইরে যেতে হয়। পেশাগত ভাবে সাংবাদিক। দৈনিক প্রভাতে কর্মরত। এবার চলেছি হরিদ্বার অফিসের কাজে। চিফ এডিটর এক গোপন অ্যাসাইনমেন্টের দায়িত্ব আমাকে দেওয়ায়। সংবাদ পত্রিকাতেও প্রতিযোগিতা থাকে কোন গুরুত্বপূর্ণ খবর কার আগে কে প্রকাশ করতে পারে। বাইরে যেতে হলে বরানগরের ফ্ল্যাট থেকে স্ত্রী আর ছেলেকে শ্বশুর বাড়ি বেহালায় জেমস লং সরণীতে পাঠিয়ে দিই।
আটটা কুড়ি হতে চললো সামনের সীটের যাত্রীর এখনো দেখা নেই। একটু পরে দ্রুত এক যুবক সীট খুঁজে আমার মুখোমুখি এসে বসে। লাগেজ নেই বললে চলে। শুধু নিত্য যাত্রীদের মত পিঠে একটা ব্যাগ সেটা খুলে কোলের উপরে রেখে গালে হাত দিয়ে বসে থাকে। হকারদের হাঁকডাক যাত্রীদের চেঁচামেচি কোন কিছুতে ভাবান্তর নেই, এমন কি মুখোমুখি যে আমি বসে ওকে লক্ষ্য করছি, সে ব্যাপারেও উৎসুক নয়। আটটা পঁচিশে গাড়ির ছাড়ার আগে শেষ বারের মতো হকাররা বিক্রি সেরে নেমে যায়। ট্রেনের অন্য যাত্রীরাও রাতের আহার সেরে নেয়। গাড়ি নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়ে। আমিও শেষবারের মত স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গে রাতের কথা সেরে নিই। ট্রেন ক্রমশ স্পীড বাড়িয়ে চলে।
কেউ কেউ শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কামরার আলোগুলো আসতে আসতে কমতে থাকে। অ্যাটেনডেন্ট এসে তদারকি করে গেছে। রাত দশটা কুড়িতে ট্রেন বর্ধমান পৌঁছালো, দেখি যুবকটি একই ভাবে গালে হাত রেখে নিশ্চল ভাবে বসে রয়েছে। অন্য যাত্রীরা ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে। আমি আর যুবকটি কামরায় একমাত্র জেগে। কতই বা বয়স হবে চৌত্রিশ, পয়ত্রিশ এই বয়সে অন্য যুবকরা ট্রেনে উঠলে হয় কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনতো নচেৎ জোরে জোরে মোবাইলে বন্ধুদের সাথে কথা বলে অন্য যাত্রীদের সমস্যা করতো। এ সম্পূর্ণ বিপরীত। রাতের আহার সেরেছে কিনা জানিনা। সামনের যাত্রীর প্রতিও কোন আগ্রহ নেই। এই বয়সে এই অস্বাভাবিকতা আমার মতো সাংবাদিকের মনে কৌতূহল তৈরি করে। রাত সাড়ে এগারোটায় সারা কামরায় আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ জেগে নেই। আর চুপ থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করি বাঙালি? আমার দিকে মৃদু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। বলি ঘুম আসছে না? আমারও ট্রেনে উঠলে ঘুম আসে না। খানিক চুপ থেকে বলে, ট্রেনের দোষ নেই আজ বছর দুই ঘুম আমার সঙ্গ ত্যাগ করে, যেমন কাছের কেউ সম্পর্ক ছিন্ন করে চিরবিদায় নেয় সে ভাবে ঘুমও বিদায় নিয়েছে। ধন্দে পড়লাম ওর কি নিদ্রাহীনতার সঙ্গে ওর জীবনের কোন ঘটনার যোগ রয়েছে, নাকি উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করলো কথাটা? কৌতুহল উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে তাকে। আলাপ জমাবার জন্য বলি এত দিন টানা ঘুম না আসা তো শরীরের জন্য ক্ষতিকারক। দরকার হলে ডাক্তারের পরামর্শ নাও। এই দেখ, তোমায় তুমি বলে ফেললাম। বলে ঠিক আছে আপনি আমার চেয়ে বয়সে অনেকটা বড়, অসুবিধে নেই। খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে নিজেই বলে কোন ডাক্তার আমার ঘুম ফিরিয়ে আনতে পারবে না। আরও কিছুটা যাতে মুখ খোলে তাই ফ্লাস্ক থেকে চা ঢালতে ঢালতে বলি, চা চলবে তো? মৃদু একটু মলিন হেসে বলে, আপত্তি নেই। একটা কাপ ওর দিকে বাড়িয়ে দিই। দুজনে চুপচাপ চা পান শেষ করে বলি, আমি নির্মল সেন, পেশায় সাংবাদিক, দৈনিক প্রভাতে কর্মরত। তুমি? একটু চুপ থেকে বলে, আমি অর্ণব দাস। আই টি সেক্টরে কর্মরত বলে এক নামী কম্পানির নাম বলে। জিজ্ঞেস করি বিবাহিত? বলে, হয়েছিল একসময় এখন অতীত। মনে মনে ভাবি সবটাই পাস্ট কেন? কি রহস্য আছে ওর জীবনে? এত অল্প বয়সে নিদ্রাহীনতাই বা কেন?সাংবাদিকদের ওই একটা দোষ জানার কৌতূহল অপরিসীম। বলি, আমি কি তোমায় আঘাত দিয়ে ফেললাম? অতীত বলছো কেন? সে কি আর নেই? প্রয়াত? যদি আপত্তি না হয় খুলে বলতে পারো।
দীর্ঘ রাত একমাত্র কামরায় জেগে থাকা দুজন যাত্রী। অনেকটা পথ একসাথে যেতে হবে, লখনৌ পর্যন্ত আমরা সহযাত্রী। বুঝতে পারছি, তোমার নিদ্রাহীনতার সাথে তোমার কাছের কারোও কোন যোগসূত্র হলেও হতে পারে। আর অসুবিধে না থাকলে বড় দাদা মনে করে তোমার কষ্টর অংশটুকু বলে যদি কিছুটা হাল্কা হতে পারো, আমার ভালো লাগবে। বলে, অসুবিধা নেই কিন্তু নিজের দুর্ভাগ্যর কথা অন্যকে বলে বিব্রত করা কি সমীচীন হবে? বলি, নির্দ্বিধায় বল, দাড়াও আগে দু'কাপ চা ঢালি, ওকে এক কাপ দিয়ে বলি, এবার বল। চা চুমুক দিয়ে বলে, আজ থেকে আট ন'বছর আগে বি টেক পাশ করে আই টি তে কাজে যোগ দিই। বাবা পদস্থ সরকারি কর্মচারি ছিলেন, বর্তমানে অবসর প্রাপ্ত ও পেনশনভোগী। কয়েক বছর যেতে না যেতে ঘরে মা বাবা বিয়ের ব্যাপারে জোর করতে থাকে। পরে করার কথা বললে, জানতে চায় আমার পছন্দের কেউ থাকলে, ওদের আপত্তি হবে না। বলি, না আমার কোন পছন্দের নেই, তোমরা দেখতে পারো।
এরপর ঘটকের মাধ্যমে অনেক সম্বন্ধ আসতে থাকে। আমায় ফটো দেখে পছন্দ করতে বলে। একবার গোটা পাঁচ ছয় ফটো আমার হাতে দিয়ে বলে পছন্দ করার জন্য। ফটোগুলোতে প্রত্যেকেই সুন্দরী বলা চলে। তবে ফটোগুলো সামনে মেলে ধরলে যে ফটোটি সব চেয়ে আগে নজর কাড়বে, সেটি তুলে নিই। মুখে যেন রহস্যময় হাসি। বাঁ গালে মিষ্টি একটা টোল। চোখ দুটো যেন কাজলা দিঘির কাজলের গভীরতা। এক নজরে নজরকাড়া ছবি। বলি, এটা খোঁজ নিয়ে দেখতে পার। মা বলে, ছেলের আমার পছন্দের চোখ আছে।
খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায় ওরা দু'বোন, ও বড় আর দু'ভাই। বাবা চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারী বছর দুই পরে অবসর। বলা যায় নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। যদিও বাবার মৃদু আপত্তি ছিল, কিন্তু মার কথায় রাজি হয়ে যান।
বিয়ের পর অষ্টমঙ্গলাতে গিয়ে বুঝতে পারি ওদের বাবা স্বল্প বেতনের কর্মচারী হওয়ায় আর পরিবার বড় হওয়ায় ওদের অনেক ইচ্ছে, শখ অপূর্ণ থেকে গেছে। সদ্য বিয়ে করা যুবক স্ত্রীর অপূর্ণ ইচ্ছেগুলো পূরণ করার সংকল্প মনে মনে গ্রহন করে। ফলে দু'তিনটি কোম্পানী পরিবর্তন করি। বর্তমানের এই কোম্পানীতে অধিক বেতনে কর্মরত। বিয়ের পর দার্জিলিং হানিমুনে গিয়ে দুজন দুজনকে কাছে পেয়ে অনেক অনেক স্বপ্নের জালবুনি। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলো মনে মনে লিপিবদ্ধ করি। একে অপরকে চোখে হারাতে থাকি। স্বপ্নের মতো দিনগুলো খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়। এরপর কোম্পানী একটা বড় প্রমোশন দিয়ে পুনেতে পাঠায়। অনেকটা দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়। ফলে রঞ্জুকে নিয়ে মানে আমার স্ত্রী রঞ্জনা কে নিয়ে পুনেতে ফ্লাট ভাড়া করে নতুন সংসার পাতা হয়।
পুনেতে যেহেতু অবাঙালি বেশি তাই রঞ্জুর মেলামেশার, কথা বলার একটা সমস্যা হয়। এ দিকে অফিসের অনেকটা দায়িত্ব কাঁধে থাকায় আমাকে সকাল নটায় অফিসে যেতে হতো আর ফিরতে ফিরতে রাত নটা, সাড়ে নটা হয়ে যেত। ফলে এতটা সময় একা ফ্লাটে কাটানো ওর পক্ষে মুস্কিল হতো। সারাটা দিন কত আর মোবাইল আর টিভি দেখে কাটানো যায়? ফলে সারা দিন কারো সাথে কথা বলার জন্য উৎসুক থাকতো। শুধু রবিবার ছুটির দিনটি আমাদের দুজনের একসাথে কাটতো। বিকেলের দিকে বেড়িয়ে ঘুরে ফিরে রাতের ডিনার সেরে দুজনে ঘরে ফিরতাম। আস্তে আস্তে পথঘাট পার্ক রেস্তোরাঁ বাজার পরিচিত হওয়ার ফলে অফিসের দিনগুলো একাই প্রয়োজনীয় জিনিস কেনা, ঘোরা কখনও রেস্টুরেন্টে যাওয়া একাই করতে শিখে যাওয়ায় আমি কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে অফিস যেতাম, যে ওর সময় তো কিছুটা কাটবে এভাবে। প্রথম বছর বিবাহ বার্ষিকীতে দশ দিনের ছুটি নিয়ে দুজনে কাশ্মীর ঘুরে আসি। ইচ্ছে মত খরচ খরচা করা, ভাই বোনদের কিছু গিফ্ট করা ইত্যাদি পুরো স্বাধীনতা দিয়েছিলাম ওকে। এছাড়া ওর নিজস্ব ইচ্ছেগুলো যা বিয়ের আগে পূরণ হয় নি, তা আমি চেষ্টা করতাম পূরণ করতে।
পুজোতে বাড়ি গেলে আমাদের বাড়িতে দু' একদিন কাটিয়ে বাপের বাড়ি চলে যেত। আপত্তি করতাম না। পুনেতে কথা বলার লোক কম, তাই যে ক'দিন এখানে থেকে মন খুলে বন্ধু, ভাই-বোনদের সাথে সময় কাটাক। আবার ফিরে তো একাই থাকবে। পুনেতে ফিরে আমার অফিসের দিন গুলো একা চলাফেরা করতে করতে এক অবাঙালি যুবকের সাথে ওর পরিচয় হয়। ওর সাথে রেস্তোরাঁ যাওয়া, ঘোরাফেরা, কন্টাক্ট নাম্বার দেওয়া এ সবই চলতো আমার অজান্তে। এমন কি অফিস চলে যাওয়ার পর আমার ফ্লাটে প্রায় যুবকটি আসতো আমার অগোচরে। পরে কেয়ারটেকারের কাছে যখন জানতে পারি, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকীতে পাঁচ দিনের ছুটি মঞ্জুর হওয়ায় দূরে কোথাও না গিয়ে মুম্বাই ঘুরে আসি। এর কয়েক দিন পর থেকে ওর চলনে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করি। প্রথম প্রথম খেয়াল করিনি। কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে যেতো। আগের মতো দেরি করে ঘরে ঢুকলে কোন অভিযোগ করতো না। মোবাইলে বেশি সময় কাটাতো। ছুটির দিনে বাইরে ঘোরা ও ডিনার করায় তেমন উৎসাহ দেখাতো না। ভাবতাম বিবাহ বার্ষিকীতে দূরে কোথাও যেতে না পারায় হয়তো অভিমান হয়েছে। ছুটির দিনে সমস্ত সময়টা ওর জন্য ব্যয় করলেও আগের মতো সেই উদ্দীপনা ওর মধ্যে দেখতাম না। অফিসের গুরুদায়িত্ব কাঁধে থাকায় এ নিয়ে বেশি ভাবার অবকাশ ছিল না। এদিকে আমার অনুপস্থিতিতে আমারই ঘরে কেউ সিঁদ কাটছে জানার সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকীর মাস চারেক পর দিন পনের এক লম্বা ছুটি পেয়ে যাই ম্যানেজমেন্ট আমার কাজে সন্তুষ্ট হওয়ায়। রঞ্জুকে সারপ্রাইজ দেব ভেবে ওকে আগে না বলে আন্দামানের দুটো টিকিট ফ্লাইটে কেটে রাখি। ঠিক করি স্রেফ একদিন আগে বলে, ওর খুশি খুশি মুখটি কি রকম হবে কল্পনায় অনুমান করি।
আগের দিন অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে সন্ধ্যা ছ'টায় ফ্ল্যাটে এসে দেখি লক করা। আমাদের দুজনের কাছে চাবি থাকে। ও বেরোলে লক করে গেলে আমি অফিস থেকে ফিরলে নিজে লক খুলে ঢুকি। সে দিন ও ওই ভাবে লক খুলে ফ্লাটে ঢুকে ফ্রেস হয়ে টিভি তে খবর শুনতে থাকি। ভাবছি কিছু দরকারে বাজার গেছে হয়তো চলে আসবে। দেখতে দেখতে রাত হতে থাকে অথচ রঞ্জুর তখনও না ফেরায় চিন্তিত হয়ে পড়ি। ওর ফোনে ফোন করে সুইচ অফ পাওয়ায় চিন্তা আরো বেড়ে যায়। বাইরে বেরোবার জন্য পোষাক পড়তে বেডরুমে ঢুকে দেখি একটা কাগজ বেডে চাপা দেওয়া। খুলে দেখি রঞ্জুর হাতে লেখা একটা চিঠি। অর্ণব আমি চল্লাম, আমার মনের মানুষ খুঁজে পেয়েছি যে আমার জন্য দিনের চব্বিশ ঘণ্টাই সঙ্গ দিতে রাজি। তুমি হয়তো অনেক ইচ্ছে পূরণ করেছো কিন্তু নিঃসঙ্গটা দূর করতে পারোনি। এভাবে জোড়াতালি জীবনের চেয়ে সঠিক ঠিকানার সন্ধানে নতুন ভাবে জীবনটাকে গড়ে তুলতে পথের সাথীর হাত ধরে বেরিয়ে পড়লাম। তুমি আমার খোঁজ করোনা, পারলে ভুলে যাও, ভাব আমি মৃত। নতুন করে সংসার কোরো। ভালো থেকো। রঞ্জনা।
চিঠিটা পড়ে পাথরের মত নিশ্চল হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকি। তারপর নীচে নেমে কেয়ার টেকারকে জিজ্ঞেস করি মেমসাহেব যখন বেরোয় সঙ্গে কেউ ছিল কিনা? বলে হ্যাঁ সাব মেমসাহেবের সঙ্গে আপনার দোস্ত এক সাহেব ছিল। উনহোনে হামেশাই আসতো, মেমসাহেব বলতো, সাহেবের দোস্ত। যা বোঝার বুঝে যাই। সারা রাত দু'চোখের পাতা এক করতে পারিনি। অফিস থেকে ছুটি মঞ্জুর করা ছিল ওটা বাতিল করি না। ফ্লাইটের টিকিট দুটো বাতিল করে কোলকাতার ফ্লাইটে বাড়ি ফিরে আসি। আমাকে হঠাৎ একা দেখে বাবা মা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। জিজ্ঞেস করে বৌমা এলোনা? ওদের হাতে রঞ্জনার চিঠিটি দিই। ওসব ঘটনা খুলে বলি। শুনে ওরা যথেষ্ট চিন্তিত হয়ে পড়ে। ওখান থেকে বেড়িয়ে রঞ্জনাদের বাড়ি যাই। ওদের মেয়ের কৃতকর্মের কথা জানাতে হবেতো। আমাকে একলা দেখে ওর বাবা জানতে চায় রঞ্জু কি পরে আসবে? ওনার হাতে রঞ্জনার চিঠিটা দিই। পড়ে কঠিন মুখে বলেন আজ থেকে জানবো আমার বড় মেয়ে আমাদের কাছে মৃত। পারলে তুমি আমাদের ক্ষমা কোরো। তোমার মত সুন্দর মনের স্বামীর সাথে যে মেয়ে ঘর করতে পারে না, সে তার দুর্ভাগ্যর জন্য নিজে দায়ী থাকবে। কারো কিছু করার নেই। ওখান থেকে ফিরে ঘরে দুদিন চুপচাপ কাটাই। কারো সাথে সে ভাবে কথা বলতাম না। এরমধ্যে আইনজীবী মাধ্যমে থানায় এফআইআর করে রাখি। বাকি ক'দিন ওর এখানে ওখানে খোঁজ করি। বাবা মা আমার অবস্থা দেখে মনের দিক দিয়ে ভেঙে পড়ে।
এরপর যে প্রশ্ন আমায় কুরে কুরে খায় তাহলো, আড়াই বছর একসাথে ঘর করে ও কি কখনও আমায় বিন্দুমাত্র ভালোবাসে নি? আর যদি বেসে থাকে তাহলে সেই ভালোবাসাকে বাজারের বেসাতি করলো কেন? ওর কাছে জানতে চাই? তাই আজও আমি ওকে খুঁজে বেড়াই এত স্বপ্ন সাজানো এত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সবই কি নিছকই অভিনয় ছিল? জানতে ওর সন্ধান করে চলেছি আজও কারণ এ প্রশ্নের জবাব যেমন আমার কাছে নেই, তেমন আমার চোখেও আজ ঘুম নেই। কোন ডাক্তার তার ওষুধে শুধু চিরনিদ্রার ঘুম আনতে পারে প্রতিদিনের নয়। চমকে উঠি ওর কথা শুনে। শুনতে শুনতে ওর প্রতি এক মমত্ববোধ অনুভব করি। মৃদু ভর্ৎসনা করে বলি- ছি তুমি না পুরুষ মানুষ যে একবার তোমার ভালোবাসার কথা ভাবলো না, শ্বশুর শাশুড়ীর সম্মানের কথা ভাবলো না, নিজের বাবা মা'র কথা ভাবলো না একবার, এমন কি আর এক বোন আছে তার বিয়ে দিতে কতটা সমস্যায় পড়বেন বাবা মা তাও ভাবলো না। এমন আত্মসুখ সর্বস্য মেয়ে সব ভুলে স্বার্থপরের মতো বেড়িয়ে যেতে পারে তার কারণে নিজেকে শেষ করতে চাও? ভাবো তো তোমার কিছু হয়ে গেলে বৃদ্ধ বাবা মা কি ভাবে বাঁচবেন? মন কে শক্ত করো। আমি বলবো না এখুনি তুমি নতুন করে আবার সংসার করো। শুধু বলবো স্বেচ্ছায় যে চলে যায় তাকে খোঁজা মানে অনিদ্রিত মানুষের জোর করে ঘুমানোর ভান করার সামিল। ছাড়ো ওসব বরং নিজের কাজ ভালো ভাবে করে যাও মা বাবার খেয়াল রেখো আর চলার পথে যদি কখনও কোন নারীর সাথে পরিচয় হয় আর যদি মনে হয় ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য তবে দুজনে মিলে নতুন স্বপ্ন রচনা কোরো। তোমার জীবনের ঘটনা শুনে একটাই কৌতুহল মনে, যে নারী এ রকম করতে পারে তার ছবি দেখার ইচ্ছেটা অস্বীকার করতে পারি না। তোমার যদি আপত্তি না থাকে আর কোনো ফটো থাকলে দেখাতে পারো। বলে বিন্দু মাত্র আপত্তি নেই বলে পার্স খুলে রঞ্জনার একটি ছবি বের করে আমায় দেখতে দেয়। মেয়েটি সত্যি সুন্দরী। ভাবি সুন্দর চেহারায় এমন স্বার্থলোভী মন কেন দিল ভগবান? লখনৌ আসায় অর্ণব নেমে যায়। যাওয়ার আগে গভীর ভাবে হ্যান্ডশেক করে ওকে বিদায় জানাই।
হরিদ্বারে অফিসের কাজে তিন দিন ব্যস্ত ছিলাম। কাজ সেরে কোলকাতায় ফিরে আসি। কদিন অর্ণবের জীবনের পাতা গুলো চোখের সামনে ভেসে থাকে। কতই বা বয়স চৌত্রিশ, পয়ত্রিশ। এই বয়সে জীবনের রূপ রঙ রস কেমন ফিকে হয়ে পড়ে সবচেয়ে আপন জনের কাছ থেকে আঘাত পাওয়ার পর। মনটা বিষন্ন হয়ে পড়ে অর্ণবের জন্য। একদিন শুধু স্ত্রীকে ঘটনাটা বলি, শুনে অর্ণবের প্রতি সমব্যথী হয়ে পড়ে ও। এরপর নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে আর ভাবার অবকাশ থাকে না। মাস খানেক পর আবার এক অ্যাসাইনমেন্ট আসে মুম্বাই যেতে হবে। নারী পাচারকারী এক চক্র অতি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলার গ্রামীন অঞ্চলে বিশেষ করে সুন্দর বনে বাদা অঞ্চল থেকে কাজের টোপ দিয়ে মেয়েদের বিভিন্ন নিষিদ্ধ পল্লীতে বিক্রি করছে। এ রকমই এক বাংলার কিশোরীকে পাচারকারীরা মুম্বাই এর নিষিদ্ধ পল্লীতে মোটা টাকায় বিক্রি করে দেয়। কিশোরী ওখান থেকে পালাবার উপায় না পেয়ে ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।
ঘটনাটি মিডিয়ার নজরে আসায় হইচই পড়ে যায়। চিফএডিটর আমাকে দায়িত্ব দেন ওখানে গিয়ে গোপন অনুসন্ধানের মাধ্যমে খবর গুলো সংগ্রহ করে জনসমক্ষে ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরে জন সচেতন করা। যথেষ্ট ঝুঁকি এই কাজে কারণ নিষিদ্ধ পল্লীতে গিয়ে তথ্য তালাশ করা রীতিমতো বিপদজনক। যাইহোক ওখানে পৌঁছে লোকাল থানায় যোগাযোগ করে নিজের কাজে বেড়িয়ে পড়ি। প্রথম দিন স্থানীয় টাউটরা সন্দেহর চোখে দেখতে থাকে আমায়। খুব বেশি সুবিধা করতে পারিনা। দ্বিতীয় দিন ঠিক করি ওদের মধ্যে যে বশটাউট তাকে টাকার টোপ দিয়ে কাজ উদ্ধার করতে হবে। একজন বেশ ভারিক্কি চেহারা তাকে অন্যরা ওস্তাদ বলছিল, ওকেই আড়ালে ডেকে টোপটা দিই। ওর নাম সফিক। বলি সফিক ভাই তুমি যদি আমায় একটু মদত করো, তোমায় আমি কিছু টাকা দিতে পারি। জানতে চায় কি করতে হবে?বলি কদিন আগে বাংগাল থেকে এক লেড়কিকে এখানে বিক্রি করে পাচারকারীরা। লেড়কিটা সুইসাইড করে ওর সম্বন্ধে যা জানো বলো। বলে বাবু সাহেব সাবধান এখানে অনেক খোঁচড় আছে তারাই পাচারকারীদের খবর পৌঁছে দিলে বিপদ। দু'সাল আগে এক বাঙালি আওরত এখানে আসে, এই লেড়কি ওর সাথে বাঙলায় বাতচিত করতো, ওই জানবে ওর ব্যাপারে। চলুন আপনাকে ওর কাছে নিয়ে যাই। বলে একটা সরু গলি দিয়ে আধো অন্ধকারে পুরানো দোতলা বাড়ির কাছে নিয়ে গিয়ে রেশমী বেগম বলে ডাকতে থাকে। একটু পরে একটা মহিলা নীচে নেমে আসে, সফিক ওকে ফিসফিস করে কি যেন বলে আমায় দেখিয়ে। তারপর বলে আসুন, আমায় নিয়ে উপরে ওর রুমে বসায়। এবার পরিস্কার আলোতে ওকে দেখে চমকে উঠি। বেশি দিনের কথা নয় ফটোটা চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভাসছে। অর্ণব যাকে পাগলের মত খুঁজে বেড়াচ্ছে এতো সেই রঞ্জনা। ভীষণ অবাক হলেও প্রকাশ করি না। কিশোরীর আত্মহত্যা সংক্রান্ত যেটুকু তথ্য ওর জানা ছিল সংগ্রহ করি। যাওয়ার আগে বলি একটা কথা জিজ্ঞেস করবো। সম্মতি দিতে বলি, কথা বলে বুঝেছি আপনি একজন বাঙালি। একজন বাঙালি নারী কি করে এই নিষিদ্ধ পল্লীতে এসে উদয় হয়? চুপ করে থাকে উত্তর না দিয়ে। বেরিয়ে আসার আগে হঠাৎ জিজ্ঞেস করি অর্ণব দাস কে চেনেন? শুনে ভুত দেখার মত চমকে ওঠে। দু-হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে থাকে। জিজ্ঞেস করে আমি কি ভাবে ওকে চিনি? বলি সে কথা থাক শুধু জানতে ইচ্ছে হয়, যার হাত ধরে সুখের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন নতুন ঠিকানার সন্ধানে এটা কি সেই ঠিকানা? আর মনের মানুষ সে আজ কোথায়? কথাগুলো একটু রূঢ় স্বরে বলি। কাঁদতে কাঁদতে বলে সুখের ঘরে থাকতে থাকতে মনে অসুখ বাসা বেঁধে ছিল কখন, জানতে পারিনি। শয়তান মনে ভর করেছিল, তাই ভালোবাসা বিশ্বাস সুখের নীড় সব পদদলিত করে শয়তানের হাত ধরে নরকে এসে ঠাঁই হয়। মোটা টাকায় বিক্রি করে চলে যায়। আর আসেনি। প্রতিদিন নরক যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছি বলে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে। নিঃশব্দে ওখান থেকে বেরিয়ে আসি পেছনে কান্নার আর্তনাদ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়। না, অর্ণব কে এই নরকের সন্ধান দিই নি। তাহলে যে অনিদ্রায় প্রতিদিন তার কাটে কোন ডাক্তারের ওষুধে চিরনিদ্রায় চলে যাবে অবধারিত। যা আমি কখনও চাই না।মুম্বাইয়ের কাজ সেরে কোলকাতায় ফিরে কাজে ডুবে যাই।