।। ৫ ।।
যুধাজিতের সঙ্গে অনেক রাত পর্যন্ত হাসি-গল্প, মান-অভিমান হল। শেষ পর্যন্ত, স্বীকার করতে বাধ্য হলে যে, যুধাজিত, তোমার ভালোর জন্যই এই বিবাহের প্রস্তাবে তোমাকে রাজি করিয়েছিল। রাজা দশরথের তিন নম্বর রাণী হলেও, তুমি প্রেম, সম্মান, এবং ক্ষমতার অধিকারি হবে। অন্তত, যুধাজিতের দৃঢ় ধারনা তাই।
একদিন পরে, সবার কাছে বিদায় নিয়ে দশরথের সঙ্গে কেকয়া ছেড়ে অযোধ্যা রওনা হলে। জীবনে প্রথমবার বাবার চোখে স্নেহের প্রকাশ দেখতে পেলে, তোমার চোখের জলও আটকানো গেল না।
বেশ কয়েকদিনের যাত্রা পথ অতিক্রম করে অযোধ্যা নগরীতে প্রবেশ করলে। কী অপরূপ নগরী, চারিদিক দেখে দেখে, তোমার আশ মিটছেনা! নগরে প্রবেশের আগে কত অরণ্য, সুজলা সুফলা ধরনী, কত নদী, ঝর্ণা পথে পরল। নগরীতে ঢোকার মুখে বিশাল তোরণ, এমনটা কখনও দেখনি আগে। নগরের পথ গুলির দু'ধার ফুলের গাছ দিয়ে সাজানো। দূর থেকেই দেখতে পেলে শ্বেত পাথরের তৈরী বিশাল রাজপ্রাসাদ! তুলনায় তোমার দেশ কেকয়া কে কত মলিন মনে হল! অযোধ্যার ঐশ্বর্য অতুলনীয়, অন্তত কৈকেয়ী জীবনে প্রথমবার তা দেখল!
প্রাসাদে প্রবেশের পর রাজার প্রথম দুই রাণীরা এল তাকে বরণ করতে। বড় রাণীর নাম কৌশল্যা, সে এই দেশেরই উত্তর অঞ্চলের কন্যা। কী অপরূপ তার সৌন্দর্য, অভিজাত তার সাজসজ্জার বাহার! তার ব্যবহারের মধ্যে যেন কিঞ্চিত অবহেলা আর তাচ্ছিল্যের ভাব! সেই তুলনায় মেজ রাণী সুমিত্রা, সদা হাস্যময়ী, সহজ, সরল এক সুন্দরী!
দশরথ, তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এল প্রাসাদের এক নতুন অংশে, এক বিশাল কক্ষে প্রবেশ করল তোমার হাত ধরে, তুমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলে অপূর্ব গৃহসজ্জার দিকে! রাজা তোমাকে জিজ্ঞেস করল, "তোমার পছন্দ হয়েছে?" সেই বিশাল কক্ষই শেষ নয়, তার একপাশে একটি কারুকার্য মন্ডিত কাঠের দরজা খুললে, তোমার শয্যা কক্ষ দেখা যাচ্ছে! তুমি মুগ্ধতা আড়াল করলেনা, "রাজা, এ আমার আশাতীত, এত সুন্দর ঘর আমার, বিশ্বাসই হচ্ছেনা!" "তুমি খুশী হয়েছ, এ আমার সৌভাগ্য, রাণী! ঠিক আছে, এখন বিশ্রাম কর, মন্থরা তোমার সমস্ত জিনিস নিয়ে আসবে এখনই, কালকে তোমার সম্মানে প্রাসাদের, সঙ্গীত বিশারদ আর নৃত্য পটীয়সীরা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে, সেখানে তোমাকে উপস্থিত হতে হবে।" বলে, সে নিজের বিশ্রাম কক্ষে চলে গেল।
তুমি দেখলে, কক্ষে হাতির দাঁতের কারুকার্য করা, মেহগনি কাঠের তৈরী যে বিশাল পালঙ্ক, তাতে চারজন মানুষ অনায়াসে শুতে পারে। মখমলের মোলায়েম গদির ওপরে অনেক গুলি তাকিয়া বিছানো। পথের ক্লান্তি দূর করতে তুমি শয্যায় গা এলিয়ে দিলে।
রাজা বেরিয়ে গেলে মন্থরা এল ঘরে। তোমার ক্লান্তি দূর করতে তৎপর হয়ে উঠল।
পরদিন অনেক সকালে বাগানের পাখিদের কলকাকলিতে তোমার ঘুম ভাঙল! নতুন শয্যা, নতুন ঘর- বাড়ী, নতুন দেশ, তোমার ভেতর অনেক সংশয়, উৎকন্ঠা জাগিয়ে তুলল! পারবে কি তুমি নিজের আত্মমর্যাদা বজায় রেখে, নিজের দেশ কেকয়ার সম্মান রক্ষা করে, রাজার এবং তার পরিবারের বা প্রজাদের প্রিয় পাত্রী হতে? একটু নিজের জন্য সময় দরকার, কিন্ত রাজার আদেশে ইচ্ছা না থাকলেও তোমাকে আজ সান্ধ্য আসরে যোগ দিতে যেতে হবে। শুধু শরীরর সাজ নয় মনের ও প্রস্তুতি লাগে!
মন্থরারও সকাল থেকেই ব্যস্ততা, কেমন করে তোমার শরীর মন ভাল থাকবে, নতুন জায়গায়, তাই সে রন্ধনশালার কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে আসে, তোমার জামা কাপড়, পুঁথি গুলো ঘরের মধ্যে বিভিন্ন তোড়ঙে রাখতে থাকে। সন্ধ্যার অনুষ্ঠানের আগে থেকেই তোমাকে নানা ভাবে তৈরী করে, তোমার মায়ের একটা নীল রঙের কাঁচুলি আর ঘাগরা ছিল, মুক্তোমালার সাত লহরী হারের সঙ্গে, সেইটা বার করে রাখে পরার জন্য।
তুমি নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে, সান্ধ্য আসরে যাও, তোমার এখানকার দাসীদের সঙ্গে। কৌশল্যা আর সুমিত্রা তোমাকে একটু দূর থেকে দেখে! কৌশল্যা আর দশরথের অল্প বয়সেই বিবাহ হয়েছিল, সে হল পাটরাণী, কিন্ত তার একচ্ছত্র আধিপত্য, একের পর এক ক্ষুন্ন হয়, সুমিত্রা আর এখন তোমার আগমনে।
সান্ধ্য অনুষ্ঠানে অনেক কথকতা, নৃত্য-গীত পরিবেশন হল! কেকয়াতে এই ধরনের আসর দেখোনি আগে! এদের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল অনেক উন্নত!
পরদিন সন্ধ্যার সময় তোমার কাছে লোক মারফত খবর আসে যে রাজা তার বিশ্রাম কক্ষে তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তুমি জানতে এই সময়টা আসবে। তবু তোমার বুক কাঁপে, লজ্জা, দ্বিধা আর ভয় তোমাকে আঁকড়ে ধরে। সাহসী, তেজস্বিনী কৈকেয়ী আজ দুরু দুরু বুকে, মন্থরার সাথে রাজার মহলে যায়। মন্থরা তার সতেরো বছরের পালিতা রাজকন্যাকে, ভরসা আর আশ্বাস জুগিয়ে রাজার কাছে পৌঁছে দিয়ে ফিরে যায়।
দশরথ বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, তোমাকে আসতে দেখে, দাঁড়িয়ে উঠে, তোমার হাত ধরে এনে বসালেন শয্যা পাশে। তোমার ঘোমটা সরিয়ে চুম্বন এঁকে দিলেন তোমার কপালে। তুমি জীবনে প্রথম, পুরুষের স্পর্শে শিহরিত হলে! রাজার বৃষস্কন্ধে মাথা রাখলে, মনে হল, এমন আশ্রয়ের আকাঙ্খাই ছিল তোমার মনে মনে!
দশরথের সঙ্গে ধীরে ধীরে এক অসম বয়সী বন্ধুত্ব তৈরী হল। তুমি বলতে তোমার ছোটবেলার কথা, মা কে হারানোর ব্যথার কথা, প্রিয় যুধাজিত আর ছোট ভাইদের সঙ্গে তোমার বড় হওয়ার গল্প। রাজা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন।
তুমি বলতে, "রাজা, আমাকে আপনি কাজ দিন, আপনার পাশে থেকে আমি কাজ করতে চাই, এই রাজ্যের জন্য, এখানকার মানুষের জন্য! আমার শুধু অন্দরমহলে, পর্দানশীন ভাবে কাটাতে ভাল লাগেনা। "যুধাজিতের কাছে তোমার অস্ত্র শিক্ষার গল্প শুনে রাজার বিস্ময়ের অবধি ছিল না! তিনি তোমাকে ভালবেসে বলতেন, "সময় এবং সুযোগ হলে, তোমাকে আমি আমার রাজসভায় ডেকে নেব, কিন্ত যুদ্ধ ক্ষেত্র রমনীর জন্য নয় বলেই আমার বিশ্বাস।"
বছর খানেক এমন করেই কেটে গেল। রাজার বিশেষ অনুরোধে তুমি, কৌশল্যা আর সুমিত্রার সঙ্গে তোমার স্বভাব বিরুদ্ধ ভাবে নিজে যেচে গিয়ে সখ্যতা স্থাপন করেছ, এখন তোমরা তিনজনে মাঝে মাঝে একে অন্যের মহলে গিয়ে সময় কাটাও। তোমার আর কৌশল্যার মধ্যের বরফ গলে গেছে অনেকটাই।
(ক্রমশ)
গ্রন্থের নামঃ কৈকেয়ী (Kaikeyi: A Novel)
লেখিকাঃ বৈষ্ণবী প্যাটেল (Vaishnavi Patel)
ভাষাঃ ইংরাজী
প্রকাশকঃ রেডহুক (Redhook)
বাঁধাইঃ পেপারব্যাক
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৫১২ পাতা
মুদ্রিত মূল্য (ভারতীয় মুদ্রায়): ১,৭৩৪ টাকা