বিবিধ

খাল-বিলের আখ্যান (দশম পর্ব) [ধারাবাহিক]



মমতা বিশ্বাস


ছুটি নেই। তাই ভোরের পাঁচটা সাতের ট্রেন ধরে কুন্তী। সাড়ে আটটার মধ্যে দমদমের ফ্লাটে পৌঁছে যাবে; তাহলে স্নান-খাওয়া করে সাড়ে দশটায় স্কুলে পৌঁছে যেতে পারবে। টোটো থেকে নেমে মাজদিয়া স্টেশনের ১ নং প্লাটফর্মের সামনের দিকে এগিয়ে গেল। জনা পাঁচেক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেন এসে থামল। মহিলা কামরা একেবারে ফাঁকা।। হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়ল যাত্রীরা। কুন্তী গতকাল পাগলাতলায় যে জটা বুড়িকে দশটা টাকা দিয়েছিল; সে বাঁ দিকের সিটে চাদর মুড়ি দিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল। সুন্দরী বৈষ্ণবী সিটে হেলান দিয়ে কোলের উপর ব্যাগ রেখে পা দুটো মেলে দিল। পাগলাখালিতে ওই বৈষ্ণবী কপালে রসকলি এঁকে ভিক্ষে করছিল। কপালে রসকলি। গায়ে সাদা উলিকটন। পরণে সাদা ধবধবে থান। গায়ের চাদরটাও সাদা। গৌর বর্ণের বৈষ্ণবীকে মানিয়েছে বেশ। গুনগুন করে হরিনাম গাইছে। কুয়াশা মোড়া সকাল। কামরার ভিতর থেকে মাঝে-মধ্যে কুন্তীর চোখ জানালায় আটকে। বহিরগাছি স্টেশনে এক ঝাঁক মহিলাযাত্রী উঠল। শিবাদাসী পা দুটো গুটিয়ে মাসি, দিদি বলে বসার জায়গা ছেড়ে দিল। ঝোলা থেকে মুড়ির প্যাকেট বের করে মুঠো মুঠো তুলে চিবোচ্ছে। কুন্তী সিটে বাবু হয়ে বসে বৈষ্ণবীকে খুঁটিয়ে দেখছিল। গতকাল এইভাবে দেখার অবকাশ মেলেনি কিনা! কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে বৈষ্ণবী নিত্য যাত্রীদের পরিচিত। সপ্তাহে দুই দিনের সহযাত্রী কিনা!

মাছ, সবজি নিয়ে উঠেছে বেশ কয়েকজন। বৈষ্ণবী গলা সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, "ও, মাসি তোমরা মাছ নিয়ে এই কামরায় উঠলে ক্যান? ভেণ্ডারে উঠতে পারতে।”

“ভেণ্ডারে উঠলে অনেক ঝামেলা। টি টি, রেল পুলিশ হাড়ির মাছ অর্ধেক নিয়ে নেয়। বহিরগাছির খাল-বিলের দেশি ছোটোমাছ! লোভ সামলাতে পারে না। মাছ বেচে সংসার চালাই। বুড়ো কষ্ট করে মাছ ধরে। আমি ভোরের টেন ধরে বিক্রি করতে যাই। বিলই বাঁচিয়ে রেখেচে গো আমাদের। রানাঘাটে নেমে পড়ব। গেটের একপাশে বসে থাকছি।”

“ভালো করে ঢাকা দিয়ে রাখো। গন্ধে গা গোলায়। আমাকে তোমাদের বিলের হেলঞ্চ শাক এনে দিও দিকিনি।”

মেছোনি ঘাড় নেড়ে সাঁই দিল।

দেশি মাছের কথা শুনে কুন্তী অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, "তোমাদের বিলে বারোমাস জল থাকে?” আমন ধান হয়? লাল মোটা চালের ধান?”

“হ্যাঁ-থাকে। আমন ধান হয়। বিল থেকে খাল কেটে ইছামতীর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া। জোয়ারের জল ঢোকে মাঝে-মধ্যে। বর্ষায় বিল সাপলাফুলে আলো হয়ে থাকে। ফাল্গুন-চোতে কই, মাগুর, জিয়োল, শোল কুইন্টাল কুইন্টাল ধরা পড়ে। চুনো মাছ ঝুড়ি ঝুড়ি”।

দেশি চুনো মাছের কথায় কুন্তী নড়েচড়ে বসল। তাহলে; এখনও দুই একটা বিল আছে যেখানে দেশি মাছ প্রচুর পাওয়া যায়। দু’দিন ধরে মুমূর্ষু খাল-বিল দেখে ও শুনে মন খারাপের গুমোট হাওয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছিল কুন্তী। মেছোনির কথা শুনে গুমোট ভাবটা কেটে গেল। সে শুনেছে বেশিরভাগ খাল-বিল বড়োলোক বাহুবলীদের দখলদারিতে চলে গেছে। গতকাল পলদা পার হওয়ার সময় নৌকার মাঝি দেশি মাছের গল্প করার সময় বলেছিল যে, “পলদা তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষ দেশি মাছের স্বাদ ভুলেই গিয়েছে প্রায়।

আসলে পলদায় দেশি মাছ নেই বললেই চলে। একসময় পলদার সুস্বাদু ছোটোবড়ো দেশিমাছ দূরের শহরে বিক্রি হত। মাঝির বাবাই কত গেছে মাছ বিক্রি করতে। "সেই পলদা কী আর আছে দিদিমণি? মহিষপুরের পালেরা পলদার বুকের পলি দিয়ে ঠাকুর গড়ত। সেই ঠাকুর নৌকা বোঝাই হয়ে কলকাতায় যেত। ২০০০ সালের বন্যার পর থেকে ‘পলদা’ - ঠাকুর গড়ার মাটি দিতে পারে না। পাক দিয়ে তো আর ঠাকুর গড়া যায় না। ভেড়ির মালিকরা মাইনে দিয়ে লোক রেখেছে; তারাই দেখাশোনা করে। যে সব খাবার খাইয়ে মাছ বড়ো করে, দেখলে মাছ খাওয়া ছেড়ে দেবেন দিদি। মাছ ধরে যারা; তাদের পাঁচড়া হয়ে যায়। সাধ হলেও ছান করা যায় না। কত লাফাঝাপা করেছি এই জলে।"

কথা শেষ না হতেই নৌকা সান বাঁধানো ঘাটে নামিয়ে দিয়েছিল। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এসেছিল কুন্তীরা। বাঁ দিকের স্টেজে লোকগান গাইছে তরুণী গায়িকা। হরিনাম সংকীর্তনের দল মন্দির পরিক্রমা করছে। ফুলটুসি ভিড়ের মধ্যে একটু জায়গা করে নিল। ব্যাগ থেকে ফুল-বেলপাতা, বাতাসা ও ফল পাগলাবাবাকে নিবেদন করে পাঁচ কিলো দুধের জারের ঢাকনা খুলে ঠাকুরকে স্নান করিয়ে দিল। ধুপকাঠি গুজে দিয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালো। কুন্তী অপুর হাত ধরে পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল। প্রতিদিন এত দুধ ও ধূপ-ধুনোর অত্যাচারে বটগাছের আয়ু কতদিন? হিসাব করছিল। হাতে টান পড়তে তাকিয়ে দেখে মলিদি। কতবছর আগে দেখেছে। চেহারার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বর্ডার লাগোয়া মলুয়াপাড়ায় বিয়ে হয়েছিল মলিদির; কিন্তু কুন্তির সঙ্গে এইভাবে দেখা হবে এখানে এসে ভাবতেই পারেনি।

“মলিদি? কেমন আছো?”

“ভালো আছি।”

“তুই এখানে? পাশেই আমাদের গ্রাম। থাকি শিমুলিয়া বাজারে। খুব জাগ্রত জায়গা। পাগলাবাবা সবার মনস্কামনা পূরণ করেন। বেলাও শেষ, এখানকার মেলাও শেষ। কেউ রাত্রে থাকতে পারে না বাৎসরিক অনুষ্ঠানের তিনদিন ছাড়া।”

“কেন থাকতে পারে না?”

“পলদার জলের মধ্যের থেকে অদ্ভুত কী উঠে আসে। প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়ে যায়।”

“ওসব আজগুবি কথা। মানুষকে ভয় দেখানোর ফিকির। অন্য কোনো ব্যাপার আছে। বর্ডার এলাকা না।”

“ঠাকুর-দেবতায় বিশ্বাস নেই দেখছি। বাবার থানে দাঁড়িয়ে ওসব কথা বলতে নেই। চল প্রসাদ নিবি। পাঁচ’শ লোক খাওয়াব। রান্না হচ্ছে ওই দিকে।”

“ঠিক আছে যাও। আসছি। ঘুরে দেখে নিই। খালের মতো দেখা যাচ্ছে; চল, অপু দেখে আসি কী আছে ওদিকটায়।”

ফুলটুসি বলে, "দেখবে চল মানতের কত জিনিস। শ্বেত পাথরের সব। গাড়ি করে কলকাতা থেকেও লোক আসে। শহরের বাবু মানুষরা বেশি দেয়।

কুন্তী তাজ্জব বনে গেল মানতের দেওয়া অসংখ্য দামি মূর্তি, মঞ্চ দেখে। খালের পাড় দিয়ে মাঠের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বড়োলোক ভক্তদের কাণ্ডকারখানা। জ্যৈষ্ঠ মাসের সোমবার ও বৃহস্পতিবার ২০/৩০টি বাস ও গাড়ি বোঝাই হয়ে মানুষ আসে। যাত্রী নিবাস, পানীয় জলের কল, পায়খানা-বাথরুম প্রতিবছর বেড়ে যাচ্ছে। দিনদিন পলদা সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে পাগলা বাবার মাহাত্ম্যে! নাম সংকীর্তনের বড়ো একটি দল পাগলা বাবার থান পরিক্রমা করছে। খোল করতাল, ঘণ্টাধ্বনি, উলুধ্বনিতে গমগম করছে। কানে সহ্য হচ্ছে না। কুন্তীরা বাইরে বেরিয়ে এলো। আখের রস বিক্রি হচ্ছে। সকলে এক গ্লাস করে খেয়ে নিল। ওদের পাশ দিয়ে পলদায় স্নান করে দণ্ডি কেটে এগিয়ে আসছে দুইজন মহিলা। ছবি তুলছেন একজন। ফটোগ্রাফারকে খুব চেনা মনে হল। কাছে এগিয়ে গিয়ে কুন্তী জিজ্ঞেস করল,

“সম্পদদা না?”

“হ্যাঁ আমি সম্পদ। কিন্তু আপনি?”

“আমি কুন্তী। নীতার বান্ধবী।”

“ও এবার চিনেছি। অনেক বছর পর দেখা তো, তাই চিনতে পারিনি। দণ্ডি কাটার ছবিটা তুললাম। ভক্তির নামে এক ধরনের আত্মপীড়ন।”

“সত্যি তাই। আজকের দিনে এমন কুসংস্কারের বশবর্তী হয় মানুষ? ভালো আছেন তো? তোমার ফোন নাম্বারটা দাও। আমাদের ফেরার তাড়া আছে। এখান থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে এক আত্মীয় বাড়িতে এসেছি। একদম বর্ডার। দেরি করতে পারছি না। প্রয়োজনে পরে যোগাযোগ করে নেব।”

“লিখে নাও। ৯৪৬৪৮৭৩২৪৩। আমিও অফিস থেকে এসেছি। কৃষ্ণগঞ্জে অফিস।”

“আসি তাহলে।”

“এসো”।

বাঁদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখে মলি খাবার দেওয়ার তদারক করছে। কুন্তীকে দেখে এগিয়ে এল।

“পৌষ পার্বণের দিন এখানে লোক খাওয়ানো শ্বশুরের ইচ্ছেতেই শুরু হয়েছিল। উনি উঠে যাবার পর থেকে চালিয়ে যাচ্ছি। এই পলদায় ট্রলার চলত। যুগীন্দা ঘাট থেকে উঠতাম; নামতাম শিমুলিয়ায়। দেড় মাইল বর্ষায় কাদা; অন্যসময় ধুলো রাস্তা পেরিয়ে সেই পুটির বিলের ধারে মলুয়াপাড়ার বাড়ি যেতে হত। কী কষ্ট করে যে ছেলেমেয়ে মানুষ করলাম বলার নয়। ছেলেমেয়েরা শ্যামনগরে থাকে। ছেলে, দুই জামাই চাকরি করে। সবার ছেলেমেয়ে হয়ে গেছে। ব্যবসা ছেড়ে তোর জামাইবাবু কোথাও যায় না। আমি দুই দিকেই সামাল দিই।

রান্নাঘরে ডাক পড়ায় মলি চলে গেল। একটু পরে পাতায় খিচুড়ি প্রসাদ এনে দিল কুন্তীকে। সন্ধ্যের আগেই ফিরতে হবে। বাঁশের ব্রিজ দিয়ে পার হবে; তাই নদী পাড় ধরে হাঁটতে লাগল ওরা। ফুলটুসি আঁশ শেওড়ার পাঁকা ফল তুলে মুখে পুরে দিল। অপুকে ও একটা দিল। কুন্তীর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “।

খাবে নাকি একটা? আসটেলি ফল। মধুর মতো মিষ্টি।”

এই বুনো ফল খেতে কুন্তীর সাহস হল না। তিনটে ফল হাতের তালুতে নিয়ে ছবি তুলে নিল। কী মিষ্টি রং! মরে আসছে রোদ। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসের দাপট বাড়ছে। দীর্ঘমেয়াদি শীত এবার। কুয়াশা জড়িয়ে ধরছে ধীরে ধীরে। কান মাথা ঢাকা থাকলেও একটা সুন্দর গন্ধ বাতাসে ভাসছে। কিছুটা সোঁদা গন্ধের মতো। ফুলটুসি জানিয়েছিল এ-গন্ধ সরা পিঠের। নতুন মাটির ছাচে পিঠে হচ্ছে, তাই সোঁদা গন্ধ মিশ্রিত। অন্য পিঠে না হলেও সরা পিঠে গ্রামের সবার বাড়িতে হচ্ছে। আজ যে পৌষ পার্বণ!

(ক্রমশ)