বিবিধ

শত শতাব্দীর জাদুবিদ্যা (সপ্তম পর্ব)



জাদুকর শ্যামল কুমার


ইউরোপে জাদুবিদ্যা (১৮০০-১৮৭৫)


ব্রিটিশ জাদুকর ম্যাজিক দেখাচ্ছেন (১৮০০)।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে একজন বিশেষ প্রসিদ্ধ জাদুকর ছিলেন লুই ক্রিস্টিয়ান ইমানুয়েল অ্যাপোলিনেয়ার কমতে (Louis Christian Emmanuel Apollinaire Comte - 1788-1859)। তিনি তাসের জাদুতে পারদর্শী ছিলেন এবং ফুলের ম্যাজিকের কৌশলের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। কমতে তাঁর জাদুবিদ্যার প্রতিভার সঙ্গে যোগ করতে পেরেছিলেন তাঁর অস্বাভাবিক স্বরক্ষেপন ক্ষমতা। যখন কোনো প্রাদেশিক শহরে তিনি উপস্থিত হতেন সেখানে তিনি তাঁর দূর থেকে আসা সুরে কথা বলার প্রতিভা বা স্বরক্ষেপন ক্ষমতা, যাকে ম্যাজিকের ভাষায় বলা হয় ভেন্ট্রিলোকুইজম (Ventriloquism) কাজে লাগাতেন। এমন কি রাস্তায় যেতে যেতেও। এছাড়া সকলপ্রকার ব্যবহারিক তামাশা করবার সময়ও। কোনো কিম্ভুত কিমাকার জাদু প্রদর্শন করার পর তিনি নিজেকে পরিচিত করতেন 'কমতে জাদুকর' (Comte The Magician) বলে। এটা তাঁর কাজের আত্ম-বিজ্ঞাপনের একটি চমৎকার উপায় ছিল।

এইসময় প্যারিস (Paris)-এ বার্তোলোমিও বস্কো (Bartolomeo Bosco) নামে একজন বিখ্যাত ইতালীয় জাদুকর ছিলেন, ইনি কমতে (Comte)-র চেয়ে বয়সে ছোট ছিলেন। তিনি ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দে তুরিন (Turin) এ জন্মগ্রহণ করেন এবং সৈনিক হিসাবে রোমাঞ্চকর জীবন যাপন করেন নেপোলিয়ানের সৈন্যদলে।

বস্কো (Bosco) বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ ছিলেন তাঁর কাপ ও বলের খেলার নৈপূণ্যের জন্য। বস্কোর কৌশলের বর্ণনা করেন জিন ইউজিন রবার্ট হুডিন (Jean Eugene Robert Houdin) নামে একজন যুবক ঘড়ি প্রস্তুতকারক, যার ভাগ্যে ছিল পরবর্তীকালে ফ্রান্সের এক বিখ্যাত নামকরা জাদুকরে পরিণত হওয়া। রবার্ট হুডিন (Robert Houdin) প্যারিসে বস্কোর প্রদর্শনী দেখেন ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে।


প্যারিসে জাদুকর বস্কো (Bosco) পাখি নিয়ে ম্যাজিক দেখাচ্ছেন (১৭৯০)।

তাঁর কাপ ও বলের প্রদর্শনের পর বস্কো ঘোষনা করেন তিনি পায়রা কৌশল প্রদর্শণ করবেন। তিনি একটি কালো রঙের পায়রা আনলেন এবং 'মন্দ ব্যবহারের জন্য তাকে শাস্তি দিতে' একটি কাঠের খণ্ডের উপর রেখে তার মাথাটি কেটে ফেললেন। এই কাজটি করা হতো দর্শকদের চাহিদা অনুসারে 'রক্তাক্তভাবে বা রক্তপাতহীন' অবস্থায়। ইনি রক্তপাত বন্ধ করতেন পায়রার গলার একটি বিশেষ ধমনীকে টিপে রেখে এবং রক্তপাত ঘটাতেন ঐ ধমনীতে চাপ আলগা করে। এরপর একটা সাদা পায়রার একইভাবে মুন্ডচ্ছেদ করা হতো এবং মুন্ডটি একটি তলাবিহীন বাস্কে ফেলা হতো, যেখানে আগে থেকেই একটি কালো পায়রা লুকিয়ে রাখা থাকত। ঐরূপ অপর একটি বাক্সে একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হতো। জাদুকর বস্কো এরপর একটি বাক্স থেকে কালো মুন্ডযুক্ত সাদা পায়রা এবং ওপর বাস্ক থেকে সাদা মুন্ডযুক্ত কালো পায়রা বার করতেন। দর্শকবৃন্দ এই ভেবে বিস্মিত হতো যে আগের দুইটি মৃত পায়রা জীবন ফিরে পেয়েছে। আর তাই আনন্দে সবাই হাততালি দিয়ে উঠতেন।

এরপর বস্কো একটি ক্যানারি (Canary) পাখির পা যন্ত্রণাদায়কভাবে চেপে ধরে দর্শকদের দিকে মুখ করে সেটির মাথা হেঁট করাতেন, যেন পাখিটি দর্শকবৃন্দদের অভিবাদন জানাচ্ছে, এরূপ ভান করতেন। তারপর দর্শকবৃন্দদের মধ্য থেকে কোনো ভদ্রমহিলাকে পাখিটি দেবেন এরূপ ভান করে এগিয়ে যেতেন। কিন্তু ভদ্রমহিলার বসবার জায়গায় পৌঁছবার আগেই পাখিটির শ্বাস রুদ্ধ করে দিতেন। একটি মিলনান্তিক আবহাওয়া সৃষ্টির জন্য বস্কো ভান করতেন যেন ভদ্রমহিলাটি পাখিটিকে মেরে ফেলেছেন। বস্কো তখন দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলতেন, এই ক্যানারি পাখিটি তাঁর স্ত্রীর অতি প্রিয় ছিল। এহেন পরিস্থিতিতে বাড়ি ফিরে তিনি তাঁর স্ত্রী কর্তৃক প্রহৃত হবেন।

অবশেষে পরিস্থিতির চূড়ান্ত পর্যায়ে বস্কো একটি বাক্সে মৃত ক্যানারি পাখিটি রেখে পরিবর্তে একটি জীবন্ত ক্যানারি পাখি ম্যাজিকের কারসাজিতে বের করে আনতেন। এই জীবন্ত পাখিটিকে এরপর তিনি বিশেষভাবে নির্মিত একটি বড় পিস্তলের পাইপের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতেন। এরপর পিস্তলটি একজন দর্শকদের হাতে দিয়ে টিপ করে ছুঁড়তে বলতেন। পিস্তল ছোঁড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বস্কো সহাস্যে একটি তরবারি দিয়ে পাখিটিকে বিদ্ধ করতেন, যা নিচের ছবিতে দেখানো হয়েছে।

রবার্ট হুডিন (Robert Houdin) লক্ষ্য করলেন যে দর্শকরা এতটাই মন্ত্রমুগ্ধ বস্কোর এই আশ্চর্য কীর্তির বশে যে তারা সরলভাবে বিশ্বাস করল যে তামাম পায়রা ও ক্যানারি পাখিকে জাদুর দ্বারা পুনরুজ্জীবিত করা যায়। তারা বুঝল না যে বাস্তবে বস্কো প্রতি প্রদর্শনীতে পাখির পর পাখি মেরে ফেলতেন। কিন্তু রবার্ট হুডিন দেখেছিলেন যে সত্যি করে কি ঘটেছিল। তিনি বস্কোর এই কৌশলকে "পক্ষী-হত্যা" নাম দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে আপাত অখ্যাত এই রবার্ট হুডিন-এর হাত ধরেই ইউরোপে জাদুবিদ্যা জনপ্রিয়তার চরম শিখরে পৌছয়।

এই জাদুকর বার্তোলোমিও বস্কো (Bartolomeo Bosco)-কে জাদুকর লিওন বস্কো (Leon Bosco)-র সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না, কারণ লিওন বস্কো ছিলেন তৎকালীন জাদুকর লি রয় (Le Roy), টেলমা (Talma) আর বস্কো (Bosco) - এই ত্রয়ীর মধ্যে সবচেয়ে মজার ইন্দ্রজালিক।

(ক্রমশ)