যজ্ঞের পবিত্র অগ্নি থেকে জন্ম নিচ্ছেন দ্রৌপদী। (পৌরাণিক ছবি)
বলা হয় মহাভারত এমনই এক রচনা যার তুলনা পাওয়া যায় না। প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি চরিত্র, ঘটনার পরম্পরা ও তার সুদূরপ্রসারী ফলাফল এক অনাস্বাদিত মুহূর্তের সৃষ্টি করে। অসংখ্য চরিত্র ও ঘটনারাজির মধ্যে তীব্র ভাবে ঝলসে ওঠে এখানে এক নারী চরিত্র - দ্রৌপদী। মহাভারতের সৃষ্টিকার ব্যাসদেব দ্রৌপদীকে কাহিনীর মধ্যপর্বে নিয়ে এসেছেন - যখন হস্তিনাপুরের রাজনীতি জমজমাট। সিংহাসনে ধৃতরাষ্ট্র। রাজসভা অলংকৃত করে রয়েছেন ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, কৃপাচার্যরা। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত দুর্যোধন। তাঁকে কেন্দ্র করে রয়েছেন শকুনি এবং কর্ণ। কৌরব পাণ্ডবদের ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব প্রকট এবং পাণ্ডবরা রাজ্যছাড়া। অনুমান করা হয় বারণাবতের অগ্নিকাণ্ডে কুন্তীসহ পাণ্ডবরা মৃত। ভারতবর্ষের রাজনীতিতে কৃষ্ণের প্রবেশ তখনও ঘটেনি। এমতাবস্থায় এই নিস্তরঙ্গ রাজনীতির মঞ্চে পুনরায় আলোড়ন সৃষ্টি করলেন ব্যাসদেব এবং আবার এক নারীকে কেন্দ্র করে। এই সেই নারী দ্রৌপদী, যিনি হস্তিনাপুরের রাজনীতিতে এক জটিল আবর্তের সৃষ্টি করেন। যার ফলস্বরূপ কুরুপাণ্ডবের সংগ্রাম শুরু হয়। কৌরবদের বিনাশ হয়। ভারতবর্ষ ক্ষত্রিয়শূণ্য হয়ে পড়ে এবং পাণ্ডবরা রাজ্য লাভ করে।
দ্রৌপদীর জন্মরহস্য কিছুটা গোলমেলে। তিনি পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কন্যা। তাই তাঁকে দ্রৌপদী বা পাঞ্চালী বলা হয়। কিন্তু তাঁর আবির্ভাব যজ্ঞের আগুনের মধ্য থেকে। তিনি অগ্নিকন্যা। তিনি কৃষ্ণাঙ্গী কিন্তু অপরূপ সুন্দরী। তিনি বিদুষী, আত্মাভিমানী। সর্বগুণান্বিতা। রাজঅন্তঃপুরে তিনি সর্ববিষয়ে পারদর্শিতা লাভ করেন। তাঁর অলোকসামান্য রূপ ও গুণের কাহিনী চন্দনসৌরভের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র ভারতবর্ষে। দ্রৌপদী বিবাহযোগ্যা হলে দ্রুপদরাজ তাঁর বিবাহের জন্য স্বয়ংবর সভার আয়োজন করেন। সমগ্র ভারতবর্ষের রাজন্যসমাজে আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হলো। দ্রৌপদী তাঁর স্বামী নিজেই নির্বাচন করবেন।
দ্রৌপদী জানালেন তিনি বীর্যশুল্কা হবেন - বীরের গলায় বরমাল্য দেবেন তিনি। তাঁর শর্ত একটি। নীচে জলের দিকে তাকিয়ে ওপরে ঘূর্ণায়মান মৎস্যের চোখে যিনি তীর বেঁধাতে পারবেন তাঁকেই তিনি স্বামীরূপে মনোনীত করবেন। দেশবিদেশের রাজারা এলেন। অসংখ্য ব্রাহ্মণ এবং সাধারণ দর্শক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও এলেন এই ঘটনার স্বাক্ষী হতে। এই আসরে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা বলরামকে নিয়ে এলেন। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার রাজ্যহারা পাণ্ডুপুত্ররা যাঁরা ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, তাঁরাও এলেন ঘটনা দেখার জন্য। সেই সময়ে তাঁরা ছদ্মবেশে পাঞ্চালরাজ্যের প্রান্তে ছিলেন।
দ্রৌপদীকে লাভ করার জন্য রথীমহারথীরা ধনুতে জ্যা যোজনা করে পঞ্চবাণ দিয়ে লক্ষ্য বিদ্ধ করার জন্য এগিয়ে এলেন। কিন্তু প্রত্যেকেই ব্যর্থ হলেন। তখন মহাবীর কর্ণ এগিয়ে এসে অক্লেশে ধনুতে জ্যা যোজনা করলেন। এই সময়ে কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে ইঙ্গিত করেন কর্ণকে যেন দ্রৌপদী কখনই বিবাহ না করেন। কৃষ্ণের ইঙ্গিতে দ্রৌপদী বলেন তিনি সূতপুত্রকে কখনই বরমাল্য দেবেন না। কর্ণ নিশ্চুপে এই অপমান সহ্য করে স্বয়ংবর সভা পরিত্যাগ করেন। কৃষ্ণকে দ্রৌপদী আগে চিনতেন কি না তার কোনো ইঙ্গিত ব্যাসদেব ইতপূর্বে দেননি। কিন্তু মহাভারতের মতো জটিল সৃষ্টিতে যিনি ব্যাপৃত তাঁকে প্রতি মুহূর্তেই নতুন কিছু আগাম সংঘাতের বীজ বপন করতে হয়, যাতে কাহিনীর গতিপথ নিষ্প্রভ হয়ে না পড়ে। অতএব মহাভারতের রাজনীতিতে এক নতুন চরিত্রের অবতারণা হল। তিনি কৃষ্ণ। মিষ্টভাষী এবং ধুরন্ধর কূটনীতিবিদ। ধর্মঅধর্মের সূক্ষ্ম বেড়াজালকে অনায়াসে নিজের ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তিনি।
পরবর্তী ঘটনা আরও চমকপ্রদ। সমগ্র ক্ষত্রিয়কূল অকৃতকার্য হলে অর্জুন অগ্রসর হন এবং সমগ্র রাজন্যবর্গের সম্মুখে লক্ষ্যভেদ করেন। দরিদ্র ব্রাহ্মণকে বরমাল্য দিতে দ্রৌপদী ইতস্তত করেন না। ধুরন্ধর কৃষ্ণ অনুমান করেন পঞ্চ পাণ্ডবরা জীবিত এবং এই ব্রাহ্মণ নিশ্চয়ই অর্জুন। দ্রৌপদীকে নিয়ে পঞ্চপাণ্ডব যখন কুন্তীর কাছে যাওয়ার জন্য উদ্যত হন, তখন কৃষ্ণ গোপনে তাঁদের অনুসরণ করেন। কুন্তী দ্রৌপদীকে না দেখেই পঞ্চপুত্রকে নির্দেশ দেন তারা যেন তাদের আহৃত সামগ্রী নিজেদের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে ভোগ করেন। এরপর দ্রৌপদীকে দেখে কুন্তী বিব্রত হয়ে পড়েন।
দ্রৌপদীর জীবনে বিপুল পরিবর্তন এরপর থেকে শুরু হয়। তিনি পাঞ্চালী। দ্রুপদকন্যা। বীর্যশুল্কা তিনি। অথচ মাতৃআজ্ঞায় তিনি আজ নিছকই পণ্যসামগ্রীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। পুরুষ বহুবল্লভ হতে পারে। কিন্তু এক নারীর পঞ্চ স্বামী রীতিমতো অমর্যাদাকর ভারতবর্ষে। তিনি যাঁকে বরমাল্য দিয়েছেন তিনি তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন। এতো রীতিমতো শ্লাঘার বিষয়। কিন্তু বর্তমানে তাঁকে যুধিষ্ঠির ও ভীমের পত্নীরূপে এক বছর করে থাকতে হবে। এরপর অর্জুন, নকুল ও সহদেবের স্ত্রী হিসাবে তাঁর পরিচয় হবে। ব্যাসদেব নিজহাতে একজন রমণীকে এইভাবে তার নিজস্ব সম্মান থেকে বঞ্চিত করে তাকে পণ্যসামগ্রী হিসাবে তুলে ধরলেন। রাবণ সীতাকে ছলনা করে অপহরণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি সীতাকে অসম্মান করেন নি। ব্যাসদেব নারীজাতির অবস্থানকে কলঙ্কিত করে তুললেন। অথচ এই আরোপিত কলঙ্কে দ্রৌপদীর কোনও দায়িত্ব ছিল না।
এরপর ব্যাসদেব বা শ্রীকৃষ্ণ কোনও না কোনও একজনের অঙ্গুলিহেলনে বারবার অর্জুনকে দ্রৌপদীর সান্নিধ্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। যুধিষ্ঠির যখন দ্রৌপদীর সাথে সম্পর্কে ব্যস্ত, সেই সময়ে ব্রাহ্মণের অপহৃত গোধন উদ্ধারের জন্য অর্জুন বাধ্য হয়ে যুধিষ্ঠিরের গৃহে যান। শর্ত অনুযায়ী অর্জুন দ্বাদশ বৎসরের জন্য বনবাসী হন। দ্রৌপদী অর্জুনের জন্য ব্যাকুল ছিলেন। কিন্তু অর্জুন রাজ্য ত্যাগ করেন। অর্জুন এই দ্বাদশ বৎসরে বহু বিবাহ করেছেন। একাধিক পুত্রের জনক হয়েছেন। স্বর্গে গিয়ে নৃত্যগীত শিক্ষা করেছেন। সম্ভোগে নিমজ্জিত থেকেছেন। সর্বোপরি শ্রীকৃষ্ণের ভগিনী সুভদ্রাকে বিবাহ করে দ্বাদশ বৎসর অন্তে ইন্দ্রপ্রস্থে উপস্থিত হয়েছেন। অর্থাৎ একদা যাঁকে স্বয়ংবর সভায় বীরত্বের যোগ্য পরিচয় দিয়ে যাঁর বরমাল্য জয় করেছিলেন, তাঁর সম্পর্কে অর্জুন ঘটনা পরম্পরায় নিরাসক্ত থাকতে বাধ্য হয়েছেন।
দ্রৌপদী এই দ্বাদশ বৎসরে উপলব্ধি করেছেন পঞ্চপাণ্ডব বীরত্বের জয়গাথায়, মাতৃআজ্ঞা পালনে এবং ভ্রাতৃপ্রেমে যতই উদাহরণস্বরূপ হয়ে থাকুন, বস্তুত তারা ক্লীবমাত্র। যুধিষ্ঠির জুয়াড়ি এবং সুবিধাবাদী, ভীম ভোজনরসিক ও গোঁয়ার, অর্জুন রমণীপ্রিয়, নকুল ও সহদেব ব্যক্তিত্বহীন। এঁদের পত্নী হয়ে তিনি লাভ করেন উপহাস, তাঁর চরিত্রের প্রতি কটাক্ষ এবং নানা উপায়ে অসম্মান। তাই তিনি আত্মসম্মান বজায় রাখতে হয়ে ওঠেন অহংকারী। এমনকি পঞ্চস্বামীর প্রতিও আস্থাহীন। যথার্থই তিনি "নাথবতী অনাথবৎ"।
দ্রৌপদী পঞ্চপাণ্ডবের পঞ্চপুত্রের জননী হন। পাঁচ পুত্রের নাম হল - প্রতিবিন্ধ্য, সুতসোম, শ্রুতকর্মা, শতানীক ও শ্রুতসেন। এদিকে ইন্দ্রপ্রস্থে পাণ্ডবদের নতুন রাজধানী এবং তার আড়ম্বর ও ঐশ্বর্য দুর্যোধনকে ঈর্ষান্বিত করে তোলে। তিনি পাণ্ডবদের হস্তিনাপুর থেকে বিতাড়িত করে ভেবেছিলেন তাঁর আর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলো না। কিন্তু ময়দানবের তৎপরতায় ধূ ধূ ইন্দ্রপ্রস্থ হয়ে উঠলো সুরম্য নগরী। রাজসূয় যজ্ঞে ভারতবর্ষের প্রায় সকল নরপতি পাণ্ডবদের বশ্যতা স্বীকার করে নিলেন। দুর্যোধন পাণ্ডবদের এই আড়ম্বর ও সম্মানে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। পাণ্ডবদের পুনরায় রাজ্যহীন ও নিঃস্ব করার উদ্দেশ্যে শকুনির পরামর্শে যুধিষ্ঠিরকে দ্যূতক্রীড়া অর্থাৎ পাশাখেলায় আমন্ত্রণ জানান।
মহাভারতের কাহিনীকার পাণ্ডবদের জীবনে আরও একটি বিপর্যয়ের অধ্যায় তৈরি করলেন। যুধিষ্ঠির ধর্মপুত্র। কিন্তু পাশাখেলায় আসক্ত। জুয়ার প্রতি তাঁর তীব্র আকর্ষণ। ভ্রাতাদের এবং দ্রৌপদীর আপত্তি সত্ত্বেও তিনি কুন্তী, ভ্রাতাদের ও দ্রৌপদীকে নিয়ে হস্তিনাপুরে পাশা খেলতে আসেন। শকুনির চাতুর্যের কাছে তিনি ক্রমশই পরাস্ত হতে থাকেন। অবশেষে তিনি নিঃস্ব হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের ভাইদের এবং দ্রৌপদীকে পণ রেখেও হেরে যান। দুর্যোধনের নির্দেশে দুঃশাসন দ্রৌপদীর কেশ আকর্ষণ করে অন্তঃপুর থেকে রাজসভায় নিয়ে আসেন এবং কর্ণের পরামর্শে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করতে উদ্যত হন। দুর্যোধন তাঁর বাম উরু দেখিয়ে দ্রৌপদীকে অপমান করেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, কৃপাচার্য এবং ভারতবিখ্যাত বীর পঞ্চপাণ্ডব নিশ্চুপ থাকেন। এই সময়ে ব্যাসদেবের ভাষ্য অনুযায়ী কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে বস্ত্রাবৃত করে ফেলেন। এই ঘটনা সবাইকে হতচকিত করে। ধৃতরাষ্ট্র ভীত হয়ে পড়েন। দ্রৌপদী হস্তিনাপুরের ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর প্রমুখ মান্যবরকে ব্যঙ্গ করে বলেন যাঁরা নারীর সম্মান রাখতে পারেন না তাঁদের ক্লীব ছাড়া আর কিছুই বলা উচিত নয়। বিদুরকে বলেন তিনি বৃথাই ন্যায়নীতি শিক্ষা করেছেন। ধর্মের উপস্থাপনা করার মেরুদণ্ড তাঁর নেই। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ। কিন্তু বোধ, বিবেচনা ও শালীনতা রক্ষার জন্য কী চোখ একান্ত অপরিহার্য! দ্রৌপদীর পাঁচ স্বামী। অথচ তাঁরা বর্তমানে ক্রীতদাস। আর তাদের জেষ্ঠ্যভ্রাতা অক্ষক্রীড়ায় এতই আসক্ত যে নিজের স্ত্রীকেও পণ্য মনে করে বাজি ধরেন। বিমূঢ় ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের রাজ্য ফিরিয়ে দেন। পাণ্ডবদের দাসত্বমুক্ত করেন এবং দ্রৌপদীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কিন্তু পাণ্ডবদের রাজ্যহারা না করলে দুর্যোধনের শান্তি নেই। তাই পুনরায় শকুনির পরামর্শে পাশাখেলার আয়োজন হয়। শর্ত রাখা হয় যে যিনি পরাজিত হবেন, তিনি দ্বাদশ বৎসর বনবাসে এবং এক বছর অজ্ঞাতবাসে থাকবেন। এই অজ্ঞাতবাস চলাকালীন যদি তাঁদের চেনা যায় তাহলে পুনরায় বনবাস পর্ব। যুধিষ্ঠির আবার এই ফাঁদে পা দিয়ে পরাজিত হন এবং দ্রৌপদী ও ভাইদের নিয়ে বনবাসে রওয়ানা হন। একমাত্র ভীম যিনি বলশালী কিন্তু চতুর বা তীক্ষ্ণবুদ্ধি নন, তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে দুর্যোধনের উরুভঙ্গ করে এবং দুঃশাসনের রক্ত পান করে তিনি দ্রৌপদীর অপমানের প্রতিশোধ নেবেন। সেই মুহূর্তে শত লাঞ্ছনার মাঝেও দ্রৌপদী উপলব্ধি করেন তাঁর অসম্মানে যিনি একমাত্র পীড়িত হয়েছেন, তিনি মধ্যম পাণ্ডব ভীম।
পঞ্চপাণ্ডবদের দ্রৌপদী ছাড়াও একাধিক মহিষী ছিলেন। তাঁরা কিন্তু বনবাসে যাননি। কুন্তী থাকলেন বিদুরগৃহে। সুভদ্রা দ্বারকাতেই থাকতেন তাঁর পুত্র অভিমন্যুকে নিয়ে। অর্জুনের অপর সন্তানরাও তাদের মায়ের কাছে থাকতেন। দ্রৌপদী তাঁর পাঁচপুত্রকে কখনই পঞ্চপাণ্ডবের তত্ত্বাবধানে রাখেন নি। তারা দ্রুপদরাজ এবং দ্রৌপদীর ভ্রাতা ধৃষ্টদ্যুম্নের অভিভাবকত্বে ক্ষত্রিয়সুলভ বিদ্যায় পারদর্শী হচ্ছিল।
ব্যাসদেবের লেখা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে পঞ্চপাণ্ডব সম্পর্কে দ্রৌপদীর কিছুটা অবজ্ঞা ছিল। কারণ তাঁদের কারণেই তিনি পাঁচ পাঁচটি স্বামীর দায়বহন করে উপহাসের পাত্রী। অথচ তাঁর চরিত্রের সাথে এই উপহাস খাপ খায় না। আজীবন তিনি নিজের সম্মান, মর্যাদা, অভিমান বজায় রেখে মাথা উঁচু করে চলার সংগ্রাম করে চলেছেন। অথচ তাঁকেই প্রতিপদে অপমানিত হতে হয়। দুর্যোধন তাঁকে অপমান করেন। দুঃশাসনের হাতে তিনি লাঞ্ছিতা হন। বনবাসে থাকাকালীন জয়দ্রথ তাঁর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। এমনকি বিরাটগৃহে অজ্ঞাতবাস পর্বে বিরাট রাজার শ্যালক পর্যন্ত তাঁর অসম্মান করেন।
দ্রৌপদী তাঁর এই লাঞ্ছনার মূল কারণ খুঁজে পান কৌরবদের দুর্ব্যবহারে। তাই তিনি হয়ে ওঠেন প্রতিহিংসাপরায়ণা। কৌরবদের ধ্বংসই তাঁর কাম্য। তাঁর একমাত্র শান্তি কুরুবংশের বিনাশে। শান্তি প্রস্তাবে তাই তাঁর অনীহা।
একসময়ে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটলো। পাণ্ডবরা জয়ী হলেন। কৌরবসূর্য তখন অস্তমিত। বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র একমাত্র জীবিত। দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্রও নিহত। ভারতবর্ষ ক্ষত্রিয়হীন। ধর্মঅধর্মের এই যুদ্ধে পাণ্ডবরা জীবিত আছেন। যমুনাতীরে নিহতদের সৎকারের সময়ে কুন্তী জানালেন এক নির্মম সত্য। কর্ণ জ্যেষ্ঠপুত্র কুন্তীর। পঞ্চপাণ্ডব হাহাকার করে উঠলেন। অসংখ্য ক্ষত্রিয় রমণীর কান্না, কুন্তীর বিলাপ, পাণ্ডবদের মনস্তাপ, ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীর শোক, কিছুই আর স্পর্শ করল না দ্রৌপদীকে। তিনিও সন্তানহীনা। তার থেকেও বড়ো কথা যাঁকে তিনি তাঁর সখা হিসাবে সারাজীবন মনে করে এসেছেন, তিনি কী সত্যই তাঁর সখা? তাহলে জীবন শুরুর প্রথম মুহূর্তে কর্ণকে নিয়ে তিনি তাঁর সাথে এই প্রবঞ্চনা করলেন কেন? তিনি যে আজীবন পঞ্চপাণ্ডবের মহিষী হয়ে রইলেন তাতো তিনি চাননি।
সূর্যদেব অস্তমিত প্রায়। যমুনার জল এখন কালো। চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। দ্রৌপদী অস্তগামী সূর্যের পানে চেয়ে কর্ণের উদ্দেশ্যে তাঁর প্রণাম জানালেন। দিনমণি অস্ত গেলেন।