বিবিধ

অসামান্য অধিনায়ক



দেবাশিস সেনগুপ্ত


এমন ক্যাপ্টেন কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সবাই শ্রদ্ধা করি, ফুটবল যাদের জন্মভূমি।
রাজনীতিতে অনেক নেতা এবং অনেক নেত্রী,
ফুটবলেতে একাই 'একশো' শ্রীমান সুনীল ছেত্রী।

আগামী ৩রা আগস্ট ২০২৪ তারিখে তিনি ৪০ পেরিয়ে যাবেন। তার ৭৯ দিন আগে, ১৬ মে ২০২৪ তারিখে তিনি আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। ৬ জুন ২০২৪ তারিখে যুবভারতী স্টেডিয়ামে কুয়েতের বিরুদ্ধে শেষবারের জন্য তিনি মাঠে নামলেন ভারতের জাতীয় দলের জার্সি গায়ে। ১২ই জুন ২০২৩ তারিখে তার ভারতের জাতীয় দলের হয়ে খেলার (১২ই জুন ২০০৫ থেকে) ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছিল। আজ অবধি এই প্রায় ১৯ বছরে ১৫১টি ম্যাচে দেশের জার্সি গায়ে চাপিয়ে খেলে তিনি গোল করেছেন ৯৪টি। এক ক্যালেন্ডার বছরে দেশের হয়ে সর্বোচ্চ ১৩টি গোল করেছিলেন তিনি ২০১১ সালে, ১৮টি ম্যাচ খেলে। ২০০৬ (১টি ম্যাচ খেলে) আর ২০২০ (কোন ম্যাচ হয়নি লকডাউনের কারণে) ছাড়া সব বছরেই তার গোল ছিল, ভারতের হয়ে। ২০২৩-এও তিনি জাতীয় দলের হয়ে ১৪টি ম্যাচ খেলে ৯টি গোল করেছিলেন।

এখন খেলছেন, এমন খেলোয়াড়দের মধ্যে তিনি স্বদেশের হয়ে ৩য় সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক গোলদাতা (৯৪ গোল), আগে শুধু পর্তুগালের ক্রিস্চিয়ানো রোনাল্ডো (১২৮ গোল) আর আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি (১০৬ গোল)। সবাইকে ধরলে, এই মাপকাঠিতে আপাতত তিনি ৪র্থ স্থানে (ইরানের আলি দাই করেছেন ১০৮টি গোল)। তার আগে ২০০৪-এ অনূর্দ্ধ ২০ ভারতের হয়ে ৩ ম্যাচে ২টি গোল করেছিলেন তিনি।

তার সময়ে ভারত জেতে ২০০৭, ২০০৯ আর ২০১২র নেহরু কাপ আর ২০১১ ও ২০২৩-এর সাফ গেমস চ্যাম্পিয়মশিপ। ২০০৮য়ে ভারতের জেতা এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপে ভারতের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। এই কাপ জিতে ২৭ বছর পরে এএফসি এশিয়ান কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল ভারত। ২০১১র এএফসি এশিয়ান কাপে তার দুটো গোল ছিল ভারতের জাতীয় দলের হয়ে। ২০০৭, ২০১১, ২০১৩, ২০১৪, ২০১৭ এবং ২০১৮-১৯ - মোট এই ৬ বার (এখনো রেকর্ড) এআইএফএফ বছরের সেরা খেলোয়াড় হন তিনি এবং ২০১৬-১৭র আইলীগ আর ২০১৭-১৮র আইএসএল, এই দুই প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৮র ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপেরও সেরা খেলোয়াড় ছিলেন তিনিই, মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত যে প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত। ২০২৩-এ পরপর তিনটি ট্রফি ভারত জিতেছে তারই নেতৃত্বে, যার মধ্যে ছিল ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ আর সাফ গেমস চ্যাম্পিয়নশিপ।

গত বছর মোহনবাগান দিবসে সুব্রত ভট্টাচার্যর আত্মজীবনী "ষোলো আনা বাবলু"র প্রকাশ অনুষ্ঠানে মোহনবাগান মাঠে এসে তার বুদ্ধিদীপ্ত বক্তব্য মুগ্ধ করেছিল সবাইকে। এই বুদ্ধিদীপ্ততাই প্রায় ১৯ বছর ধরে তাকে ভারতের ফুটবল দলের অন্যতম সেরা গোলমেশিন ও খেলা তৈরী করার প্রেরণা হিসেবে থেকে যেতে সাহায্য করেছে। ৬ বার এআইএফএফ বছরের সেরা খেলোয়াড় হওয়া, ১৫০ ম্যাচে দেশের জার্সি পড়া, দেশের হয়ে ৯৪টি গোল করা ছাড়াও ২০১১র অর্জুন পুরস্কার, ২০১৯-এর পদ্মশ্রী পুরস্কার আর ২০২১-এর খেলরত্ন পুরস্কার প্রাপকের নামও সুনীল ছেত্রী।

কলকাতার দুই প্রধানেও সাফল্যের সঙ্গে খেলে গেছেন তিনি। চার বছর খেলে ৯০ ম্যাচে মোহনবাগানের হয়ে (২০০২-০৩, ২০০৩-০৪, ২০০৪-০৫, ২০১১-১২) তার গোলসংখ্যা ৩৭ আর ইস্টবেঙ্গলের হয়ে (২০০৮-০৯) এক বছর খেলে ২৬ ম্যাচে তার গোল ছিল ১৩টি। ২০১০-১১ সালে ইউনাইটেড ক্লাবের (তখন চিরাগ ইউনাইটেড) হয়ে ৭ ম্যাচে ৭ গোল করেছিলেন তিনি। ৫৫০ ক্লাব ম্যাচে তার করা গোলসংখ্যা ২৫৩। সবচেয়ে বেশি ২৮২টি ম্যাচ খেলে ১২৩টি গোল করেছেন বেঙ্গালুরু এফ সি-র হয়ে। আপাতত পুরো কেরিয়ারে তার করা গোলসংখ্যা ৩৪৭ (দেশের হয়ে ৯৪টি আর ক্লাব ম্যাচে ২৫৩টি)।

যত পুরনো হয়েছেন, ততই আকর্ষণীয় ফুটবলার হয়ে উঠেছেন ভারতীয় ফুটবলের অসামান্য খেলোয়াড় ও অধিনায়ক সুনীল ছেত্রী। যত বয়েস বেড়েছে, তত মনের মধ্যে স্থায়ী হয়েছেন সামনে থেকে লড়ে যাওয়া ভারতীয় ফুটবলের পথদ্রষ্টা সুনীল ছেত্রী। রেকর্ড যার হয়ে কথা বলে গেছে, বলে যাবে সারা জীবন।

ভালো থাকবেন ভারতীয় ফুটবলের “এস সি ১১”।
ভালো থাকবেন ভারতীয় ফুটবলের ১৯ বছরব্যাপী নির্ভরতার শেষ টার্মিনাস।
ভালো থাকবেন ভারতীয় ফুটবলের ১৯ বছরব্যাপী ভরসার বটগাছ।
ভালো কাটুক দেশের হয়ে ফুটবল পরবর্তী আপনার জীবনের দ্বিতীয় অর্ধ।

৬ জুন ২০২৪-এর পরে ভারতের খেলা দেখতে বসলে মাঠের মধ্যে ঘুরতে থাকা চোখ দুটো অনেক কিছু খুঁজবে কিন্তু খুঁজে পাবেনা। খুঁজে পাবেনা একটা ১১ নম্বর নীলাভ কমলা ভারতীয় জার্সি পরা ছোটোখাটো শরীর। খুঁজে পাবেনা তার হাতে একটা কমলা রঙের আর্মব্যান্ডের আড়ালে লিডারশিপ। খুঁজে পাবেনা তার পায়ে বলের ছদ্মবেশে নিশ্চিন্ত নির্ভরতা। খুঁজে পাবেনা তার মাথায় বলে হওয়ার পরের বিস্ফোরণ। ৬ জুন ২০২৪-এর পরে আমরা ভারতীয় ফুটবল অনুরাগীরা হয়ত হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারব “আমাদের একটা সুনীল ছিল”।

সবকিছুর জন্য শ্রদ্ধা ও আন্তরিক ধন্যবাদ, ক্যাপ্টেন।