সেই থেকে মামা বাড়ির সাথে আমার সম্পর্কের ইতি। আর কোনোদিন মামা বাড়ির দিকে পা বাড়াইনি। পরে শুনেছি নয়নদি আমার জন্য খুব কেঁদেছে, তিনদিন তিন রাত কিছু না খেয়ে চুপচাপ বিছানায় পড়ে থেকেছে। মামা-মামী দুজনেই দিদাকে বকাবকি করেছে - ভাইফোঁটার দিনে এভাবে অভুক্ত ছেলেটাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলে। কীভাবে পারলে মা, তুমিও তো মা, নাতি-নাতনি হচ্ছে দিদা-ঠাকুমাদের অত্যন্ত আদরের, আর তুমি? ছিঃ, নরকেও ঠাঁই হবে না তোমার। উৎসব অনুষ্ঠানের দিন বাড়ি থেকে কুকুর বেড়াল কেও তাড়াতে নেই, আর এভাবে ছেলেটা কে বললে? আমি কীভাবে দিদির সামনে গিয়ে দাঁড়াবো?
মামা পরে একদিন এসেছিলেন। মাকে ওই ঘটনার কথা বলেছেন। কিন্তু মা তো জানতেন না, আমি মাকে এ ব্যাপারে কিছুই বলিনি। আমাকেও মামা বারবার যেতে বলেছেন, আমি সব সইতে পারি কিন্তু বাবার অপমান আমি কিছুতেই সইতে পারি না। মামা চলে যাবার পর মা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ঠিক কী ঘটেছিল। আমি কোনো কথা বলিনি। আমি জানতাম মা আমার কথা বিশ্বাস করবে না। তাই কিছু না বলে চুপ করে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থেকেছি। তার জন্য মায়ের কাছে আমাকে উত্তম-মধ্যম খেতে হয়েছে। আমি নীরবে সব সহ্য করেছি। আমার এই অপমান কেবল একজনকে খুব টলিয়ে দিয়েছিল-সেটা হলো আমার নয়নদি। ঠিক একবছর পরে ভাইফোঁটার দিনই সে আত্মহত্যা করে। মারা যাবার কিছুক্ষণ আগেও দু-তিনবার জয় জয় বলে চোখের জলে এ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছে। আমি মনে মনে বলেছিলাম-নয়নদি পারলে আমাকে ক্ষমা করিস।
কলেজে ভর্তির জন্য কিছু টাকার দরকার ছিল। সেই সময় কিছু টাকা কম পড়ে যায়। ভর্তি ফি বাবদ প্রায় শ'দুয়েক টাকা, অনেক জায়গায় গেলাম কিন্তু টাকার সংস্থান হলো না। হাতে শ’দেড়েক টাকা ছিল, ভর্তিরও দিন তিনেক বাকি। আমার এক বন্ধু বললো-চিন্তা করিস না, ঠিক ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু ভর্তির ঠিক আগের দিন পর্যন্ত টাকার জোগাড় হলো না। তখন আমার অত্যন্ত প্রিয় একটা হাতঘড়ি বিক্রি করে টাকার জোগাড় করলাম। এই হাতঘড়ি কেনার একটা ইতিহাস আছে - আমি বৌবাজারে একটা বাড়িতে টিউশনি করতাম। ভদ্রলোকের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো বললে কম বলা হয় বেশ সম্পন্ন। ওনার দুই ছেলেকে একসাথে পড়াতাম। মাসিক একশত টাকা মাইনে। সেই টাকাটা তিনি দেওয়া শুরু করতেন মাসের দশ তারিখে এবং শেষ করতেন মাসের ত্রিশ তারিখে। আজ দশ টাকা, কাল পনেরো টাকা, বিশ তারিখে আবার পঁচিশ টাকা - এভাবে একশো টাকা দিতে তাঁর কুড়ি দিন সময় লাগতো। মাঝে মাঝেই মনে হতো এই টিউশনিটা ছেড়ে দিই, কিন্তু আমি জানতাম যে, আমি ছেড়ে দিলে ওদের জন্য আর কোনো মাস্টারমশাই দেওয়া হবে না। তাছাড়া ছেলে দুটোকে বেশ ভালোবেসে ফেলেছিলাম। রোজ সন্ধেবেলা ওরা আমার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো। তখন আমার নিজের কোনো ঘড়ি ছিলো না। তাই মাঝে মাঝেই একটু আগুপিছু হয়ে যেত। এতে ওদের মা অবশ্য কিছু বলতেন না। তখনই ঘড়ির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলাম। আমার ছাত্রদ্বয়ের পিতা ব্যবসার জন্য নিয়মিত কলকাতা যাতায়াত করতেন। ওনাকে একদিন বললাম, আমার জন্য একটা ভালো ঘড়ি আনতে। ভদ্রলোক কিছুদিন পর কলকাতা থেকে একটা পছন্দ মত ভালো ঘড়ি এনে দিলেন। সেই প্রথম আমার হাতে ঘড়ি এলো, আমি ভীষণ খুশি হলাম। তখন স্কুলে ঘড়ি পরার চল ছিলো না। ঘড়ি পরে স্কুলে গেলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা ছিলো। তাই কোনোদিনই ঘড়ি পরে স্কুলে যাওয়া হয় নি। কিন্তু ওটাকে বেশ যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম। সাদা ডায়ালের অক্সিডাইসড কালারের চেন লাগানো ঘড়ি আমার খুব আপন হয়ে উঠেছিল। টিউশন বাড়িতে ওটা পরে গেলে তাঁরাও জিজ্ঞেস করতেন - এত সুন্দর ঘড়ি কোথা থেকে এনেছ?
আমি মুচকি হেসে বলতাম - এটা সিক্রেট, বলা যাবে না।
অত্যন্ত প্রিয় সেই ঘড়িটা মাত্র পঞ্চাশ টাকায় বিক্রি করে পরীক্ষার ফিস দিতে হয়েছিল। বুকটা আজও ব্যথায় চিনচিন করে। তখন লাভ-ক্ষতির হিসেব অতশত বুঝতাম না। শুধু এইটুকু বুঝতাম যে, এখন লাভ-ক্ষতির হিসেব করার সময় নয়। মনে মনে বলতাম - জয় এগিয়ে চলো, তোমার অভীষ্ট লক্ষ্যে তোমাকে পৌঁছাতেই হবে এর জন্য যত মূল্য দিতে হয় দাও। পিছন ফিরে তাকাবার অবকাশ নেই, সামনে অনেকটা পথ যেতে হবে। কত গেল আর কত এলো এ হিসেব না হয় পরে করা যাবে।
(ক্রমশ)