গল্প ও অণুগল্প

আত্মপরিচয়



মৌসুমী মৌ (বাংলাদেশ)


'বউটা বাঁচবে তো?'

সবাই যখন এই আশঙ্কা করছে তখন আমাদের মনে চলছে, 'বউটা বাঁচলে ওকে মেনে নিতে পারবে তো তপন?'

কারো মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়ে এ চিন্তা করাটা হয়তো আমাদের ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু এ চিন্তা না করেও উপায় নেই। শুধু তপনের কথায় বা কেন ভাবছি, আজীবন সৌন্দর্য সচেতন মেয়ে সায়ন্তিকা নিজেই কি ওকে মেনে নিতে পারবে?

পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে ক্যারিয়ারে থিতু হয়ে আমরা যখন সবাই সংসারী এমনকি কারো কারো চার পাঁচ বছরের সন্তানও হয়ে গেছে তখনো তপন বিয়ে করেনি মন মতো মেয়ে না পাওয়ার কারণে। তপনের মন মতো বলতে এখনকার যুগে যে কথার চল খুব, বিউটি উইথ ব্রেইন।

কিন্তু এ যুগে অমন মেয়ে পাওয়া ভার। যার বিউটি আছে তাঁর মাঝে ব্রেইনের ছিটেফোঁটা দেখা যায় না। আসলে তাঁর তো ব্রেইন লাগেই না। সৌন্দর্য দিয়েই উৎরে যায় একটা জীবন। অন্যদিকে ব্রেইনের দিকটা দেখলে মাঝারি মানের সুন্দরী মেয়ে নিতে হয়। কিন্তু তা নিতে নারাজ তপন। শুধু কি তপন? তপনের পরিবারও এতে কম যায় না। আমরা যখন হাপিত্যেশ করছি, 'ও কাকিমা, তপনটা যে বুড়ো হয়ে গেল, ওর তো একটা বিয়ে দেওয়া দরকার।'

কাকিমার তখন অকপটে উত্তর, 'মনমতো একটা মেয়ে দেখে দিতে পারছিস না তোরা? সেরকম মেয়ে না পেলে কার সাথেই বা বিয়েটা দেই বল?

তোদের ননদ টনদ নেই, সেরকম থাকলে দেখ না কোনো ব্যবস্থা করতে পারিস কি-না!'

এমনিতেও তো আমরা বন্ধুবান্ধবেরা চেষ্টা কম করিনি কিন্তু সেবারে কাকিমার কথায় আমার এক দূরসম্পর্কের সুন্দরী ননদকে নিয়ে গেলাম সাথে করে। মেয়েটা ভালো, তবে নতুন জায়গাতে গিয়ে একটু চুপচাপ থাকে। পরিচিত হয়ে গেলে বেশ মিশুক হয়ে যায়।

গল্পসল্প শেষে কাকিমা আমায় একপাশে ডেকে নিয়ে বললো, 'কীরে রিমা, এ কার নিয়ে আসলি? এ মেয়ে তো কথায় কয় না দেখি। সমাজে পাঁচ দশজনের সাথে উঠবে বসবে কী করে? তোরা আসলে তোদের সাথে দু চারটে কথাও তো বলতে পারবে না।'

'এখানে সবাই নতুন তো, এইজন্য কম কথা বলছে। ও পরিচিত হয়ে গেলে তখন আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবেনে কাকিমা।'

'তা পৃথিবীতে সবাই তো আর পরিচিত হবে না, আমার ছেলে কি নতুন জায়গায় বউ নিয়ে গেলে পরিচয়ের সময় বলে দেবে যে, 'আমার বউ কিন্তু অত নতুন মানুষের সাথে কথা টথা বলতে পারে না, আগে কয়দিন পরিচিত হবেন তারপর কথা বলবে।"

আমি আর মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলাম না। তখনকার মতো তপনের বিয়ের কথাতে ক্ষান্ত দিলাম আমরা সবাই।

সেই তপনই একদিন ফোন করে শিল্পকলার একটা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালো আমাদের কয়েকজনকে। হঠাৎ এমন আমন্ত্রণের হেতু জিজ্ঞাসা করাতে মুচকি হেসে বলেছিল, 'অপেক্ষা কর, বুঝতে পারবি।'

আসলেই বুঝতে পেরেছিলাম আমরা, যখন 'সবুজ সংঘ নাট্য একাডেমি' মঞ্চে আসলো। মেইন ক্যারেক্টারে যে মেয়েটা অভিনয় করলো আমরা কেউই চোখ ফেরাতে পারলাম না তাঁর দিক থেকে। কিছুক্ষণের জন্য সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম। নাটকটা শেষ হওয়া মাত্রই তপন আমাদেরকে অনেকটা ঠেলে ঠেলে এগিয়ে দিলো মঞ্চের পিছনে৷ 'যা এবার কোনো ব্যবস্থা করে আয়।'

কথাবার্তা বলার পর যা বুঝেছিলাম, মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা মেয়েটার নাম সায়ন্তিকা, স্নাতক শেষ বর্ষে পড়ালেখা। জানালো অভিনয়ই ধ্যান জ্ঞান।
এ কথা না বললেও ওকে আর ওর অভিনয় দেখেই বুঝে গেছিলাম। ওর জন্মই যেন অভিনয়ের জন্য।

নিজের চেহারা, গুণ আর আত্মবিশ্বাসকে ভর করে ঘোরাতে চেয়েছিল ভাগ্যের চাকা। ঠিক সেই জিনিসগুলেকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলো অন্য কেউ।

প্রথমে রাজি হতে চায়নি সায়ন্তিকা। স্বপ্নপূরণের উদ্দেশ্যে ছুটতে চেয়েছিল কিন্তু নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের বাবারা ঠিক অতটা সাহস দেখাতে পারে না। তাদেরকে আঁকড়ে ধরে ভয় আর সামজিকতা।

'আমরা আর তোর জন্য কতটুকু করতে পারবো বল, ওনারা বড়ো মানুষ, বড়ো বড়ো লোকদের সাথে ওঠাবসা। তোর স্বপ্নপূরণে বরং আরো সুবিধা হবে।'

কাঁচুমাঁচু করে থাকা বাবার মুখের দিকে আর তাকাতে পারেনি সায়ন্তিকা। মত দিয়ে দিয়েছিল বিয়েতে।

বেশ ঘটা করে বিয়ে হলো তপন আর সায়ন্তিকার। কিন্তু তপনের যেন বিয়ের রেশ কাটেই না। বউকে নিয়ে আদিখ্যেতা করে বেড়ায় অনলাইন, অফলাইনে। শুরুর দিকে সায়ন্তিকার ভালো লাগলেও, ধীরে ধীরে বিরক্ত হতে শুরু করে সে। কিন্তু তপনের সে দিকে খেয়াল নেই, এত সুন্দর, বুদ্ধিমতি একটা বউ পেয়ে সে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেছে। তাই বছর পেরোলেও এখনো একইভাবে বউকে কাছ ছাড়া করতে চায় না সে। কিন্তু সায়ন্তিকা ততদিনে হাঁপিয়ে উঠেছে, অভিনয়ে গ্যাপ পড়ে. যাচ্ছে অনেক। স্থানীয় নাট্যদলের খাতায় নাম লেখালেও রিহার্সালে যেতে পারে না ঠিকঠাক। শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, স্বামী সংসার সামলে ক্যারিয়ারের জন্য কিছুই করা হয়ে ওঠে না। মনটা সবসময় ওদিকেই পড়ে থাকে। আনমনা হয়ে ওঠে সে। একদিন তো শাশুড়ি বলেই উঠেন,

'বউ মানুষের আবার কীসির অভিনয়? বউ ঘরের লক্ষ্মী। সে সবসময় থাকপে ঘরে। বাড়ির বউ ঘরের বাইরি পা রাখলো সেতা কি ভালো দেখায় না লোকে ভালো চোখে দেখে? এইতো সেদিন, তানিয়ার মা বললো, 'শুনলাম তোমাগের বাড়ির বউ না-কি নাটক করে বেড়ায়।' এসব কথা কারই বা শুনতি ভালো লাগে?'

'কিন্তু মা, আপনারা তো সব জানতেন। আমার অভিনয়ের কথা, এই সেক্টরে আমার ক্যারিয়ার গড়ার কথা। সব জেনে শুনেই তো ঘরের বউ করে নিয়ে এসেছিলেন। 'দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিয়েছিল সায়ন্তিকা।

'মেয়ে মানুষের আবার কীসির ক্যারিয়ার? বিয়ে হয়ে গিয়েছে এখন স্বামী সংসার সামলাও। বিয়ের আগে যা করেছো, করেছো। এখন সব বাদ। আমার ছেলে কি কম টাকা ইনকাম করে না-কি যে বউ হয়ে তুমার বাইরে যাতি হবে?'

'মা, ব্যাপারটা তো টাকা ইনকামের নয়। ব্যাপারটা হচ্ছে নিজের একটা পরিচয় তৈরি করার।'

'খুব তো চ্যাটাং চ্যাটাং কথা কও তুমি! হ্যাঁ, নাটক করা মেয়ে ঘরে আনিছি, কথা তো শুনতিই হবে। নিজের আবার আলাদা পরিচয় কী? আমরা কি বিন পরিচয়ে আছি না-কি?'

অর্থহীন এসব কথার কোনো উত্তর দিতে পারে না মেয়েটা। অতিমাত্রার ভালোবাসা আর শ্বাশুড়ির সামজিকতার দোহাই নিয়ে হাঁসফাঁস করছিল মেয়েটা। তপনও না-কি একদিন বলেছিল,

'মা যতক্ষণ নিষেধ করছে, তোমারই বা অভিনয় করার কী দরকার? না করলে হয় না?'

সায়ন্তিকা কিছু বলেনি, শুধু তপনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।

দিনদিন বিষন্নতা আঁকড়ে ধরে মেয়েটাকে। নিজের বলে কোনোকিছু দাবি করতে পারে না সে। দমবন্ধ হয়ে আসে। মাঝেমধ্যে আমাকে ফোন দিয়ে দু এক কথা বলে, আমি কিছু বলার আগেই ফোন রেখে দেয়। তপনকে ফোন দিয়ে ওর বিষন্নতার কথা জানালে বলে,

'ধূর, কী বলিস? সবকিছুই তো ঠিক আছে আমাদের মাঝে। আর একটু বিষন্ন থাকলে ওকে বরং আরো সুন্দর দেখায়, চোখগুলো আরো কমনীয় দেখায়।'

সায়ন্তিকার মতো দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ফোনটা নামিয়ে রাখি আমিও। 'ছেলেরা কখনো মেয়েদের মন বোঝে না,' এই কথা আওড়াতে আওড়াতে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

এভাবে নিজের মেধা মননকে জলাঞ্জলি দিয়ে টিকে থাকতে পারছিল না মেয়েটা। পুরোদস্তুর সংসারী মেয়ে হয়ে সে থাকতে পারবে না কথাটা বুঝে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই একেবারে মিইয়ে পড়ে। গত কিছুদিন না-কি তপনের সাথে কথা বলছিল না। শ্বাশুড়ির সাথেও প্রয়োজন ছাড়া মুখোমুখি হচ্ছিল না। তপন অতটা পাত্তা দেয়নি, মেয়েমানুষের এসব নখরাকে এত পাত্তা দিলে চলে না বলেছে না-কি দু একজন বন্ধুর কাছে।

একদিন ভরদুপুরে সুযোগ বুঝে রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে আগুন ধরিয়ে দিলো শরীরে। ওর শ্বাশুড়ি টের পেয়ে কিছু করতে করতে অনেকটা দেরি হয়ে গেল।

কিছু কিছু মানুষের কাছে আত্মসম্মানটা বেঁচে থাকার জন্য অন্যতম একটা কারণ। যেখানে আত্মসম্মান নেই, নিজের আলাদা একটা পরিচয় নেই, সেখানে সে টিকেও থাকতে পারে না। সবকিছু থাকা স্বত্বেও সে নিজের মতো কিছু করতে পারে না বলে পৃথিবীটাকে বড্ড অসহ্য লাগে।

আপাতদৃষ্টিতে দেখা সব পাওয়া এই সায়ন্তিকা যে শেষমেশ আত্মহননের পথ বেছে নেবে আমরা কেউই তা কল্পনা করিনি। তপনও কি ভেবেছিল ধীরে ধীরে সায়ন্তিকার মনটা ওর ওপর, সংসারের উপর এমন বিষিয়ে উঠেছে। একবারের জন্য ভাবতে পারিনি আমরাও।

হাসপাতালে আনার পর ডাঃ জানালেন, 'শরীরের প্রায় ৬০ শতাংশ পুড়ে গেছে। বাঁচার চান্স আছে কিন্তু এক্ষেত্রে রোগীর নিজের বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা খুব জরুরি। যদিও মৃত্যুর ভয়াবহতা সম্পর্কে সে জেনে গেছে অলরেডি কিন্তু তারপরেও রোগীকে দেখে মনে হচ্ছে না যে সে বাঁচতে চায়।'

এর প্রতিত্তুরে ঠিক কী বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না আমরা। নির্বাক হয়ে শুধু চেয়ে রইলাম। এভাবেও চলে যেতে পারে কেউ কেউ!