আলম চাচার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। দু'দিন ধরে ছেলেটির কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না।
ওপার বাংলা থেকে আসার সময় একদল মানুষের সাথে ঠোক্কর খেতে খেতে টলোমলো পায়ে এগিয়ে আসছিল বছর সাতেক বয়সের একটি ছেলে। ধুলোকাদা মাখা মলিন দেহখানি একখানি ছিন্ন বসনের আড়ালে আবৃত ছিলো। কোটরাগত চোখদুটি থেকে বেরিয়ে আসছিলো একটি আর্তি
- আমায় কিছু খেতে দেবে গো, তিন দিন পেরিয়ে গেল জল ছাড়া আর কিছুই খাইনি। আমার বাবা-মা কেউ নেই গো, ওরা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।
আলম চাচার কোনো সন্তানাদি ছিলো না। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর অসহায় ছেলেটিকে দেখে তার চোখ ফেটে জল এসে গিয়েছিল। আলম চাচাও ওপার বাংলার মানুষ। ষাটের দশকের শেষের দিকে তিনি আত্মীয় স্বজনের খোঁজে এদেশে চলে আসেন। তারপর আর ফিরে যাওয়া হয়নি। আর যাবেনই বা কার টানে? মায়ের মুখটাও স্পষ্টভাবে মনে নেই। তার জন্মের তিন মাস আগেই বাবা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তার কোনো ছবি না থাকায় কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেন না তার আব্বু দেখতে কেমন ছিলেন। পৈতৃক সম্পত্তি বলতে তার শীর্ণকায়, কালো কষ্টিপাথরের মতো দেহখানি।
এদেশে কোথায় তার আত্মীয় স্বজনরা ছিলেন তা তার জানা ছিল না। শুনেছিলেন - নদীয়া জেলার চাপড়া থানার অধীনে ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের সন্নিকটে কোনো এক গ্রামে তারা থাকেন। কিন্তু অর্ধ শতকের বেশি সময় হতে চললো আজ পর্যন্ত তিনি তাদের কোনো হদিশ পাননি। অবশেষে হৃদয়পুরের সন্নিকটে ডোম পুকুর গ্রামে ফজল চাচার বাড়িতে পেটভাতায় থেকে যান। ফজল চাচা কোনোদিন তাকে নিজের সন্তানের থেকে আলাদা করে দেখেননি। বছর দশেক পরে হঠাৎ করে ফজল চাচার মৃত্যু হলে সম্পত্তি নিয়ে তার ছেলেদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। গ্রামে শালিসি সভা বসে, সেখানে ফজল চাচার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি চুলচেরা ভাগ করে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বিতরণ করা হলেও চাচি জানের দায়িত্ব নিতে সবাই অস্বীকার করে। তখন শালিসি সভা বিচার করে দুটো বাঁশ বাগান আর ছয় বিঘের একটা শুকনো পুকুর চাচির হাতে তুলে দেন। পুকুরটাকে নতুনভাবে কাটিয়ে মাছের চাষ করবেন তেমন টাকাপয়সা চাচির ছিলো না। আবার ওটাকে বুজিয়ে চাষের জমি হিসেবে ব্যবহার করবেন তারও কোনো উপায় ছিলো না। চাচার মৃত্যুর পর বাড়িতে আলম চাচারও জায়গা না হওয়াটাই স্বাভাবিক। ছেলেরাও মায়ের সঙ্গে সব সম্পর্ক অস্বীকার করে। অবস্থা দেখে আলম চাচা মনে মনে স্থির করেন - বাঙ্গালঝিতে তার পরিচিত এক সুজনের কাছে আশ্রয় নেবেন। কিন্তু চাচির অবস্থার কথা ভেবে তিনি যেতে পারেননি। একদিন কাকভোরে চাচি আলম চাচার কাছে আসেন। তিনি তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেন - আলম তুই আমার ছেলে হয়ে আমার কাছেই থাক। তোর চাচা তো তোকে নিজের ছেলে বলেই ভাবতেন। তার করুণায় যেটুকু পেয়েছি সেটাকে গুছিয়ে নিতে পারলে আশা করি আমাদের মা-ছেলের দিব্যি চলে যাবে। তুই আমার জন্য এটুকু কর বাপ।
- চাচাজি আমার পিতৃতুল্য। তুমিও আমার মা। এতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তোমার ছেলেরা? তোমার কিছু হলে তারা কী আমাকে ছেড়ে কথা কইবে?
- আলম তুই-ই আমার ছেলে। বাকিরা তাদের বাপের সম্পত্তি পেয়েছে। সব সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে।
- কিন্তু ওরা যদি কখনো ঝামেলা পাকায়?
- সে কথা তোকে ভাবতে হবে না বাপ। তুই আমার উপর ভরসা রাখ।
আলম চাচার আর বাঙালঝি যাওয়া হয়নি। চাচির ওপর সম্পূর্ণ ভরসা রেখে তিনি এক নতুন জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দিনরাত এক করে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে চাচির সম্পত্তি এমন জায়গায় পৌঁছে দেন যে, বছর পনেরো বাদে যখন চাচি মারা যান তখন তার সম্পত্তির পরিমাণ তার ছেলেদের চেয়ে তিনগুণ বেশি হয়ে দাঁড়ায়। মৃত্যুর পূর্বে সেই সম্পত্তির অর্ধেকটা গ্রামের মসজিদ, স্কুল আর খেলার মাঠের জন্য এবং বাকিটা আলম চাচার নামে উইল করে রেজিস্ট্রি করে দিয়ে যান। ছেলেদের কিছু বলার থাকে না। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ চাচির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান।
ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আলম চাচার ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। তার চোখে জল নেমে আসে। ভিড়ের মাঝখান থেকে খানিকটা ছোঁ মেরে ছেলেটাকে তুলে নিয়ে আসেন।
- তোর নাম কী রে?
- সঞ্জু মানে সঞ্জয়।
- বাবা মা?
- উঁহু, নেই।
- বাড়ি কোথায়?
- অনেক দূরে, একটা গ্রামে।
- কোন গ্রাম? মানে গ্রামের নাম কী?
- গ্রামের নাম?
- গ্রামের নাম... শোল..., নাহ্, মনে পড়ছে না। আমার খুব খিদে পেয়েছে।
আলম চাচা মনে মনে ভাবেন - শোলকুপা বা সলুয়া হতে পারে। যাইহোক এটুকু বোঝা গেল ওর নাম সঞ্জয় এবং হিঁদুর ছেলে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের কবল থেকে মুক্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান এখন স্বাধীন বাংলাদেশ। চুয়াত্তর সালে মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর ও দেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর তার প্রভাব পড়ে। বেশ কিছু মানুষ জীবিকার সন্ধানে এবং নিজেকে রাজাকার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচাতে স্ত্রী, পুত্র, পরিবার-পরিজন নিয়ে এদেশে চলে আসেন। পশ্চিমবাংলা সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তারা ছড়িয়ে পড়েন। তারই একটা দলের সঙ্গে সঞ্জয় এদেশের মাটিতে ঢুকে পড়েছে। ওর মা-বাবা বেঁচে আছেন কীনা জানা গেল না। যাকগে, সেসব পরে শোনা যাবে। আপাতত ওর খাবারের ব্যবস্থা করা যাক
- সবেদা, ও-ও-ও সবেদা, বলি ঘরে আছিস?
- কেন কী হয়েছে ভাইজান?
- দেখ দেখ আমাদের ঘরে একটা ছোট্ট অতিথি এসে পড়েছে। একটু তাড়াতাড়ি ওর খাবারের ব্যবস্থা কর দিকি।
দেখ সবু, এই ছেলেটা সম্ভবত পথভোলা পথিকের মতো ঘুরপাক খেতে খেতে আমাদের কাছে এসে পড়েছে। ওর খুব খিদে পেয়েছে। ওকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে কিছু একটা খেতে দে। আমি কানুদের বাড়ি থেকে আসছি।
সবেদাকে আলম চাচা সবু বলেই ডাকেন। ওর আসল নাম সবেহার বেওয়া। কীভাবে ওর নাম সবেদা হলো সে এক কাহিনি বটে! শোনা যায় - শৈশবে সবেদা ফল খাওয়ার প্রতি ওর খুব ঝোঁক ছিল। তাই ওর বন্ধুরা ওকে সবেদা বলে ডাকতো। আবার কেউ কেউ বলেন - ওর শারীরিক কাঠামো, মুখাবয়ব এবং চামড়ার রঙের সাথে উক্ত ফলটির সাদৃশ্য থাকায় পাড়ার কোনো এক নানাসাহেব রসিকতা করে ওর নাম সবেদা রাখেন। অষ্টম শ্রেণির পাঠ শেষ করে সবেদা ডোম পুকুর গ্রামের সানু ওরফে সামশের আলির ঘরণী হয়ে আসে। সামশের চাপড়া বাজারে একটি তেলের ঘানিতে কাজ করতো। সানু ভাইয়ের মিষ্টি ব্যবহার এবং রঙ্গ রসিকতার টানে সবাই ওর কাছে ছুটে আসতো। সন্ধের দিকে গল্প গুজব করতে করতে সময় কোথা দিয়ে কেটে যেত তা অনেকেরই খেয়াল থাকতো না। কখনো কখনো গভীর রাত পর্যন্ত গল্প চলতো। দেশভাগের যন্ত্রণা ওদেরকে কুরে কুরে খায়, ওরা পরস্পর আলোচনা করে - নিজের জন্মভূমি ছেড়ে চলে আসা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের রেখে এদেশে উদ্বাস্তুর জীবন। তারপর নতুন পরিবেশে নিজেদেরকে মানিয়ে নেওয়া - সে এক অন্য অভিজ্ঞতা। কিছু দিন যেতে না যেতেই বুঝতে পারে এদেশের মাটি, সোনার চেয়ে খাঁটি, আর মানুষগুলো হীরার চেয়েও অনেক বেশি দামি। মানুষ গুলোকে সানু ভাই যেভাবে আপন করে নিতে পেরেছিল তেমনই এরাও ধীরে ধীরে ওর আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠেছিল। তাই সানু ভাইয়ের মাঝে মাঝে বাড়ি ফেরা হতো না। এর মধ্যে সানু দু'দুটো সন্তানের পিতা হয়েছে। সব কিছু নিয়ে বেশ চলছিল। একদিন সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরার সময় হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে যায়। তাড়াহুড়োয় ঘানির মোটর অফ করতে ভুলে গিয়েছিল। মেশিন ঘরে তালা লাগিয়ে কিছুটা এগিয়ে এলে বিদ্যুৎ প্রবাহ পুনরায় চালু হয়। সানু দৌড়ে এগিয়ে এসে দেখল - মোটর চলছে এবং মেশিন চলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। চটপট তালা খুলে মোটরটা অফ করার সময় অসাবধানতার জন্য ওর একটা পা মোটরের ফিতের ফাঁসে জড়িয়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যে সানুর শরীরটা মেশিনের প্রবল গতির কাছে হার মানে এবং মেশিনের মধ্যে ঢুকে দেহটা ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায়। মৃত্যুর আগে সানু একবার মাত্র চিৎকার করতে পেরেছিল। ঠিক সেই সময় ওর বাল্যবন্ধু জয়ন্ত কলঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। চিৎকার শুনে জয়ন্ত কলঘরে ঢুকে সানুর ছিন্নভিন্ন শরীর দেখে ভয়ে আঁতকে ওঠে। সানুর শরীরের কিছুটা অংশ তখনও মেশিনের ফিতের ফাঁসে জড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে। জয়ন্তর আর্তচিৎকার শুনে অনেকেই ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে কলঘরের কাছে এসে ঘটে যাওয়া ঘটনা দেখে পরস্পর পরস্পরের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায়। কারও মুখে কোনো কথা নেই। জয়ন্ত সবাইকে সাথে নিয়ে কলঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। ততক্ষণে কলঘরের মালিক রতন সাহা খবর পেয়ে ছুটে আসেন। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনিও হকচকিয়ে যান। এমন একটা মর্মান্তিক ঘটনায় তিনি নিজেকে সামলাতে পারেন না। তাঁর দুই ছেলে বাইরে থাকে। একমাত্র মেয়ে সাগরিকার বিয়ে দিয়েছেন বছর দুয়েক আগে। কলঘরের দায়িত্ব পুরোটাই সানুর ওপর ছেড়ে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত ছিলেন। এমন সৎ, সহজসরল, নিষ্ঠাবান এবং দায়িত্বশীল ছেলে আজকের দিনে অত্যন্ত দুর্লভ। যন্ত্রদানবের বিষাক্ত ছোবলে সেই ছেলেটির এমন পরিনতি তাকে মুষড়ে দেয়। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, সানু আর বেঁচে নেই।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সবেহার বিবি থেকে সবেহার বেওয়া হয়ে যায়। সানুর মৃত্যুর পর সবেদার ভীষণ আর্থিক অনটন দেখা যায়। দু'দুটো ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার চালানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। অকৃতদার আলম চাচা সবেদার কষ্ট দেখে তাঁর বাড়িতে ঘরকন্নার কাজে নিয়োগ করেন। সবেদাকে মেয়ের মতো আগলে রাখেন। ওর ছেলেমেয়েকে গ্রামের স্কুলে ভর্তি করে দেন। ওদেরকে মানুষ করার জন্য সবেদার প্রধান অবলম্বন হয়ে ওঠে আলম চাচা। আলম চাচাকে সবেদা ভাইজান বলে ডাকতো।
সঞ্জয়কে নিজের ঔরসজাত সন্তানের মর্যাদা দিয়ে মানুষ করেন আলম চাচা। নিজে খুব একটা লেখাপড়া না জানলেও সঞ্জয়ের পড়াশোনার ব্যাপারে তিনি কোনো কার্পণ্য করেননি। কৃষ্ণনগর সরকারি মহাবিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে সঞ্জয়। অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে বি এড পাশ করে স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় কোয়ালিফাই করে বসে আছে অথচ নিয়োগের চিঠি তার কাছে আসেনি। কোন এক অজ্ঞাত কারণে অনেকেরই নিয়োগ আটকে আছে। প্রচন্ড হতাশা ওর মনটাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। তদুপরি নাগরিকত্ব আইন পাস হওয়ার পর বে-নাগরিক হওয়ার দুঃশ্চিন্তা ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আলম চাচাও যে নিশ্চিন্ত মনে বসে আছেন তা নয়। কারণ তারও শিকড় পূর্ব বাংলায় প্রোথিত। এদেশে চলে আসার কোনো প্রমাণপত্র বা ডকুমেন্টস তার কাছে নেই। এই নাগরিকত্ব আইনে আবার বলা হয়েছে - ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের পূর্বে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা মুসলিম বাদে ছয়টি সম্প্রদায়( হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি)-কে আবেদনের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। এইরকম আইন একদিকে যেমন অমানবিক, অন্যদিকে সংবিধান বিরোধী। সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছাত্র-যুবক সহ সাধারণ মানুষ একসাথে এই সর্বনাশা আইনের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন। সারা দেশ যখন প্রবল আক্রোশে ফেটে পড়েছে, সঞ্জয়ও তখন এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। যেদিন নাগরিকত্ব বিল লোকসভায় পাশ করা হয় সেদিন দেশের প্রতিটি শহর, নগর, গঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় কোটি কোটি মানুষের সমাবেশে এই বিলের কপি পোড়ানো হয়। আন্দোলন এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে সরকার দিশেহারা হয়ে পড়ে। এমন সময় 'করোনাসুর' ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। হঠাৎ করে সরকার লকডাউন ঘোষণা করে। ফলে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আইনে পরিনত হলেও তা কার্যকরী করা যায়নি।
তারপর দীর্ঘ লকডাউনের ছোবল কত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল এবং তাদের জীবন ও জীবিকাকে কীভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল তা কারও অজানা ছিল না।
এরপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। একের পর এক নানা জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেতে খেতে অবশেষে সিএএ নামক অ্যানাকোন্ডার বিষাক্ত ছোবলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মানুষ। সামনে লোকসভা নির্বাচন। একে কেন্দ্র করে ভোট বৈতরণী পার হবার এক কুটিল চক্রান্ত মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে অনেকেই সি এ এ-র প্রাণঘাতী ছোবলে আত্মঘাতী হয়েছে। আরও কত অমূল্য প্রাণ অকালে ঝরে যাবে তার ইয়ত্তা নেই।
প্রায় তিন তিনটে দিন কেটে গেল অথচ সঞ্জয় এখনো বাড়ি ফেরেনি। পাড়ার মসজিদে ইশার নামাজের আজান শোনা যাচ্ছে। দিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যে ইশার নামাজের ওয়াক্ত দীর্ঘ সময় ধরে চলে। আজকের নামাজের ওয়াক্ত সন্ধে ৭-১১ মিনিট থেকে শেষ সময় রাত ১১-৫৫ মিনিট পর্যন্ত (সুবহি সাদিকের পূর্ব সময় পর্যন্ত বিদ্যমান)। আলম চাচা মসজিদে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন। সবেমাত্র মাথায় টুপিটা চাপিয়েছেন। এমন সময় দশ-বারোটা ছেলে সঞ্জয়ের নীরব নিথর নিস্পন্দ দেহখানিকে বয়ে নিয়ে আলম চাচার দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। কী হয়েছে ব্যাপারটা বোঝার আগেই ছেলেগুলো সমস্ত ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেয় - কদিন ধরেই সঞ্জয় বেশ মনমরা ছিল। পাগলের মতো বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছিল - অবৈধ নাগরিক, ডিটেনশন ক্যাম্প, ভয়ংকর অভিশপ্ত জীবন! ওকে আমরা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি। গতকাল রাতেও আমাদের সাথে ছিল। সকাল বেলায় ওকে না দেখতে পেয়ে আমরা চারিদিকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়িয়েছি ওকে। অবশেষে ভুবনবাবুর পুকুর পাড় থেকে ওর নিথর দেহখানিকে উদ্ধার করলাম।
সঞ্জয়ের নিষ্প্রাণ দেহের উপর আছড়ে পড়েন আলম চাচা
- এই বুড়ো বয়সে এতবড় দাগা দিয়ে গেলি বাপ? তোকে কী আমি এভাবে চলতে শিখিয়েছি বাপ?
সবেদার কষ্টটা আরও বেশি। সঞ্জয় ওকে সবুমা বলে গলা জড়িয়ে ধরে কত আদর করতো - সবুমা, আমার নিজের মায়ের মুখ মনে পড়ে না। তোমার মধ্যে আমার মাকে খুঁজে পাই। তুমি আমায় দোয়া করো আমি যেন জীবনে অনেক বড়ো হতে পারি। দেখো, এমন লাল টুকটুকে বউ আনবো যে তোমাদের সারাক্ষণ আগলে আগলে রাখবে।
- কোথায় গেলি বাপ আমার, আমাকে মিথ্যে বলে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলি?
সবেদার বুকফাটা কান্না আর আলম চাচার হাহাকার ডোমপুকুর গ্রামের সব মানুষকে এক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে দিল - না না আর নয়, সিএএ নামক অ্যানাকোন্ডার ছোবল থেকে সবাইকে রক্ষা করতে হবে। সঞ্জয়ের নিষ্প্রাণ দেহখানিকে নিয়ে শ্মশানের পথে যখন রওনা দিল তখন ইশার নামাজের শেষ সময় পেরিয়ে গেছে।
সঞ্জয়কে দাহ করে ওরা যখন ফিরে এলো তখন জোহরের নামাজের আজান শোনা গেল। আর কিছুক্ষণ পর পুব আকাশে লাল রঙের সূর্য উঁকি দেবে। আলম চাচার উঠোনে দাঁড়িয়ে প্রভাত সূর্যের রক্তিম আলোয় নিজেদেরকে জারিত করে এক নতুন জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার শপথ নিয়ে ধীর অথচ দৃঢ পদবিক্ষেপে একে একে নিজের নিজের বাড়ির পথে এগিয়ে চললো। সবেদা বেওয়ার বুকফাটা কান্না ভোরের আলোর বুক চিরে গ্রামের পথে পথে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো।