গল্প ও অণুগল্প

সহধর্মিণীর সিন্দুক



স্বপন সাহা


(১)

পার্কিং লটে গাড়ি রেখে উপহারটা হাতে নিয়ে এগিয়ে যাই পূর্ব পরিচিত ম্যারেজ হলের দিকে। এই ম্যারেজ হলটি শুধু মাত্র বিত্তশালীদেরই নেওয়া সম্ভব। সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিশাল আয়তনের ম্যারেজ হলের সংলগ্ন সবুজ ঘাসের সুন্দর লন রঙিন আলোকে সাজিয়ে জলসার আয়োজন হয়েছে। সঙ্গে আমার স্ত্রী বিশাখা। হলে ঢুকতে বন্ধু সত্যব্রত ও ওর স্ত্রী এগিয়ে আসে। আজ সত্যব্রতর ছেলে অভিষেকের বধূ পরিচিতি অনুষ্ঠান উপলক্ষে আসতে হয়েছে। হাজার ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও। নববধূর সাথে আলাপ করবার পর দুচার কথা বলতে ক্যাটারারের লোক ট্রেতে ঠান্ডা পানীয় নিয়ে আসে আমি ও বিশাখা দুটো গ্লাস তুলে নিই। সত্যকে বলি আমাদের জন্য ব্যস্ত হতে হবে না, তুই তোর গেস্টদের সামলা। ইতিমধ্যে সুবেশা আরও মহিলা উপস্থিত হন। তারা বিশাখার পূর্ব পরিচিত। ওরা লনের দিকে যায় জলসায়, কোনো শিল্পী গান গাইছে ওখানে। বিশাখা বলে, আমি ওখানে যাচ্ছি তুমি যদি না যাও তবে ডিনারের সময় ডেকো।

(২)

এরপর আমি একলা হলের ভেতরের ওয়ালে সুন্দর সুন্দর অয়েল পেন্টিং টাঙানো আছে ওগুলো দেখতে থাকি। কিছু দূরে এক মহিলা অয়েল পেন্টিং মনোযোগ দিয়ে দেখছে দেখি। দূর থেকে মনে হলো এই অভিজাত পরিবেশে মহিলার সাধারণ মানের পোশাক বেমানান লাগছিল। কাছাকাছি যেতেই চমকে উঠে বলি জয়িতা না? তুমি এখানে? তোমার তো বম্বেতে থাকার কথা। প্রথমে আমায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। উপায়ন্তর না দেখে বলে কেমন আছো অমল? বিস্মিত হই এখানে ওর উপস্থিতি, মনে করিয়ে দেয় ইউনিভার্সিটির সেই দিনগুলো। যে বছর আমার ফাইনাল ইয়ার সে বছর জয়িতা নবাগতা। নবীন বরণ অনুষ্ঠানে ও যেচে এসে আলাপ করে।

(৩)

ইউনিভার্সিটিতে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট বলে কিছুটা সুনাম থাকায়, ও কারো কাছে শুনে থাকবে, তাই যেচে আলাপ করে। আর পড়ার ব্যাপারে ওকে নোটস দিয়েও গাইড করতে হবে আবদার করে। আপত্তি করিনি। নোটস নেওয়ার সাথে সাথে ও ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে থাকে। ও বড়লোকের মেয়ে ওর বাবা হাইকোর্টের নামী ব্যারিষ্টার। বাড়ির গাড়িতে আসা যাওয়া করতো। আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে থাকায় বাড়ির গাড়িতে আসলে ও ফিরতো আমার সাথে বাসে বা ট্রামে। আমি সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে ছিলাম। বাবা স্বল্প বেতনের করণিকের চাকরি করতেন। একটা ছোট দু'কামরা ঘরে বাবা মা ও আমি থাকতাম।

বাবার বেতন সংসার খরচে শেষ হয়ে যেত। ফলে পড়াশোনার খরচ আমায় টিউশনি করে চালাতে হতো। আর্থিক অবস্থানে আমার আর জয়িতার বিস্তর ফারাক ছিল।

(৪)

জয়িতা বাবা মার একমাত্র সন্তান। তারাই বা আমাদের মতন সাধারণ ঘরে মেয়ের বিয়ে দেবেন কেন? মনে সংশয়ের কথা জয়িতাকে বলি, যখন ক্রমশ ও ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে থাকে। ও বলে ইউনিভার্সিটির ব্রিলিয়ান্ট বয় কি পাশ করে বসে থাকবে? ঠিক পদস্থ কোনো চাকরি করবে। বরাবরই উচ্চাকাঙ্খী ও আমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতো। যথাসময়ে কৃতিত্বের সাথে পাশ করে বেরিয়ে চাকরির খোঁজ করছি। এমন সময় বিনা মেঘে বজ্রপাত। আকাশ ভেঙে পড়ে মাথায়। হঠাৎ করে বাবা মারা যান। বাবার আয়ে সংসারটা চলতো সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুখে। যেহেতু কর্মরত অবস্থায় বাবা মারা যান তাই কম্পাসানেট গ্রাউন্ডে সংসারটা বাঁচাতে বাবার চাকরিটা নিতে বাধ্য হই। বাবার মৃত্যুর পরে মা'র শরীরও ভাঙতে থাকে। আমাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। বলে মরার আগে ছেলের বউ দেখে যেতে চাই।

বলি বউ যে আনবো খাওয়াবো কি? এই বেতনে তোমার আমার চলে গেলেও পরের মেয়ে আনলে খরচ বাড়বে, শেষে কি বিপদে পড়বো?

(৫)

মার কথা, আমার ছেলে কি বসে থাকবে? ঠিক মস্ত অফিসার হবে। মনে মনে হাসি চাকরি সমন্ধে মার কোন ধারণা ছিল না। তাই বলি যখন হবে, তখন দেখা যাবে। মাও নাছোড় এদিকে জয়িতাও দেখা হলে ভালো চাকরির খোঁজ পেলাম কিনা জানতে চায়। বলি চেষ্টা তো করছি কিন্তু হচ্ছে কোথায়। ওর মন বোঝার জন্য বলি তুমি যদি চাও এই চাকরিতে আমরা বিয়ে করতে পারি। মা আর কদিন এরপর একজনের খরচ কমে যাবে। একদিন আমাদের বাড়িতে নিয়ে মার সাথে আলাপও করিয়ে দিই। আমাদের বাড়ির অবস্থা দেখে ও যে নিরাশ হয়েছে বুঝতে পারি। তাই আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলে আমায় একটু ভাবতে দাও। ও চলে যায় ওর গমন পথের দিকে চেয়ে বুঝতে পারি জবাব আমি আর কোনদিন পাব না। ও যদি সত্যি ভালোবাসতো তবে লাভক্ষতি হিসাব না করে সম্মতি দিত। আঘাত পেলেও আমি ওকে বুঝতে দিই নি। এরপর ও নিজে দূরত্ব বাড়াতে থাকে।

(৬)

কিছু দিন পর বিয়ের কার্ড নিয়ে নিমন্ত্রণ করতে আসে। বলে বাবা হঠাৎ আমার বিয়ে ঠিক করায় রাজি হতে হলো। ক্ষণিকের বিচলিত ভাবটা গোপন করে জানতে চাই কোথায় ঠিক হলো? ও বলে বাবার এক ক্লায়েন্ট বম্বের বান্দ্রা অঞ্চলে দত্ত ট্রের্ডাস নামের বিত্তশালী পরিবারের সমন্ধটা নিয়ে আসে। বাবা রাজি হয়ে যায়। বলি আর তুমি? কিছুটা বিব্রত হয়ে বলে ভেবেছিলাম তুমি ভালো পদস্থ চাকরি করবে আমি বাবাকে রাজি করাতে পারবো। কিন্তু তা না হওয়াতে আমি বাধ্য হই মত দিতে। বুঝি ওর রাজি হওয়াটা ছিল, সুখের নিক্তিতে আমার ভালোবাসা কম পড়ে যাওয়ায়। যাইহোক মুখে হাসি ফুটিয়ে ওকে আগাম শুভেচ্ছা জানাই। এসো কিন্তু মৃদু স্বরে বলে ও চলে যায়। ওর গমন পথের দিকে চেয়ে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে ওঠে।

(৭)

এরপর দু'দশকের বেশি সময় ধরে যোগাযোগ ছিল না। ওকে ভুলতে চেষ্টা করি কিন্তু ভুলতে পারছিলাম না। ওর তঞ্চকতা ভালোবাসার ভান করে কাজ গুছিয়ে নেওয়া। আমার ভালোবাসাকে এভাবে ঠুকরে চলে যাওয়া মেনে নিতে কষ্ট হতো। খুব অস্থির অস্থির লাগতো। এদিকে মাও আলটিমেটাম দেয় খোকা তুই যদি বিয়ে না করিস আমি কিন্তু বেশি দিন বাঁচবো না। আমি চাই মরার আগে ছেলের বউ এর মুখ দেখে যেতে। ওর হাতের রান্না খেয়ে যেতে। এরপর আর হাঁড়ি ঠেলতে পারবো না। আমি মজা করে বলি যাকে বিয়ে করে আনবো সেই মেমসাহেব যদি তোমার হেঁশেলে হাঁড়ি ঠেলতে রাজি না হয়? মা বলে দেখিস এমন মেয়ে আনবো সে ঘরের লক্ষ্মী হয়ে আসবে। এর কিছু দিন পর একটা সমন্ধ নিয়ে আসে। আমায় ফটো দেখায় মেয়েটি দেখতে বেশ সুশ্রী। তবে জয়িতার মতো রূপসী না হলেও চোখ দুটো ভারী মায়া মাখানো। নিমরাজি হয়ে বিয়েতে মত দিতে হয়। অনাড়ম্বর করে বিশাখার সাথে আমার বিয়ে হয়।

(৮)

বিয়ের আগে ওর বাবার ছোট একটি মুদিখানা দোকান ছিল। তার থেকে সংসার চলতো। খদ্দেরদের অতিরিক্ত ধার দিয়ে দেওয়ায় ও আদায় না হওয়ায় দোকান বন্ধ হয়ে যায়। সেই আঘাতে ওর বাবা মারা যান। সে সময় ওর বড়ো মামা পাশে এসে দাঁড়ায়। প্রচুর সাহায্য করেন। বিশাখা কলেজ থেকে পাশ করে টিউশনি করে ওর আর ওর মার সংসার চালাতো। মামাও কিছু সাহায্য করতেন। বিয়ের পর বিশাখা এই বাড়িতে এসে বাড়ির ভোল পাল্টে দেয়।

(৯)

চারিদিকে একটা লক্ষ্মীশ্রী। নিপুণ হাতে সব কিছু সাজিয়ে রাখা। মার সেবা করা আমায় অফিস যাওয়ার আগে সময়ে খাবার দেওয়া। একা হাতে সব কিছু করতো। মা ওর কাজে বেজায় খুশি ছিল। কিন্তু এ সব কিছু আমার নজরে সেভাবে পড়তো না। ও বুঝতে পারতো। ওর সাথে কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়তাম লক্ষ্য করতো। এমন কি নবদম্পতির মত আমার আচরণ ছিল না। আসলে জয়িতার সব স্মৃতি তখনও মন থেকে মুছে যায় নি। আমার এই অদ্ভুত আচরণের কি কারণ জানতে চাইলে এড়িয়ে যেতাম। আমার কষ্ট দেখে বুদ্ধিমতী মেয়ে বুঝতে পারতো আমার কোনো অতীত আছে। যা আমায় স্থির থাকতে দেয় না। একদিন ও জোর করে। বলে আমি তো তোমার সহধর্মিণী আমার ও অধিকার আছে জানার কেন তুমি স্বাভাবিক হতে পারছ না। খুলে বলো হয়তো আমি তোমার কোনো কাজে লাগতে পারি। তোমার দুঃখটা আমার সাথে শেয়ার করে লাঘব করো প্লীজ। এরপর আর আপত্তি করিনি।

(১০)

ইউনিভার্সিটিতে জয়িতার সাথে আলাপ থেকে পড়ার ব্যাপারে সাহায্য নেওয়া প্রেম প্রতারণা প্রত্যাখান ওর বিয়ে সব আদ্যপ্রান্ত ওকে বলি। শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে ওর চোয়াল শক্ত হয় আবার স্বাভাবিক হয়। এক সময় বলা শেষ হয় এরপর ও দুদিন চুপচাপ ছিল। এক ছুটির দিনে আমায় বলে, তোমার সাথে কথা আছে। বলি, বল কি বলবে। বলে, না আগে কথা দাও আমি যা বলবো তুমি শুনবে। বলি বেশ। ও বলে ভেবে দেখলাম তুমি মেধাবী ছাত্র ছিলে কিন্তু পরিস্থিতি সে সময় বাধ্য করে তোমায় এই চাকরিটা নিতে। যা তোমার উপযুক্ত নয়। তাই তোমাকে তোমার শিক্ষার প্রতি অবিচার না করে ডব্লিউ বি সি এস পরীক্ষায় বসতে হবে। বলি তা কি করে সম্ভব? চাকরি করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া, বই জোগার করা সম্ভব? ও বলে সব সম্ভব শুধু তুমি রাজি হও। আর হ্যাঁ এই সময় অর্থাৎ চার, পাঁচ বছর যতদিন না তোমার সাফল্য আসছে ততদিন আমরা আমাদের অনাগত সন্তানের কথা ভাববো না। অবাক চোখে চাই ওর দিকে। এও কি সম্ভব একজন নারী গৃহিণী হওয়ার পর এত বছর সন্তান সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখতে পারে? শুধু মাত্র স্বামীর ভবিষ্যৎ পথ সুগম করতে। মনে ভাবি এ নারী নিজ গুণে সমীহ আদায় করে নিতে পারে। আর আপত্তি করিনি শুরু হয় জীবন সংগ্রামের দ্বিতীয় পর্ব।

(১১)

অফিস থেকে ফিরে টিফিন করে বসে যেতাম পরীক্ষার প্রস্তুতিতে। রাতে খাওয়ার পর আবার শুরু করতাম পড়াশোনা। বিশাখা পাশে ঠায় বসে থাকতো। মাঝে চায়ের কাপ হাতে তুলে দিত যাতে ক্লান্তিতে চোখ বুঁজে না আসে। লোডশেডিং হলে পাখার বাতাস করতো। আবার খুব সকালে উঠে অফিস যাওয়ার আগে সময়ে খাবার দেওয়া একা হাতে সব কিছু করা। লড়াইটা ওর কম ছিল না। যথাসময়ে পরীক্ষা দেওয়া ও ফল প্রকাশিত হয়। লিস্টে উপর দিকে আমার নাম জ্বলজ্বল করছে দেখতে পেয়ে ঘরে এসে আনন্দে ওকে জড়িয়ে ধরি। বলি সব কৃতিত্ব তোমার। বলে, না গো তুমি যে হীরা বুঝতে পারি শুধু উপরে একটু আস্তরণ পড়ে ছিল। আমি শুধু ওটুকু পরিষ্কার করেছি। সব তোমার যোগ্যতায় পেরেছো। উপরের দিকে রেঙ্ক হওয়ায় বিডিও পদে পশ্চিম মেদিনীপুর পোস্টিং পাই। বিশাখা আর মা এখানে থাকে। মাকে ও কোনো কাজ করতে দিত না। উইকএন্ডে আমি ঘরে আসতাম।

(১২)

এভাবেই ছ'মাস পার হওয়ার পর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। হাওড়ায় বদলি হয়ে আসি। এবার ঘর থেকে যাতায়াত করতাম। ইতিমধ্যে বিশাখার মা মারা যান। আমি ছুটি নিয়ে সমস্ত পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম করি। বিশাখার আর পিছুটান থাকলো না। কয়েক দিন ওকে চুপচাপ দেখে ভাবলাম হয়তো মার চলে যাওয়া মেনে নিতে কষ্ট হয়েছে। ভুল ভাঙলো ওর কথা শুনে। বলে তোমার সাথে কথা আছে। বলি, কি কথা বলো। বলে আমি ভেবে দেখলাম তোমার যে রকম মেধা তাতে তোমায় আই এ এস পরীক্ষায় বসতে হবে। এই চাকরিতে আটকে থাকলে চলবে না। মৃদু আপত্তি করে বলি বেশ তো স্বচ্ছল ভাবে চলে যাচ্ছে আর কি দরকার? উহু তা বললে শুনবো না তাছাড়া জয়িতাকে জবাব দিতে হবে তো। হেসে বলি পাগল নাকি ও কোথায় বম্বেতে বিত্তশালী পরিবারের গৃহিণী হয়ে ওখানে সংসার করছে। তাছাড়া আমার আই এ এস হওয়ায় ওর কি এসে যায়? সত্যি কথা বলতে কি তোমার নিজের গুণে ও দূরদর্শিতায় যে ভাবে আমার জীবন বদলে দিয়েছো তাতে ও এখন ধূসর অতীত। তা বললে শুনবো না আমি যে তোমার জীবনের ঘটনা শুনে সংকল্প করেছিলাম। বেঁচে থাকতে তোমায় কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চ পদে দেখতে চাই। তুমি কি আমার শেষ ইচ্ছেটুকু পূরণ করবে না? আর আপত্তি করিনি।

(১৩)

শুরু হোলো আরো একটা লড়াই এর প্রস্তুতি। যদিও কঠিন পরীক্ষা তবে নিজের উপর আস্থা ছিল তাই সাফল্যও এলো। আই এ এস হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে সচিবের পদ সামলে বর্তমানে আয়কর বিভাগে পূর্বাঞ্চলের ডেপুটি কমিশনার পদে আছি। এখনো পাঁচ বছর বাকি অবসরের আগে, আশাকরি কমিশনার পদে আসীন হতে পারবো। এক ছেলে আর্যভট্ট পদার্থ বিদ্যায় পি এইচ ডি করে বর্তমানে উচ্চ শিক্ষার জন্য দু'বছর হলো ইংল্যান্ড গেছে। ওরও ফেরার সময় হয়ে এলো। ওকে দেখে ফ্লাসব্যাকে অতীত রোমন্থন করতে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। সম্বিত ফিরে পাই জয়িতার কথায়।

(১৪)

অমল আমায় এবার ফিরতে হবে। মনে হচ্ছে তুমি জীবনে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত। কি করছো? বলি ওই আর কি আয়কর বিভাগে ডেপুটি কমিশনার পদে দায়িত্ব সামলাচ্ছি। কিন্ত কই তুমি বললে নাতো এখানে কি করে এ সময়? তোমার তো বম্বেতে বিত্তশালী পরিবারের গৃহিণী হয়ে থাকার কথা। একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, অমল আমার উচ্চাকাঙ্খী মনোভাব এবং আমার জীবনসাথী নির্বাচনে ভুল পদক্ষেপ আর তোমার ভালোবাসার দাম না দেওয়া। দত্ত ট্রের্ডাস বম্বের নাম করা বিত্তশালী পরিবার বলে জানতাম। কিন্তু বিয়ের পর রিসেপশন পার্টিতে আমার স্বামী প্রদীপ দত্ত যে দত্ত ট্রের্ডাসের কর্ণধার, তার আমন্ত্রিতদের মধ্যে মিস্টার সিংহানিয়া বলে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। শুনেছি সিংহানিয়া বম্বের নামকরা শিল্পপতি। প্রথম পরিচয়ে লোকটার চাহনি ভালো লাগেনি। এরপর মাস দুয়েক যেতে না যেতে সিংহানিয়া বিভিন্ন অজুহাতে আমাদের বাড়ি আসা শুরু করে। সঙ্গে আমার জন্য দামী উপহার আনা। আপত্তি করলে আমার স্বামী অসন্তুষ্ট হতো। কিছু দিন পর জানতে পারি আমার স্বামীর ব্যবসা ভীষণ ক্ষতিতে চলছে। প্রচুর ব্যাঙ্ক লোন যা শোধ হয়নি, বাজারেও ধার। এদিকে আমার স্বামী সিংহানিয়াদের কারখানায় একটা টেন্ডার দেয়। এটা পেলে কয়েক কোটি টাকা লাভ হবে ও বাজারের ধার শোধ করার সুযোগ পাবে। সিংহানিয়াও আশ্বাস দেয় টেন্ডারটা পাইয়ে দেবে। শর্ত আমাকে এক রাতের জন্য ওর অঙ্কশায়িনী হতে হবে। শুনে আমি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি। প্রথমে বোঝানো, পরে মানসিক অত্যাচার, শেষে দৈহিক পীড়ন শুরু হয়।

(১৫)

বাধ্য হয়ে বলা যায় এক কাপড়ে কোলকাতা ফিরে এসে বাবাকে সব বলি। শুনে বাবা ও আমি সিদ্ধান্ত নিই ডিভোর্স দেব। বাবা আইনজীবী তাই একতরফা ডিভোর্স হয়ে যায়। বাবা আমার দুরবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী করতে থাকে। অত্যাধিক মানসিক চাপ নিতে না পারায় সেরিব্রাল অ্যাটাকে পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে পড়ে। প্রচুর খরচ হয় বাবার চিকিৎসায়। বাড়ি গাড়ি সব বিক্রি হয়ে যায়। তবু্ও বাবাকে বাঁচানো গেল না। বর্তমানে শহরের বাইরে বাড়ি ভাড়া করে থাকি আমি ও মা। টিউশনি করি। মা অসুস্থ, মাকে ছেড়ে অনেকক্ষণ হলো এসেছি। সত্যদা মার দূর সম্পর্কের ভাসুরের ছেলে। নিমন্ত্রণ করায় আসতে হলো, এবার ফিরবো। যাবার আগে ওর ঠিকানাটা নিয়ে নিই। ও চলে যায় ওর গমন পথের দিকে চেয়ে থাকি। ওর এই অবস্থা দেখে মনে মনে তো আমার খুশি হওয়ার কথা কিন্তু হতে পারছি না তো। কিগো ডিনারে যাবে তো? পেছনে দেখি বিশাখা, বলি চলো সেরে নিই।

(১৬)

ডিনারে সামান্য কিছু মুখে দিই। সত্য আর ওর স্ত্রীকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে ফিরি। গাড়িতে চুপচাপ ছিলাম ঘরে এসেও চুপচাপ থাকায় ও লক্ষ্য করে জানতে চায় কি হয়েছে? তুমি এত চুপ কেন? এরপর দুজনে শুতে গিয়ে বিশাখাকে জয়িতার ওখানে আগমন থেকে বর্তমান পরিনতি সব খুলে বলি। শুনে ও ভীষণ দুঃখ পায়। বলে কালই তুমি ওদের বাড়ি যাবে। কিছু অর্থ ওর মার চিকিৎসার জন্য দিয়ে আসবে আর জয়িতার জন্য একটা কাজের ব্যবস্থা তুমি দেখে দিও।

মজা করে ওকে বলি প্রাক্তন প্রেমিকার কাছে জেনেশুনে পাঠাচ্ছো তোমার ভয় হচ্ছে না? যদি হাতছাড়া হয়ে যাই? বলে উহু বিন্দু মাত্র নয়। জানতো হিন্দু নারী যখন সহধর্মিণী হয় স্বামীর, সে তখন স্বামীর অর্ধাঙ্গের অংশীদার হয়। অর্থাৎ স্বামীর সৎ অংশের অর্ধেক অধিকারিনী। সৎ অংশ হলো হৃদয় বুঝলে মশাই। ওটাই আমার সিন্দুকে আছে গচ্ছিত। তবে কেন তোমার প্রেমিকার ভয়ে হবো ভীত? বলে খিলখিল করে হেসে ওঠে। আমি অবাক হয়ে ভাবি বিধাতা নারীকে যত গুনে গুণান্বিতা করে পাঠিয়েছেন তার সব কটি দেখি বিশাখার মধ্যে বর্তমান। কর্মজীবনের শুরু থেকে আজ যে জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছি, ওর আত্মত্যাগ অনুপ্রেরণা কাজ করেছে। সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ওর ভাবনার ফসল। ছাব্বিশ সাতাশ বছর একসাথে ঘর করছি কখনো উত্তেজিত হতে দেখিনি। ক্রোধ হিংসা ওর ধারে কাছে ঘেষতে পারেনি। উদারতা ও মানবিকতা ওর সহজাত স্বভাব। সত্যি বলতে এমন নারীর যে স্বামী তাকে জয়িতা তো কোন ছাড় স্বয়ং যমরাজও দশবার ভাববে কেড়ে নেওয়ার কথা। মনে মনে আবেগ প্রবন হয়ে ওকে জড়িয়ে গভীর নিদ্রায় চলে যাই।