গল্প ও অণুগল্প

একটি আষাঢ়ে গল্প অথবা প্রেম পর্বের সূচনা



স্বপ্না সেন


প্রথম পর্ব - একাকী আমি

আমার নাম বিদিশা। অবনীমোহন ও লাবণ্যলেখা দাশগুপ্তর মাতৃহীনা এবং পিতা পরিত্যক্ত নাতনি। ব্যাপারটা আপাত জটিল কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু নয়। তিন মাস বয়সে মায়ের মৃত্যু হয় এবং তার মাস খানেকের মধ্যে আমার বাবা অম্লান কিশোর দাশগুপ্ত নলিনী শর্মা বলে এক পাঞ্জাবি মহিলাকে বিবাহ করেন। আমার মায়ের প্রতি তাঁর ভালোবাসা কিংবা সদ্যোজাত কন্যার প্রতি স্নেহ কোনটাই বিশেষভাবে জানা যায়নি। আমাকে তিনি কোনও আশ্রমে দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর দিদি অর্থাৎ আমার দাদুর বড় মেয়ে অনন্যময়ী মৈত্র এই প্রস্তাবটিকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছিলেন।

কিন্তু আমার কপালে অনাথ তকমাটা লাগাতে আমার দাদু ঠাকুমা রাজি ছিলেন না। সকলের অসম্মতিতে আমার সদ্য অবসরপ্রাপ্ত দাদু ও তাঁর প্রৌঢ়া স্ত্রী আমাকে লালনপালন করতে লাগলেন। বিদিশা নামটাও দাদুর দেওয়া। জীবনানন্দ দাশ দাদু ঠাকুমার খুব প্রিয় কবি ছিলেন। আমি দাদু ঠাকুমার স্নেহে, উষ্ণতায় এবং কোমল শাসনে বড়ো হয়ে উঠতে লাগলাম।

চক্রবেড়িয়া রোডের আমরা পুরনো বাসিন্দা। আমাদের বাড়িটিও পাঁচ পুরুষের পুরনো। সবাই যে যার মতো নিজের অংশে বাস করে। আমিও দাদুর অংশীদারিত্বের এলাকায় থাকি। বাবা মাকে জানার আগেই তারা আমার জীবনে অস্তিত্বহীন। মা আকাশের তারা বাবা ভিনজগতের বাসিন্দা। তাতে অবশ্য আমার কোনও আক্ষেপ ছিল না। পুরনো পাড়ায় প্রচুর চেনাজানা লোকজন, দাদু ঠাকুমার আত্মীয় স্বজন আর আমার ছেলেবেলার সঙ্গীসাথি সব নিয়ে দিব্যি ছিলাম। আমি ডায়োসেসন স্কুলে ভর্তি হলাম। দাদু আমার অভিভাবক। দক্ষিণীতে ঠাকুমা নিয়ে গেলেন ভর্তি করাতে। শুনলাম আমার মা নাকি খুব সুন্দর গান গাইতেন। আমি মেধাবী ছাত্রী ছিলাম। গানও ভালো গাইতাম। দাশগুপ্ত পরিবার বিত্তশালী না হলেও শিক্ষার অহংকার ছিল। আমিও লেখাপড়া আর গান সমান উৎসাহে ভালোবেসে চালিয়ে যেতে লাগলাম।

যতো বড়ো হলাম বুঝতে পারলাম আমার জীবন খুব মসৃণ নয়। মাথার ছাদ আর পায়ের নীচে মাটি যে কোনও মুহূর্তে সরে যেতে পারে। দাদু ঠাকুমার বয়স বাড়ছে। পিসি এবং বাবা নামক ভদ্রলোকটি এই বাড়ির উপর দাবি নিয়ে কড়া নাড়াতে শুরু করেছেন। দাদু আমাকে শেখাচ্ছেন স্পার্টান ওয়ে অব লাইফ। অর্থাৎ সব সময়ে আসন্ন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত থাকতে। যেদিন পাশে এঁদের পাব না সেদিন যেন একফোঁটা চোখের জল না ফেলে বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে বেরিয়ে সোজা রাণীদিদার বাড়ি চলে যাই - যে রাণীদিদা দাদুর সবচাইতে ছোট বোন। এই দোটানার মধ্যে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলাম ফিজিক্স নিয়ে। দাদু ঠাকুমা খুব খুশি। দু'একটা টিউশন করি। পাড়ার উচ্চমাধ্যমিকের কয়েকজন অঙ্ক, ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রি বাড়িতে বুঝতে আসে। ধীরে ধীরে বুঝি পায়ের তলায় জমি খুঁজে নিতে হবে। মাঝে মাঝে পূর্ণ সিনেমার পিছনে রাণীদিদার বাড়ি যাই। সে এক হট্টমালার দেশ। বিশাল বাড়ি। যৌথ পরিবার। সবসময়ে গমগম করছে। সবাই কৃতি। ব্যস্ত। কিন্তু কি অসম্ভব নৈকট্য বোধ তাদের মধ্যে। রাণীদিদার শ্বশুর বাড়িতে আমিও একজন হয়ে পড়লাম। আমার গান শুনতে তারা খুব ভালোবাসে। ভালো রান্না হলে আমার জন্য পাঠিয়ে দেয়। আর সে বাড়ির সবাই দাদু ঠাকুমাকে বলে আমার জন্য তারাও আছে।

এই জীবনের পর্বটা আমার কাছে বড়ো অদ্ভুত ছিল। সতেরো আঠারো বছরে প্রতি মুহূর্তে ধীরে ধীরে মনটাকে উদাসীন, প্রত্যাশাহীন করে তুলছি। ঠাকুমা, দাদু, রাণীদিদার বাড়ির সবাই আছে কিন্তু আদৌ কি থাকবে চিরদিন? তখন আমি কোথায় থাকব, কেমন হবে সেই জীবন? নিঃসন্তান স্বামীহীনা রাণীদিদা আমাকে কতদিন আগলে রাখবেন? দাদু প্রায় আশি পেরিয়ে গিয়েছেন। ঠাকুমাও বৃদ্ধা। মনের জোরে এবং সংযত খাদ্যাভ্যাস তাদের শারীরিক দিক দিয়ে সুস্থ রেখেছে। আমি বিএসসি ফাইনাল দিলাম। পরীক্ষার ফল নিয়ে চিন্তিত ছিলাম না। একুশ বছরের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি। ঠাকুমার বেথুন স্কুলের এক বন্ধুর সাথে দক্ষিণীর গানের অনুষ্ঠানে দুজনের সাক্ষাৎ হলো। সুনন্দা লাহিড়ী ঠাকুমার স্কুল কলেজের বন্ধু ছিলেন। তারপর দীর্ঘ বছর সংযোগহীন। সুনন্দা দেবী অত্যন্ত ধনী পরিবারের কন্যা এবং ততোধিক ধনী পরিবারের কর্ত্রী। পারস্পরিক আলাপ হলো এবং আমাকে তিনি তাঁর নাতি ধ্রুবর জন্য মনোনীত করলেন। দাদু ঠাকুমা রাজী ছিলেন না। বিশাল ধনী পরিবারের অত্যন্ত সুদর্শন বুদ্ধিমান মেধাবী উজ্জ্বল সুপ্রতিষ্ঠিত ছেলের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে তাঁরা ভয় পাচ্ছিলেন। বারবার বলছিলেন তাঁদের নাতনীটি বড়োই দুঃখী। অসম বিবাহ দিয়ে তার আরও দুঃখের কারণ তাঁরা হতে চান না। তার চেয়ে তাঁরা চান নাতনী প্রতিষ্ঠিত হোক অর্থনৈতিক ভাবে। কিন্তু কিছুই হলো না। ফাল্গুন মাসে চক্রবেড়িয়া থেকে হিন্দুস্তান রোডের সুবিশাল প্রাসাদে আমি চলে এলাম। জীবনের প্রথম অধ্যায় শেষ।

দ্বিতীয় পর্ব - যে ছিল আমার স্বপনচারিণী

আমি ধ্রুব। ধীমান লাহিড়ী ও বাসবদত্তা লাহিড়ীর একমাত্র ছেলে। দাদু জীমূতনারায়ণ ও ঠাকুমা সুনন্দা লাহিড়ী। জলপাইগুড়ি থেকে দাদুর বাবা চলে এসেছিলেন কলকাতায়। পারিবারিক ভাবে মূলতঃ আমাদের পূর্বপুরুষদের পেশা ছিল ওকালতি। ওকালতি ব্যবসায়ে লাহিড়ী পরিবারের সকলেরই সুনাম ছিল। সেই সঙ্গে ছিল তীব্র বৈষয়িক বুদ্ধি। তাঁরা উপার্জন করেছেন, সৎপথে সম্মানের সঙ্গে বিষয় আশয় বাড়িয়েছেন, উচ্ছৃঙ্খল বা ভোগী ছিলেন না। জলপাইগুড়ি সংলগ্ন অঞ্চলে প্রচুর জমি এবং চা বাগান নিয়ে তাঁদের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। দাদুর বাবা রাজনারায়ণ লাহিড়ী ওকালতি ব্যবসা করতে আসেন কলকাতায়। তাঁর ভাগ্য ছিল সুপ্রসন্ন। অচিরেই বিখ্যাত ক্রিমিনাল আইনজীবী হয়ে উঠলেন। বিবাহ করলেন আর এক প্রতিপত্তিশালী পরিবারের একমাত্র কন্যাকে। নিজের উপার্জন, পৈতৃক সম্পত্তির অংশ এবং শ্বশুর বাড়ির অগাধ সম্পত্তি সব কিছু নিয়ে তখন তিনি কলকাতার অন্যতম ধনী। তিনি বাড়ি করেছিলেন ভবানীপুরে। সুবিশাল প্রাসাদ বলা চলে। আমার দাদু প্রথম, যিনি ওকালতি ব্যবসা থেকে সরে এসে ডাক্তারি পড়তে ঢোকেন। চিকিৎসক হিসাবে তাঁর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ভবানীপুরের পৈতৃক বাড়ির অংশ বড়ো দুই ভাইকে ছেড়ে দিয়ে হিন্দুস্তান রোডে মনের মতো করে বাড়ি তৈরি করেন। আমার ঠাকুমা অত্যন্ত রুচিশীল ছিলেন। ফলে তাঁর হাতে পড়ে বাড়ি, বাগান সবকিছু বড়ো সুন্দর হয়ে উঠল। উগ্রতা, অর্থের দম্ভ ছিল না। ভারি ভালো খোলামেলা আনন্দময় একটা আবহাওয়া গড়ে উঠেছিল।

আমার বাবা ধীমান লাহিড়ী কিন্তু উকিল বা ডাক্তার কোনটাই হননি।তিনি শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাশ করে মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসে যোগ দেন। বিয়ে করেন লক্ষৌয়ের আর্মি অফিসারের কন্যা বাসবদত্তা মিত্রকে। অসম্ভব সুন্দরী এবং প্রাণোচ্ছল ছিলেন আমার মা। এই বিবাহ দাদু ঠাকুমার মনোমত না হলেও তাঁরা আপত্তি করেন নি। কারণ আপত্তি করেও কোনও লাভ হতো না। কাজেই ধূমধাম করেই বিয়ের অনুষ্ঠান হল। তবে আমার মামার বাড়ির ধরনধারণ মাত্রা ছাড়া বাঁধনহীন আধুনিক ছিল। মদ্যপান বা উচ্ছল জীবনযাত্রায় তাঁদের কোনও আপত্তি ছিল না। আমার মাও এই জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন। কালক্রমে বাবাও তাঁর এতদিনের গড়ে ওঠা জীবনবোধকে বিসর্জন দিয়ে মদ্যপান এবং বিভিন্ন ধরনের পার্টিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেন। কলকাতায় তাঁদের আসা হত না কারণ কলকাতায় আমার মায়ের পরিচিত কোনও প্রিয়জন ছিল না। আমি যখন হলাম খবরটা বাবা ফোন করে দাদুকে জানিয়ে ছিলেন। আকস্মিক এই খবরে দাদু ঠাকুমা হয়তো খুবই দুঃখিত হয়েছিলেন। কিন্তু কি আর করা যাবে। বাবা মা তখন চণ্ডীগড়ে। দাদু ঠাকুমা ওখানে গেলেন। দেখলেন আমি দুজন আয়ার তত্ত্বাবধানে রয়েছি। সদ্যোজাত শিশু সন্তানকে রেখে আমার মা তখন বান্ধবীদের সাথে তাস খেলছেন।

সন্ধ্যেবেলা বাবা আসলেন। দাদু ঠাকুমা খুব খুশি হয়ে মাকে সোনার হার পরিয়ে দিলেন এবং জানালেন চণ্ডীগড়ে যেমন ঠাণ্ডা, তেমনই গরম। তাদের যদি সম্মতি থাকে তাহলে মাসখানেক পরে আমাকে তাঁরা কলকাতায় নিয়ে যেতে পারেন। আমার বাবা কিছু বলার আগেই আমার মা সোৎসাহে রাজী হন। এই প্রথম সম্ভবত শ্বশুর শাশুড়ির প্রতি তিনি প্রসন্ন হন।

প্রায় দুমাস বয়সে আমি কলকাতায় আসি। আমার অন্নপ্রাশনে বাবা এসেছিলেন। মা নয়। তিনি গরমে বন্ধুদের সাথে সিমলা বেড়াতে গিয়েছিলেন। দাদু আমার নাম রাখলেন ধ্রুব। বাবাকে দাদু বললেন নিশ্চিন্ত থাকতে। আমার কোনও অযত্ন হবে না। বাবা কিছু বলেন নি। আমি দাদু ঠাকুমার সান্নিধ্যে বড়ো হতে লাগলাম। অগণিত আত্মীয়স্বজন। জলপাইগুড়িতেও এক বিশাল পরিবার। সবমিলিয়ে জমজমাট জীবন। দাদু অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে আমার রক্তে পরিবারতন্ত্র ঢুকিয়ে দিতে লাগলেন। বাবা মাঝে মাঝেই তিনচার দিনের জন্য চলে আসতেন। ফলে বাবার সঙ্গে আমার একটা সখ্যতা গড়ে উঠলো।

আমিও কানপুর আইআইটি থেকে পাশ করলাম। তারপর রাউরকেল্লায় কেন্দ্রীয় সরকারে যোগ দিলাম। বিদেশে আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম, বহুজাতিক সংস্থায় প্রচুর অর্থের কাজের আহ্বান ছিল। কিন্তু আমি একটু অন্তর্মুখী, পরিবারকেন্দ্রিক। গোষ্ঠীপ্রীতি আমার মধ্যে ভালোরকম শিকড় গেড়ে বসেছে। আমাদের পরিবারে এই যে বৃহৎ গোষ্ঠী, তাদের মধ্যে সহমর্মিতা ব্যাপারটা খুব তীব্র। যাদের অসুবিধা আছে তাদের তারা টেনে তোলার চেষ্টা করে। কতো দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়, সহায় সম্বলহীন, দিব্যি সম্মানের সাথে আমাদের পরিবারে থেকে যাচ্ছেন। আমরাও তাদের নিজেদের একজন ভাবি। আমাদের বাড়িতেও আছে শশীকাকা, দাদুর এক বহু দূরসম্পর্কের বোনের ছেলে। ছোটবেলায় মায়ের সাথে চলে এসেছিল। আমার দাদু ঠাকুমার ডানহাত শশীকাকা আর তার স্ত্রী বীণাকাকিমা।

অবসরের বছর দুয়েক আগে বাবা কলকাতায় বদলি হলেন। সুদীর্ঘকাল পরে বাড়িতে এসে উঠলেন। তার থেকেও বড়ো কথা সঙ্গে মা ছিলেন এবং তাঁর মা ও ভাই। অর্থাৎ আমার দিদিমা ও মামা। তাদের ব্যাপারে বাবা আমাদের জানালেন যে এরা এখন বাবার দায়িত্ব। শ্বশুর মশাই মারা গিয়েছেন। তার টাকাপয়সা মা ছেলে মিলে উড়িয়ে দিয়েছে। কোথাও বিশেষ কিছু নেই মায়ের পেনশন ছাড়া। আলাদা করে বাড়ি ভাড়া করে রাখা যায়, কিন্তু এদের শালীনতা ও সম্ভ্রম বোধ নেই বললেই চলে। মদ্যপান এবং বাজারে ধার করা কোনটাতেই এদের আপত্তি নেই। আমার মা এখন কিছুটা স্তিমিত। বাবা শক্ত হাতে হাল ধরেছেন অবশেষে। আমাদের বাড়িতে এত লোক তাদের মাঝে তারাও থেকে গেলেন। মা একটু মুষড়ে পড়েছিলেন যখন জানতে পারলেন যে দাদুর যা কিছু তার উত্তরাধিকারী আমি এবং আমার বাবাই সেই পরামর্শ দিয়েছিলেন। তানাহলে লাহিড়ী বাড়ির আর কোনও অস্তিত্বই থাকবে না।

এরই মাঝে বিদিশা দাশগুপ্তর সাথে আমার বিয়ের কথা উঠল। ঠাকুমা আমাকে বিদিশাদের পরিবারের সম্পর্কে সব কিছুই জানালেন। কিন্তু আমাদের পরিবারের কথা বিদিশাকে আমি কিছুই জানানোর সুযোগ পেলাম না। ফাল্গুন মাসে বিদিশার সাথে আমার বিয়ে হলো। এবার অন্য এক জীবনের অধ্যায় শুরু হল।

শেষের পর্ব - একই লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ প্রাণেশ হে

বিদিশাকে সম্প্রদান করলেন বিদিশার দাদু শ্রী অবনীমোহন দাশগুপ্ত। লাল টুকটুকে বেনারসী। ফুলে চন্দনে স্বর্ণালঙ্কারে, কাজলে কুমকুমে, বিদিশাকে নিজের হাতে সাজিয়ে দিয়েছেন তার ঠাকুমা শ্রীমতী লাবণ্যলেখা দাশগুপ্ত। খুব ছিমছাম হাসিখুশি পরিবেশ। আনন্দ মুখর কিন্তু আতিশয্য বিহীন। আমার কেন জানিনা মনটা প্রসন্ন হয়ে উঠল। বিয়ে শেষ হলো। রেজিস্ট্রি হলো। বাবা উজ্জ্বল মুখে আমার কাঁধে হাত রেখে অ-বাবাজনোচিত প্রশ্ন করলেন। ফিসফিস করে - কি কেমন লাগছে? আমি হেসে ফেললাম।

এরপরের সুখস্মৃতি বাসরঘর। ঘরে অনেকে হাস্যপরিহাসে মগ্ন। আমাদের নিয়ে আজ ফাল্গুনী রাতে গান বাজনা হবে। বিদিশার দাদু নাতনীর বাসরঘরে এস্রাজ নিয়ে বসলেন। স্ত্রী কে বললেন - চলো লাবু, আমরা একটু নাতজামাইকে গান বাজনা শোনাই। সবাই হৈ হৈ করে উঠলো আনন্দে উচ্ছ্বাসে। দাদু এস্রাজে ছড় টানলেন। ঠাকুমা গাইলেন - "ওহে সুন্দর মম গৃহে আজি পরমোৎসব রাতি"। আমি আবিষ্ট হয়ে গেলাম। বিদিশা ঠাকুমা আর দাদুর মাঝে বসে আছে। মাঝে মাঝে উঁকি মেরে আমাকে দেখছে। মেধাবী ছাত্রীটির চোখে মুখে কিশোরীসুলভ নিষ্পাপ লাবণ্য।

অবশেষে অনেক গানগল্পের শেষে সবাই বলে উঠলো - এবার ভুতুম গান করবে। নামটি আমার চিত্তহরণ করে ফেলল মুহূর্তেই। আমি তখন বুঝলাম নবপরিণীতা বধূটির নাম ভুতুম। মৃদুস্বরে বললাম - ভুতুম একটা গান শোনাও। ভুতুম অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নামিয়ে ফেলল। ঠাকুমা মিটিমিটি হেসে বললেন - ভুতুমের গান শুনবে? দিদিভাই শুনিয়ে দাও তো। ভুতুম গান ধরল - "কে আবার বাজায় বাঁশি এ ভাঙ্গা কুঞ্জবনে" সঙ্গে দাদুর এস্রাজের সঙ্গত। আমি চূপ করে মনপ্রাণ দিয়ে সেই গানের মায়ায় নিজেকে জড়িয়ে ফেললাম। এরপর বাসর শেষ। আমি একটা ছোট্ট পরিপাটি ঘরে ঘুমাতে গেলাম। ভুতুমকে নিয়ে গেলেন ঠাকুমা। হেসে বললেন - নিয়ে গেলাম, বুঝলে? আমিও হাসলাম।

পরের দিন ভুতুমকে নিয়ে যাওয়া হবে আমাদের বাড়িতে। বাবা, পিসেমশাই আর এক কাকা এসেছেন। ভুতুম যাওয়ার সময়ে ঠাকুমাকে জড়িয়ে মুখ গুঁজে থাকল। দাদু নাতনীর পিঠে হাত বোলাচ্ছেন। সবাই চুপচাপ। আমি হঠাৎ দাদু ঠাকুমাকে বললাম - আপনারাও চলুন। ভুতুমের ভালো লাগবে। ঠাকুমার চোখে জল কিন্তু মুখে হাসি। আমার গালে হাত ছুঁইয়ে বললেন - তুমি আছ তো, আমার দিদিভাই ভালো থাকবে।

ভুতুম আমাদের বাড়ি এলো। সবাই ভুতুমকে নিয়ে আনন্দে মেতে গেল। ভুতুমের যাতে অসুবিধা না হয় তার জন্য বীণাকাকিমা ভুতুমের কাছে থাকল। এভাবেই কেটে গেল প্রায় দুটো দিন। আমাদের বৌভাতের অনুষ্ঠানও মিটে গেল। ভুতুম আর আমি এখন আমাদের ঘরে। ফুলের গন্ধে ঘর মাতোয়ারা। আমি ভুতুমকে কি বলব ভাবতে ভাবতে বললাম - "তোমাকে আমাদের বাড়ির গল্প জানাই কেমন"? ভুতুম মাথা নাড়ল। আমি আমার সাতাশ বছরের জীবন, আমার বাড়ি, মা বাবা ইত্যাদি আমাদের পরিবার, সবকিছু অকুন্ঠ চিত্তে ওর কাছে বলতে লাগলাম। মনে হল আমি এমন একজনকে পেলাম যার কাছে নিঃসংশয়ে সব কিছু বলা যায়। ভুতুমও বলল ওর কথা। ওর দুঃখ, আনন্দ, অনিশ্চয়তা, শখ, আকাঙ্ক্ষা, দাদু-ঠাকুমার গল্প। কতটা সময় যে পার হয়ে গেল। আমি তখন ভুতুমকে বললাম - "এবার শুধু আমার জন্য একটা গান গাও"। ভুতুম গাইল- "আজি তোমায় আবার চাই শোনাবারে যে কথা শুনায়েছি বারে বারে"।

রাত প্রায় শেষের মুখে। আমি ভুতুমকে বললাম এবার একটু ঘুমাও। এক্ষুণি ভোর হয়ে যাবে। মনে মনে বললাম তোমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে পারি। কুসুমবনে পথ হারাতে পারি। সুখে দুঃখে দায়িত্ব বেদনায় দিন কাটাতে পারি। এমনকি শেষ জীবনে তোমার হাত ধরে চাঁদের আলোর দেশেও চলে যেতে পারি। ভুতুমেরও ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিলো। তারই মাঝে এক দীঘি টলটলে ভালোবাসা নিয়ে বলল - "চাঁপা ফুলের গন্ধ খুব ভালো লাগে - কাঁঠালিচাঁপা, স্বর্ণচাঁপা, মুচকুন্দ, গোলঞ্চ..." ভুতুমের ঘুম চলে এলো।

।। অয়মারম্ভ শুভায় ভবতু ।।