প্রবন্ধ

তুমি কৈকেয়ী [পুস্তক আলোচনা] (ষষ্ঠ পর্ব)



কাকলী দেব


।। ৬ ।।

তোমার দিন কাটছে ধীর গতিতে, কেকয়ার দিন গুলোর কথা স্মরণ করে! তোমার সমস্ত খেলার, মনের কথা বলার সঙ্গী যুধাজিত আর নেই তোমার কাছে! এখানে নেই তোমার তরোয়াল চালনা, ঘোড়সওয়ারীর অভ্যাস! বাতাসের বুক চিরে তোমার প্রিয় ঘোড়ার পিঠে চেপে প্রত্যন্ত প্রান্তরে ছুটে চলা! তোমার কাছে এগুলোই ছিল, প্রাসাদের অভ্যন্তরীণ একঘেয়ে জীবন থেকে মুক্তি!

এখানেও সকালবেলায়, কৌশল্যা আর সুমিত্রার সঙ্গে প্রাসাদের উদ্যানে নিয়ম মাফিক প্রাত্যহিক ভ্রমণ, তারপর ফিরে এসে কিছু গ্রন্থ পাঠ, এরপর তোমার হাতে অঢেল সময়! অলসভাবে সময় কাটানো তোমার বরদাস্ত হয়না।

মন্থরারও এখানে কাজ কম, তাই একদিন মন্থরা বলে, "চল, তোমাকে এখানকার বাজার দেখিয়ে আনি, একটু বৈচিত্র্য হলে তোমার মন ভাল লাগবে।"

একদিন সকালে, বেলার দিকে, সাধারণ কাপড় পরে ঘোমটায় মুখ ঢেকে, প্রাসাদের পেছনের দরজা দিয়ে চুপচাপ তারা পথে বেরিয়ে পড়ে। কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে পৌঁছায় বাজার অঞ্চলে, সেখানে থরে থরে বিবিধ পণ্য নিয়ে বসে আছে কত লোক! এমনকি গ্রাম্য নারীরাও তাদের পশরা সাজিয়ে বসেছে। এখানে এত ভিড় আর কোলাহল সত্ত্বেও তোমার ভাল লাগছে! চারিদিক খুব জীবন্ত মনে হচ্ছে! সকাল বেলার রোদে চারিপাশ কত উজ্জ্বল! প্রাসাদের ভেতরের শীতল পরিবেশ, লোকজনের কৃত্রিম কথাবার্তার মধ্যে তোমার তেমন কিছুই করার থাকেনা!

রাজা দশরথের অনেক কাজ, দিনের বেলায় তিনি সভাসদ ও মন্ত্রীদের সঙ্গে রাজ্য পরিচালনার কাজে ব্যস্ত থাকেন। এখানে এসে জানতে পেরেছ, তোমরা তিনজন তার প্রধানা মহিষী হলেও, তার আরও অনেক রাণী আছে। মন্থরার কাছে শুনেছো সেকথা, এমনকি সেও জানেনা সঠিক সংখ্যার কথা! কাজেই রাজার দেখা রোজ রাতে মেলেনা। তবে কিনা তিনি তোমাকে বিশেষ সুনজরে দেখেন বলেই তোমার মনে হয়, তাই মাঝে মাঝেই রাতে তার ঘরে তোমার তলব পড়ে। অভিজ্ঞ দশরথ তোমাকে শরীরী ভালবাসায় ভরিয়ে দেন! তারপর তোমার মনকেও স্পর্শ করতে চান। রাত ভোর হয়ে যায়, তোমাদের কথা ফুরোয়না। তিনি ও তার জীবন দর্শন, অযোধ্যা নগরীকে নিয়ে তার স্বপ্নের কথা বলেন। তিনি প্রায়ই বলেন, "জানো কৈকেয়ী, তোমার সঙ্গে কথা বলতে খুব ভাল লাগে, মনটা হালকা হয়! এরকম আর কারো সাথে হয়না।"

এরকমই একদিন হঠাৎই বললেন, "আমাকে যুদ্ধে যেতে হবে কৈকেয়ী, কিছুদিন আর তোমার সাথে দেখা হবেনা।"

তুমি, জানতে চাইলে সব বিস্তারিত ভাবে, কোথায় আর কার সাথে হবে এই যুদ্ধ?

রাজা বললেন, শম্বাসুরের কথা, "দেবরাজ ইন্দ্র আমাকে অনুরোধ করেছেন, শম্বাসুরকে যুদ্ধে পরাজিত করতেই হবে, স্বর্গের দেবতাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে এই অসুর, সবাইকে পরাস্ত করে তাদের পদানত করতে চাইছে। এমনকি ইন্দ্রকেও যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছে।"

"রাজা, আমি তোমার সঙ্গে যুদ্ধে যেতে চাই। আমি তোমার পাশে থাকতে চাই, তুমি আমাকে একবার সুযোগ দিয়ে দেখো, আমি নিশ্চিত, তোমার তাতে কোনও ক্ষতি তো হবেই না, উল্টে লাভও হতে পারে।" তোমার করুণ মিনতি শোনা গেল! বারংবার বারণ করেও যখন কোনও লাভ হলনা, তখন তোমার অনুরোধে সায় দিতে বাধ্য হলেন দশরথ!

তোমার মনে আনন্দ আর ধরেনা! একবার কি তুমি সুযোগ পাবেনা, যুদ্ধ ক্ষেত্রে তীব্র বেগে ঘোড়া চালিয়ে, তোমার তরোয়ালের আঘাতে শত্রুকে প্রতিহত করার?

এরপর সাজো সাজো রব উঠল, প্রাসাদের কোণে কোণে! কৌশল্যা আর সুমিত্রার অবাক হবার পালা, এই কথা ভেবে যে, কেন কোনও রাজরমনী যুদ্ধ ক্ষেত্রে যেতে চায়?

প্রাসাদের বিলাসিতার মাঝখানে কাটানো রমনীর কি যুদ্ধে যাওয়া সাজে? মন্থরার বদলে, রাজার পরামর্শে, কৌশল্যার বিশ্বস্ত দাসী 'আশা' কে সঙ্গে নিতে হল! কারণ তার যুদ্ধ ক্ষেত্রে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে।

রাজপুরোহিতরা এলেন, যাত্রা আরম্ভ করার আগে তাদের আশীর্বাদ নেওয়া খুব প্রয়োজন! তুমি বুঝতে পারোনা, মানুষ যখন নিজের জোরেই সবকিছু করছে, যুদ্ধের জন্য যে সাহস, পরিশ্রম দরকার সব কিছুই তার আছে, তাহলে এই লোক দেখানো পূজা অর্চনা বা আশীর্বাদের ভূমিকা কতটুকু?

মন্থরা আবার কোথা থেকে খবর নিয়ে এল, রাজা নাকি তার রথের বর্তমান সারথিকে নিয়ে খুশি নন। তুমি ওমনি মন্থরা কে বলে ওঠ, "তোমার কি মনে হয়, রাজা কি আমাকে তার রথ চালাতে দেবে?" মন্থরা বলে, "রাজাকে যদি রাজী করাতে পারো, তাহলে দিতেও পারেন। তোমার রথ চালানো দেখলে যে কোনও বড় যোদ্ধাই তোমাকে চাইবে। "তুমি মনশ্চক্ষে কল্পনা করলে, রাজা দশরথের রথের ঘোড়ার লাগাম ধরে রথ ছুটিয়ে চলেছ তুমি!

এর এক সপ্তাহ পরেই তোমরা রওনা হলে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে।

চারিদিক ঘিরে পাহাড়ের সারি, মাঝখানের বিস্তীর্ণ রুক্ষ মেটে প্রান্তর, দুজন মহাযোদ্ধার রণভূমি হবে এটা কাল থেকে। রাজ পরিবারে জন্মেছ তুমি, যুদ্ধ তোমার রক্তের মধ্যে, কিন্ত তবু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমার মনে প্রশ্ন জাগে, কেন এই যুদ্ধ, এর পরিনাম তো যুদ্ধরত কোন পক্ষের জন্যই ভাল হয়না! এতদিনে তুমি যত পুঁথি পড়েছ, সেখানেও যুদ্ধকে নিন্দনীয় বলা হয়েছে! মানুষ নিজেদের মধ্যে আর কতদিন এই অর্থহীন হানাহানি করবে?

(ক্রমশ)

গ্রন্থের নামঃ কৈকেয়ী (Kaikeyi: A Novel)
লেখিকাঃ বৈষ্ণবী প্যাটেল (Vaishnavi Patel)
ভাষাঃ ইংরাজী
প্রকাশকঃ রেডহুক (Redhook)
বাঁধাইঃ পেপারব্যাক
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৫১২ পাতা
মুদ্রিত মূল্য (ভারতীয় মুদ্রায়): ১,৭৩৪ টাকা