প্রবন্ধ

অথৈঃ কালোত্তীর্ণ আয়নার সামনে যখন আমরা



অভিজিৎ রায়


আমি তখন নবম শ্রেণি... এইটুকু পড়ে আপনারা নিশ্চয় ভাবতে শুরু করেছেন আমি কোনও বিখ্যাত কবিতার আলোচনায় ঢুকছি অথবা লিখতে চলেছি নতুন কিছু পুরনো থেকে টুকে। না, সেরকম আদৌ নয় ব্যাপারটা। ক্লাস নাইনে পড়তে পড়তে ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে 'লজিক' অর্থাৎ যুক্তি বিদ্যা নিয়েছিলাম নম্বর বেশি উঠবে জেনে। আর সেখানে প্রথম শেখা পাঠের অন্যতম ছিল মানুষ = জীববৃত্তি + বুদ্ধিবৃত্তি।

জীববৃত্তি শব্দটিকে সহজ করে বোঝাতে অনেক সময় অনেকেই পশুত্ব শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন। বুদ্ধি দিয়ে আমরা যতই আমাদের সেই পশুত্বকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করি না কেন পশুর সঙ্গে থাকতে থাকতে অথবা লড়াই করতে করতে অনেক বুদ্ধিমান মানুষই পশু হবার লড়াইয়ে নেমে পড়ে। কখনও বাধ্য হয়ে, কখনও আত্ম-অহংকার বজায় রাখতে পশুর মতন হয়ে পড়ে।

আসলে তাহলে মানুষ কী? বুদ্ধিমান জীব নাকি হিংস্রতম পশু? নাকি আমরা এও বলতে পারি মানুষ এই সমাজের হিংস্রতম পশু যে কিনা বুদ্ধি দিয়ে তার হিংস্রতা ঢেকে সভ্য হয়ে থাকার ভান করে!

প্রত্যাশা, অধিকারবোধ, ভালবাসা, ঘৃণা - এই আবেগ ও অনুভবগুলোই মানুষকে কখনও পশু বানিয়ে দেয়, তখন মনে হয় মানুষের মধ্যেকার এই পশুত্বই সত্য বাকি সব মিথ্যা। মিথ্যার আড়ালেই প্রত্যেক মানুষের জীবন ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায় অথবা প্রতিটি মানুষ মিথ্যার আড়ালেই নিজের জীবনকে নিয়ে যায় মৃত্যুর গন্তব্যে। এর মধ্যে লোভ, লালসা, নিরাপত্তাবোধ অথবা নিরাপত্তাহীনতা একইরকমভাবে নিজেদের জাল বিস্তার করে প্রতিটি মুহূর্তে এবং প্রতিটি মুহূর্তে তারা নিজেদের অবস্থান বদল করে। ভালবাসা থেকে ঘৃণায় পৌঁছাতে যে কোনও বুদ্ধিমান মানুষের প্রয়োজন মাত্র কয়েক মিলিসেকেন্ড আবার যৌনতার সুখ যা কিনা পশুত্বেরই অংশ থেকে ভালবাসার অনুভবে পৌঁছাতে মানুষের সময় লাগে খুবই কম।

মুহূর্তের এইসব খেলা কখনোই মানুষকে অনন্তের দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে পারে না। প্রতিটি মুহূর্তে মানুষের এই বদল খুব স্বাভাবিক এবং সরল সমীকরণ মেনে চলে। এই তত্ত্ব মেনে নিতে পারলে জীবনযাত্রা সহজ ও স্বাভাবিক, নয়তো ভীষণরকম জটিল হতে বাধ্য। কিন্তু এতসব তত্ত্ব জানা সহজ হলেও তাকে জীবনে মেনে চলা কঠিন। দ্বন্দ্ব ও দ্বিধার ঘাত প্রতিঘাতে আমরা নিজেদেরকে নিজেরাই পরাজয়ের সহজ রাস্তায় নিয়ে যাই। হ্যাঁ, প্রত্যেকেই। কারণ সেই রাস্তা সহজ এবং তার যৌক্তিক সমীকরণ খুবই সরল। আমরা সন্দেহের বিষে ভালবাসার পাত্র অথবা পাত্রীকে খুন করতেও দ্বিধাবোধ করি না মুহূর্তের প্ররোচনায়। সমাজের কাছে মুহূর্তে আমরা প্রতারক বা প্রবঞ্চকের উপাধি নিয়ে ক্ষুব্ধ হই অথবা হতাশায় ডুবে যাই। শেষ অবধি জয়ী ব্যক্তিও পরাজিত ব্যক্তির মতো আত্মঘাতী হয়।

অথৈ, অনঘ বা দিয়ার চরিত্র দিয়ে বিচার বিবেচনার সময় কিন্তু দু'ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট। জীবনের বাকি সময়টা হল থেকে ঘরে ফিরে নিজেদের নিয়ে কাটাছেঁড়া করার জন্য রইল। এই অস্থির সময়ে এমন একটা চলচ্চিত্র খুব প্রয়োজন ছিল টলিউডের। অযোগ্যর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নিজেকে যোগ্য প্রমাণের দায় নেই অনন্তের। প্রায় চারশো বছরের কালোত্তীর্ণ গল্প যখন নতুন করে আমাদের ভাল লাগে তখন বুঝতে হবে শাশ্বত সত্য এটাই যে মানুষ = জীববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি হলেও তার জীববৃত্তি বা পশুত্বই আমাদের নিয়তি রচনা করে চলে যুগে যুগে।