বিবিধ

খাল-বিলের আখ্যান (একাদশ পর্ব)



মমতা বিশ্বাস


চাকদা স্টেশনে যত মানুষ নামল; উঠল তার তিনগুণ। ভালো ভাবে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে সবাই। হৈচৈ, ঠেলাঠেলিতে কুন্তীর পাগলাখালি মানস ভ্রমণে ছেদ পড়লো। তিনজনের সিটে চারজন বসতে হল। কুন্তীর পাশে এসে বসেছিল একজন বয়ষ্ক মহিলা। বোষ্টমীর পাশে বসা যুবতীর কানে হেড ফোন। কথা বলছে ঘনিষ্ঠ কোনো মানুষের সঙ্গে। সকালবেলায় মেক-আপ করেছে। কুর্তি-প্লাজোর উপর সোয়েটার পরেছে। বাঁ-হাতে ঘড়ি, ডান হাতে পলা। চুলে ঢাকা সিঁদুরের বিন্দু উঁকি মারছে। পায়ের উপর পা তুলে নাচিয়ে নাচিয়ে কথা বলছে। ওরা দু’জন কালী নারায়ণপুর স্টেশন থেকে গেদে লোকাল ধরে। বসার জায়গাটা পেয়ে যায়। জানালার ধারে চারজন মুখোমুখি বসে আছে।

বয়ষ্ক মহিলাটি বলে উঠল, "কী গো মা-গোঁসাই শরীল ভালো তো?”

“হ্যাঁ গো মা ভালো আছি। তোমারে অনেকদিন পর দেখলাম। সব ভালো তো?”

“ভালো আর থাকি কী করে? অনেক টাকা-পয়সা খরচ করেও মেজো মেয়েটাকে বাঁচাতে পারলাম না। মেয়ের শোকে কাহিল হয়ে পড়েছি।”

ওদের কথাবার্তা শুনে প্রশ্ন ছুড়ে দিল কুন্তী, "তোমরা কি প্রতিদিন এই ট্রেনে যাও?”

বৈষ্ণবী বলে, “আমি শনিবার আর রবিবার যায়। ওরা দুইজন রোজ যায়। এই ভোরের টেন ধরে যায়; আসি সন্দের টেনে। বাড়ি ফিরতি রাত হয়। আমার গুসাইও যায়। পরের বগিতি রয়েচে।”

“তোমার বাড়ি কোথায়? বিলপাড়ায়।”

“বিলের ধারের পাড়া বুঝি? নাম কী?” কুন্তি বলে।

“দোবিল। জলটল নেই। চাষ হয়। বর্ষায় বিষ্টি হলে ডোঙা চলে। মাছ হয়, কিন্তু আগের মতো না। এই দুই বচর জল নেই।”

"সপ্তাহের আর পাঁচদিন ভিক্ষেয় বেরোও না?”

“শরীর ভালো থাকলি দুইদিন রেলবাজারে ভিক্ষে করি। একদিন শিবনিবাসে আর একদিন চলে যায় পাগলাখালি। একদিন বেরোয়নে। জিড়োনের তো দরকার।”

“ধকল তো ভালোয় হয়?”

“তা তো হয়। জিনিসির যা দাম বেড়েচে। খায়ে-পরে বাচে থাকতি তো হবে। আগে গুসাই বিলির মাছ ধরে সংসার চালাত। খাল-বিলি জল নেই। মাটের কাজে খাটনি বেশি। গুসাই কাজে কুমা। মুনিষ- পাটে কেউ নিতো না; তাই এই পথে আসা। কলকাতায় আসার দুইদিন খাটনি বেশি হয়। রাত তিনডেয় উটি। বাসীকাপড় ছাইড়ে , ঠাকুর সিবা দিয়ে টোটো ধরি। অনেক রাস্তা। একঘণ্টা লাগে যায়। রাতে শুয়ার আগে সব গুছিয়ে রাকি । ভোরে বেড়িয়ে পড়ি। সারাদিন খাবার -দাবারের অভাব হয় না। দোকানদাররা চিড়ে, মুড়ি, বিস্কুট, ছাতু দেয়। বিহারী চাওয়ালা এত্ত বড়ো এক গিলাস দুধ চা দেয়।”

কুন্তী বলে, “সপ্তাহে দুইদিন কলকাতায় আসো, রোজগার ভালোই হয়?”

“তা হয়। ওই যে জটাবুড়িরা হিংসে করে। টাকা-পয়সা বের করে গুনতি পর্যন্ত পারিনে”। ওরা কয় , আমার রুপি ভুলে সবাই বেশি টাকা দেয়! দেয় তো, দেয়। তাতে তোগের কী! এই রুপীর জন্যি বিপদ কী কোম? প্রথমে কলকাতায় আইসে এক মাসির পিচনে পিচনে ঘুরতাম। পনেরো বছরে অনেক চালাক হয়েচি। এখন আর কেউ বিপদে ফেলতি পারবে না। কথার মারপ্যাঁচ শিখে ফেলেছি। মুক নাড়লি বুঝতি পারি কী বলতি চাচ্চে।”

“তুমি এক কামরায়, গোঁসাই অন্য কামরায় - কেন?”

“পনেরো বছর ধরে যাওয়া-আসা করচি। তকন বয়স কম ছিল। নানান জনে নানান কথা বলত। শুনা যায় না; তাই লেডিসে উঠি। ভিড় কম। আরামে যাওয়া-আসা যায়। ভিক্কেও আমরা আলাদা আলাদা দুকানে যায়। আমি রাস্তার ধারের দুকানে যায়। গুসাই চার/ পাঁচ তলায় যায়ে ভিক্কে করে। আমার চাইতে বেশি টাকা হয়। মেয়ে মানুষ না, উপরে যাতি ভয় করে। গুসাই ও মানা করেচে। দরজা বন্দ ঘরে ঢুকে বিপদে পড়ব নাকি?”

“মেয়ে মানুষির পদে পদে ভয় । আমি কিন্তু চার/ পাঁচ তলা পর্যন্ত কাকে করে সিমেণ্ট তুলি। একসঙ্গে অনেক মানুষ কাজ করে। ভয় কম। রঙের কাজে খাটনি কম; টাকা বেশি। ২৯ বছর এক মালিকের কাজ করছি। আগে ভয় করত। এখন তো বয়স হয়েছে। সবাই মামী মামী করে। কেউ খারাপ চোকে দেখে না।”- বলে বয়ষ্ক মহিলা। নাম বলল শিখা। ছোটো-বড়ো সকলের শিখা মামি হয়ে গেছে।

“রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ের কাজ খুব পরিশ্রমের... এই কাজে এলে কেন? অন্য কাজ করতে পারতে?”

“অন্য কাজে পাঁচ জনের পেটের ভাত ,পরনের কাপড় জুটত না। পাড়ার এক দিদি রাজমিস্ত্রীর লেবারের কাজ করত। সেই আমাকে এই কাজে নিয়ে আসে। প্রথমদিন সোদপুর ইস্টিশনে লেবারদের দলে বসিয়ে রেখে চলে গেল। এতদূর কোনোদিন আসিনি। ভয় করতি লাগল। কানচি আর ঠাকুরকে ডাকচি। একজন হিন্দী - বাংলা মিশিয়ে বলল লেবারের কাজ করব কিনা? কী কাজ না বুঝেই হ্যাঁ বলে দিলাম। মাথায় করে ইট তুলতি হবে চার তলায় । মাথায় ব্যারাম। কাঁখে করে তুললাম। প্রথমদিন ২৫ টাকা পাই। চাল, তেল, তরি-তরকারি কিনে ঘরে ফিরে বুঝলাম ছেলেমেয়েরা না খেয়ে মরবে না। বিটা আমার মাছ ধরার জাল বুনতো। আটল রাবানি পোলো বানাতো। নুন ভাতের অভাব হত না। কঠিন ব্যাধিতে পড়ল। গরীব মানুষ। ভালো চিকিৎসে করতি পারিনি। অকালে চলে গেল। নতুন কাজে ঢুকে অসুবিধে হয়েছে। কষ্ট করে কাজ শিখিছি। টিকে থাকার জন্যি কী কষ্টটাই না করিচি। যে দিদির কাছে কাজ শিকিচি; প্রথম দিকি টাকা কম দিত। খাঁটিয়ে নিত বেশি। মুখ বেজার করিনি। মালিক খুব ভালো। বেইজ্জত হওয়ার ভয় কম। রঙের কাজে ভালো থাকা খুব কঠিণ। বড়ো বড়ো ফ্লাট বাড়িতে এক/দুইজন পুরুষ মানুষের সঙ্গে কাজ। ভালো থাকে না কেউ - গল্প তো শুনি। কয় দিনিই তাদের সাজ- পোষাক, ভাব- ভঙ্গি পাল্টিয়ে যায়।”

পা নাচানো থামিয়ে যুবতীটি বলে ওঠে “এই তো আমি ৫০০টাকা নিয়ে ঘরে যাচ্ছি। হেডমিস্ত্রী ব্যাগ বোঝায় করে বাজার করে দিয়ে ট্রেনে তুলে দিল । আধ ঘণ্টা পরপর ফোন করে খোঁজ নিচ্ছে। রাজমাস্ত্রীর হেলপারের কাজে এই সুবিধা পেতাম? আমার বরের ওষুধ কিনে দেয়। ফল কিনে দেয়। একটা ফ্ল্যাটবাড়ি রং করে ২৫ হাজার টাকা লাভ করল। ১৬ হাজার টাকা দিয়ে এই মোবাইল টা কিনে দিয়েছে। বারো হাতে ঘোরার থেকে একহাতে থাকায় ভালো।”

“বাড়িতে কে কে আছে?” কুন্তী জানতে চাইল।

“পঙ্গু স্বামী আর ১২বছরের ছেলে। আমার স্বামী চূর্ণীতে ট্রলার চালাত। বাবা তাই দেখে বিয়ে দিয়েছিল। চূর্ণীর যা অবস্থা - ট্রলার চলা বন্ধ হওয়ার পর থেকে রানাঘাট স্টেশনে লটারি বেচতো। নেশা করা ধরল। দিনের বেলায় নেশা করে বাইক চালাতে গিয়েই তো এই বিপত্তি। লোকের বাড়ি কাজ করে রুগী টানব? না পেটের খিদে মিটাব? আমাদের পাড়ার একটা মেয়ে রঙের কাজ করত সোদপুর। ওই আমাকে এই লাইন ধরিয়ে দেয়। সাড়ে তিন’শ টাকা রোজ। ১০০ টাকা রেখে ২৫০ টাকা দিত। একমাস কাজ করার পর এ লাইনের আটঘাট বুঝে গেলাম। দুইবছর এই হেড মিস্ত্রীর সঙ্গে কাজ করছি। ওর বউ ও আমাকে ভালোবাসে । এমনি এমনি তো আর বাসে না। আগে টাকা হাতে পেলি সাট্টা খেলে , স্ফূর্তি করে খালি হাতে বাড়ি ফিরত। আমি তা হতে দিইনে। মালিক টাকা দিলে আমি ওর বউকে খবর দিই। সে এসে নিয়ে যায়।”

চাকদা থেকে ওঠা দিদিমণিদের জায়গা করে দিল শিবাদাসীরা। নিজেরা দাঁড়িয়ে পড়ল। কাঁধে হাতে পিঠে ঠাসা জিনিসের ব্যাগ নিয়ে বসে পড়ল তারা। কোনার জায়গাটা পাওয়ায় জন্য একজন বৈষ্ণমীকে ‘থ্যাঙ্ক ইউ ‘ জানাল। বসার পর হাতের ব্যাগ থেকে খাবার বেরোচ্ছো। চেরি, কাজু , পেস্তা, বাদাম, কিসমিস। সেটা বন্ধ করে বেরোল ফলের কৌটো। একজন পিঠে বের করল। টিফিনবাটি এগিয়ে দিচ্ছে একে অপরের দিকে। পাটি সাপটা খেয়ে সবাই প্রশংসা করল।

“বনিদি তুমি বানিয়েছো?”

“নারে। আমার কাজের দিদি। খুব ভালো। একবার মুখে বললেই হল!”

“আমার কাজের লোকের কথা আর বোলো না। দেরি করে আসে। কোনো কাজ করতে চায় না। শুধু কামাই আর টাকা দাও , টাকা দাও। তার উপর বুড়িটা যা জ্বালাচ্ছে না? জীবন একেবারে অতিষ্ট হয়ে গেল। তিনজন কাজের লোক। যে সারাদিন থাকে খাবার-দাবার খেয়ে শেষ করে দেয়। বাধ্য হয়ে সিসি টিভি লাগালাম।”

“বুড়িটা আবার কে?”

“আমার মা।”

একজন স্কুল শিক্ষিকার মুখে মাকে বুড়ি বলে সম্বোধন করা শুনে কুন্তী অবাক হল। কল্যাণীতে তেমন কেউ নামল না। চারটি বিরাট ট্রলি ও ব্যাগ সমেত কন্যাসহ দুইজন মহিলা উঠল।

“পা তুলুন, পা তুলুন ট্রলিগুলো সিটের ওপরে নীচে দিয়ে দিই।”

“এত ভিড়ে পা তুলব কোথায়? অফিস টাইমে এত বড়ো ট্রলি নিয়ে কেউ ওঠে? অত হুটোপাটা করছেন কেন”

“একদম জ্ঞান দেবে না । কখন বেরোব, না বেরোবো আমার ব্যাপার। বেড়াতে আসবো জামাকাপড় আনব না? নিত্যযাত্রীরা যেন ট্রেন কিনে নিয়েছে? যথারীতি টিকিট কেটে যাচ্ছিল। কী মুখরে বাবা! নিজের সুবিধা মতো তো বেরোবো।”

“বাক্স রাখতে গিয়ে হাটুতে যা লাগল না! ওরে, বাপরে, বাপ। তার উপর এত কথা বলছো কেন?”

“সরিতা চুপ করে যা। জীবনে ট্রেনে ওঠে না, সব। বারাকপুর আসলে লোক দাঁড়ানোর জায়গা থাকবে না। দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।”

"ওরা কী বুঝবে ট্রেন জার্নির!”

“ছোটোলোক কোথাকার। ট্রেন মনে হচ্ছে নিত্যযাত্রীদের বাপের সম্পত্তি?"

সরিতার ধৈর্য্যচূতি ঘটল “ভারি আমার বড়ো লোক এলেন রে! দামি পোষাক আর কথায় কথায় ইংরেজি শব্দ আওড়ালে শিক্ষিত হওয়া যায় না। দমদম যে বাড়িতে বয়ষ্ক বুড়িটাকে দেখি রত্নাদি, মুখে যা কাচা খিস্তি না! দামড়া দামড়া ছেলে দাদা, বাবার সামনে মা-মেয়ে হাতকাটা যা প'রে থাকে না; বাল-ঝোল সব দেখা যায়। তারা আবার ভদ্দরলোকগিরি মারায়।”

“সরিতা, দাঁড়া । এরপর বেশি কথা বললে ট্রলিগুলো বাইরে ফেলে দিতে হবে। মানুষ দাঁড়ানোর জায়গা পাচ্ছে না। প্রত্যেকদিন কী লড়াই করে যাওয়া-আসা করতে হয় এরা তার কী বুঝবে?

এই প্রতিবাদী কণ্ঠকে সাথ দিতে একসঙ্গে অনেক কণ্ঠ ধ্বনিত হয়ে উঠল, "ট্রলি বের করে দাও আমরা ফেলে দিচ্ছি। মহিলাদেরও ঘাড় ধরে নামিয়ে দেওয়া হোক।”

“মা চেপে যাও।”

বেগতিক দেখে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে সুন্দরী মহিলার মেয়ে বলল।

কুন্তী ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ভ হয়ে গেল। কোনো পক্ষকেই সমর্থন করতে পারছে না। মানুষের বেঁচে থাকার কী কঠিন লড়াই! পরের স্টেশন দমদম। অসম্ভব ভিড়। ট্রলি ব্যাগটা নিয়ে নামতে পারবে তো ওরা? ভাবনা হলেও; নিজে কীভাবে নামবে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল।

(ক্রমশ)