।। ১ ।।
একটা কথা আছে, বেলা। শিশুবেলা, ছেলেবেলা, মেয়েবেলা, এছাড়া বাদবাকি বয়স অনুযায়ী নানা বয়সের নানা বেলা তো আছেই।
আবার একটি বেলা আমরা যাপন করি, তাকে বলি কবিতাবেলা।
আমাদের কবিতাবেলার কোনও বয়সজনিত বেলা নেই।
আমরা কবিতাবেলাতেই জন্ম নিই, বেড়ে উঠি, মন দিয়ে মই খুঁজি। খুঁজতে খুঁজতে উঁচু-নিচু-মধ্য বিভিন্ন গগনে বিচরণ করি। কখনও মুদ্রণ সৌভাগ্য পড়ে পাই।
কখনও দাক্ষিণ্য বিভূতি ছায়াঙ্ক লাভ হয়।
কবিতাবেলায় চলতে চলতে কতকগুলো জীবন-ঝলক এক পর্ব থেকে আরেক পর্বে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
কবি জীবনানন্দ 'পিরামিড' কবিতায় লিখেছিলেন -
বেলা ব’য়ে যায়,
গোধূলির মেঘ-সীমানায়
ধূম্রমৌন সাঁঝে
নিত্য নব দিবসের মৃত্যুঘণ্টা বাজে,
শতাব্দীর শবদেহে শ্মশানের ভস্মবহ্নি জ্বলে;
পান্থ ম্লান চিতার কবলে
একে-একে ডুবে যায় দেশ জাতি সংসার সমাজ;
কার লাগি, হে সমাধি, তুমি একা ব’সে আছো আজ -
লোল মৃগতৃষ্ণিকার দ্বারে
মিশরের অপহৃত অন্তরের লাগি’
মৌন ভিক্ষা মাগি।
খুলে যাবে কবে রুদ্ধ মায়ার দুয়ার
মুখরিত প্রাণের সঞ্চার
ধ্বনিত হইবে কবে কলহীন নীলার বেলায় -
যা চিরকালীন, সেই প্রবহমান জীবনবেলার আলেখ্য কবি জীবনানন্দের আদি অকৃত্রিম সঙ্গী। উত্তরণের দীর্ঘতা নয়, গ্রস্ততার অভিনিবেশ তার কবিতাবেলাকে আন্তরিক আসন দিয়েছে।
জীবনানন্দের প্রেক্ষিতটা একটা পিরামিডের মতোই ত্রিমাত্রিক, যেন জীবনের বিভিন্ন বেলার কাব্য বিচ্ছুরণ।
কবিতা তার এক অতিসারণিক প্রাকৃত নির্মল কবিতাবেলার উদ্ভাস।
।। ২ ।।
কবিতাবেলার যে সকালবেলা মানে শুরুর নবীনবেলা, ঘসঘস করে পাতার পর পাতা কবিতা লিখতে লিখতে মনে হয় কত না লিখে ফেলেছি। সেই তালে কবিতাবেলা বেশ পরিশ্রমের, বেহৎ খাটিয়ে নেয়, কবিতা রচনার শিল্পকে কলমে শানাতে গেলে কবিতার ইঞ্চি ফুট সব মাপতে মাপতে বাধ্য ছাত্রের মতো পিঠ উঁচু হয়ে যায়।
গত শতাব্দীর উল্লেখযোগ্য কবিদের মধ্যে এই কবিতা শানানো শিল্পের অকৃত্রিম চর্চা অভূতপূর্ব কবিতাবেলার পরিমন্ডল তৈরি করেছিল।
তুলনামূলক সাহিত্য পড়ার সময়, বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকায় 'যম' কবিতা দিয়ে যে কবিতাবেলার ঢাকে কাঠি পড়ল শক্তি চট্টোপাধ্যায় তার সমগ্রতায় সেই অনাস্বাদিত মুগ্ধ কবিতাবেলা সমসময়ে তর্কাতীত ভাবে প্রবাদপ্রতিম।
গত শতাব্দীর কবিতাবেলা প্রত্যক্ষত, জীবনানন্দ উত্তর সময়ে কল্লোল ও হাংরি জেনারেশনের কবিতাবেলার এক মিশ্র অভিজ্ঞতার পাঠমালা। একদিকে গতানুগতিক প্রভাবী সাহিত্য চর্চার পরিমন্ডল আরেকদিকে প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার মহাভারত।
জীবনানন্দ দাশকে একসময় অশ্লীলতার দাগে দেগে দিয়েছিলেন কিছু কলেজীয় মাষ্টারমশাই,তার পরে বিব্রত কবি লিখলেন -
‘বরং নিজেই তুমি লেখোনাকো একটি কবিতা -’
বলিলাম ম্লান হেসে; ছায়াপিণ্ড দিলো না উত্তর;
বুঝিলাম সে তো কবি নয় - সে যে আরূঢ় ভণিতাঃ
পাণ্ডুলিপি, ভাষ্য, টীকা, কালি আর কলমের ’পর
ব’সে আছে সিংহাসনে - কবি নয় - অজর, অক্ষর
অধ্যাপক; দাঁত নেই - চোখে তার অক্ষম পিঁচুটি;
বেতন হাজার টাকা মাসে - আর হাজার দেড়েক
পাওয়া যায় মৃত সব কবিদের মাংস কৃমি খুঁটি;
যদিও সে-সব কবি ক্ষুধা প্রেম আগুনের সেঁক
চেয়েছিলো - হাঙরের ঢেউয়ে খেয়েছিলো লুটোপুটি।
অবিসংবাদী উত্তর।
এমনিতেই জীবনানন্দের ব্যক্তিগত জীবনের উথাল পাথাল তাঁর কবিতাবেলাকে পীড়িত করে রেখেছিল, তার বিরোধিতার মঞ্চও কুশলী যথেষ্ট ছিল, পায়ে পা লাগিয়ে চলেছিল সমান্তরাল।
আবার সমসাময়িক কল্লোল নিয়েও অশ্লীলতার ঢেউ তুলে মামলাকারীরা খুব একটা কল্কে পাননি। এঁদের মধ্যমনি সজনীকান্ত দাশ ও নীরদ চৌধুরীরা শনিবারের চিঠি'র টিআরপি বাড়াতে নেমেছিলেন। তেমনি হাংরির বিরুদ্ধে খ্যাতিমান কথাকারদের কেউ কেউ গড়গড়িয়ে 'অশ্লীল' শব্দ চাপিয়ে গতানুগতিকতা বাঁচাতে দ্রিমি দ্রিমি নেমেছিলেন। দ্বীপেন বন্দোপাধ্যায়ের ঘাম গল্পটি এহেন উষ্মার উৎস।
।। ৩ ।।
কবিতাবেলার কি অসময় চলছে? এত স্বতঃস্ফূর্ত, এত ব্যাপক,এত প্রাচুর্যে ভরা সমাজ মাধ্যমে রমরমে অগণিত লেখা আত্মপ্রকাশ করছে, মানে সবাই আমরা লিখে যাচ্ছি, নিজের কবিতা বাদে আর কারো কোন কবিতা যে আমরা পড়ে উঠতে পারছি না!
অনলাইন বা অফলাইন পত্রিকায় শুধু নিজের লেখাটা পড়ার পর নিজের একান্ত আপন বৃত্তে হারিয়ে যাচ্ছি।
বিভিন্ন কবিতা পাঠের মর্যাদাময় অনুষ্ঠানে আরেকটি চিত্র খুবই চোখে পড়েছে। কবি নিজের কবিতা পড়লেন, তারপর ব্যাগ গুছিয়ে ব্যক্তিগত কাজের অছিলায় সহযোদ্ধাদের কবিতা শোনার প্রতি সামান্যতম সৌজন্য অবশিষ্ট না রেখে অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করলেন। আয়োজনের শেষবেলায় কবিতাবেলাটা প্রায় শ্মশানের মতো একা এক করুণ আবহ রচনা করে তার চেহারা অনেকেই আমরা দেখতে অভ্যস্ত।
এখনকার কবিতাবেলা যেন একার, নিজস্ব বিজ্ঞাপন।
মেধার বিনিময় ক্রমশঃ অবলুপ্তির পথে। সমাজ মাধ্যমের উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তা যে বন্ধুতা নামক সম্পর্কের বিচিত্র বিনাশী পরিবর্তন রচনা করে চলেছে তেমনি কবিতাবেলার স্বর্গভুমিতে এক একজন কবি এক একটি দ্বীপ-নির্বাসিত হয়ে পড়ছেন। এত কবিতা রাখা হবে কোথায় যদি না একটাও পড়া হয়!
এই আমাদের কবিতাবেলা, এক নিঃসঙ্গতার পেছন ফিরে থাকা। তবে একটা প্রশান্তি আমাদের তৃপ্ত করে যে, প্রতিটি কবির জীবনে আমৃত্যু চলমান থাকে তার কবিতাবেলা।