কলেজে ভর্তি হয়ে বাবার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে প্রণাম করে নিলাম। তারপর ছবিটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে প্রার্থনা করলাম - বাবা, আমাকে শক্তি দিও। আমি যেন মানুষের মতো মানুষ হতে পারি। আমি যেন তোমার যোগ্য সন্তান হতে পারি।
আজ মায়ের ঘোলাটে দুটো চোখ আর উদাসী মনটা দেখে মনে হয়, বাবার যোগ্য সন্তান হতে পেরেছি কিনা জানিনা, তবে বাবার শেষ স্মৃতি হিসেবে মাকে আমার কাছে রাখতে পেরেছি, তাঁর খেয়াল রাখতে পারছি। এটাই বা ক’জন পারে? আমার পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান তো আমি নই। আরও পাঁচ পাঁচটি সন্তান তাঁদের আছে। তারা সব দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে গেলেও আমি তা পারিনি।
কলেজে ভর্তির পর বই কেনার পালা। নতুন পোশাক কিনতে হবে, অনেক নতুন মুখ, নতুন নতুন বন্ধু - বেশ একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি। একদিন কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে গেলাম, এককথায় যাকে বইপাড়া বলে। অসংখ্য বইয়ের দোকান। কোন দোকান ছেড়ে কোন দোকানে যাবো ঠিক করতে পারছিলাম না। বন্ধু বুড়ো বললো - আগে তো চল একটু শরবত খেয়ে গলা ভেজাই। এখানে একটা ভালো শরবতের দোকান আছে। সেটা নাকি খুব জনপ্রিয়। আমার বন্ধুদের কাছে শুনেছি - দোকানের নাম প্যারামাউন্ট। একবার খেলে নাকি সারাজীবন ভোলা যায় না। আমি ততটা আগ্রহ প্রকাশ করলাম না। কেননা আমার উদ্দেশ্য শরবত খাওয়া নয়। তাছাড়া শরবত খাওয়ার মতো পয়সা বা মনের ইচ্ছে কোনোটাই আমার নেই। বুড়োর থাকতে পারে, বাবা ভালো চাকরি করেন, মায়ের কাছে আবদার করে মাঝে মাঝেই বেশ কিছু টাকা আদায় করে নেয়। পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। ওকে একটু লেখাপড়া শেখানোর জন্য তিন-চারটে টিউটরও রাখা আছে। এসব বিলাসিতা ওর থাকতে পারে, আমার নয়। আমি বললাম - বুড়ো, তুই যা ভাই, আমার ওসব সহ্য হয় না। এমনিতেই বাইরের কিছু খেতে মন চায় না, তার ওপর শরবত! না না তুই যা।
প্যারামাউন্টের সামনে কলেজ স্কোয়ার। ওখানেই সেই ভুবন বিখ্যাত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। কত নাম, কত ঐতিহ্য সম্বলিত এই বিশ্ববিদ্যালয়! ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়। দীর্ঘদিনের চেপে রাখা বাসনা মনের ভেতর উঁকি দেয়। একবার প্রাণভরে দেখে আসি। শুনেছি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস অনেক বড়ো। সারা কলকাতা শহর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তার বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট। আমি কী কোনোদিন এখানে ভর্তি হতে পারবো! খুব ইচ্ছে আমার, এখানে একদিন ছাত্র হয়ে আসবো তারপর...
- কীরে কী এতো ভাবছিস? চল আমি খাওয়াবো।
- না রে, তোরা যা। আমি বরং বিশ্ববিদ্যালয়টা দেখে আসি, আমার বহুদিনের শখ। জানিনা এখানে কোনোদিন পড়তে পারবো কিনা, তবু মনে এটুকু সান্ত্বনা থাকবে যে, একদিন এই ঐতিহাসিক সমৃদ্ধশালী এবং ঐতিহ্যময় বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় পা রাখতে পেরেছি।
- তুই সত্যি একটা পাগল। যা দেখে আয়। আমরা এখানে আছি। দেখিস ওখানে দাঁড়িয়ে আবার আকাশ-পাতাল ভাবতে শুরু করিস না। তাহলে আজ আর বাড়ি ফেরা হবে না।
ওদেরকে পিছনে রেখে আমি এগিয়ে গেলাম। ডুবে গেলাম ভাবনার গভীরে, কত ইতিহাস, কত জানা-অজানা কাহিনি, কত গৌরবের অতীত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে। কতশত মহান ব্যক্তিবর্গের পদধূলি ধন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়। আমি একদিন এখানে আসবই, তুমি তৈরি থাকো বন্ধু, একবার তোমার চরণে মাথা নোয়াতে দাও। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় একবার মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে নিলাম। উপস্থিত অনেকে আমার কাণ্ড-কারখানা দেখে হয়তো বিস্মিত হয়েছেন, কারও মনে প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে কিন্তু আমি নির্বিকার। আমি তখন ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছি, কে কী ভাবছেন বা মনে করছেন সেসব নিয়ে ভাবার সময় নেই। এভাবে কতক্ষণ কেটেছিল বলতে পারি না। বুড়ো এসে না ডাকলে হয়তো সেদিন কলকাতার কোনো ফুটপাতে অথবা শিয়ালদহ স্টেশনে রাত কাটাতে হতো। বইটই তেমন একটা কেনা হলো না। অনেক কষ্টে শেষ ট্রেন ধরে সেদিন বাড়ি ফিরেছিলাম। সারাক্ষণ বুড়োর বকবকানি আর লাল্টুর দাঁত খিচুনি হজম করতে হয়েছে। আসলে আমার জন্য তো কেউ অপেক্ষা করে বসে নেই তাই আমার ফেরার তাগিদটাও কম। কিন্তু ওদের তো তা নয়, এমনিতেই অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরোতে হয়েছে তার ওপর এত রাত করে বাড়ি ফিরে কী অবস্থা হবে সেকথা ভেবেই ওদের এতটা আশঙ্কা হচ্ছে। বুঝতে পারলাম আমার জন্যেই ওদের হয়তো অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হবে। কাজটা ঠিক হয়নি, ওদের কে বারবার সান্ত্বনা দিলাম বটে কিন্তু আমি নিজেই সংশয়ে ভুগছিলাম! ওদের কিছু হবে না তো!
কলেজে ভর্তির ঠিক একমাস পরে ক্লাস শুরু হলো। বড়ো হলঘরে একসাথে প্রায় শ'দুয়েক ছাত্র-ছাত্রী সবাই চুপচাপ, কারও মুখে খুব একটা কথা শোনা যাচ্ছে না। দুই একজন খুব নিচু স্বরে কথা বলছে তার পরিচিত কারও সাথে, সম্পূর্ণ নতুন এক পরিবেশ। প্রথম প্রথম একটু আশঙ্কা হবে, তারপর সময় যত এগোবে ততই এই আড়ষ্টভাবটা কেটে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে, শুধু সময়ের অপেক্ষা। বরাবরই আমার সামনের বেঞ্চে বসার অভ্যেস তাই কলেজে এসেও সেই অভ্যেসটা বজায় রাখলাম। এই জায়গা আমি কাউকে ছেড়ে দেবোনা। প্রথম দিন পরপর চারটে পিরিয়ড হলো, তারপর কলেজের ছাত্র সংসদের সদস্যরা এসে নানারকম জ্ঞানের কথা শুনিয়ে গেল। তাদের কথা ততটা আগ্রহ নিয়ে শুনেছি তা নয়, কেবল রিগিং শব্দটা বারবার কানে আসছিলো। এর আগেও বেশ কয়েকবার রিগিং শব্দটা শুনেছি,কিন্তু অতটা গা করিনি। তখন ভেবেছি ও বিষয়টা নিয়ে ভবিষ্যতে ভাবা যাবে। ছাত্র সংসদের সদস্যদের মধ্যে আমার পূর্ব পরিচিত এক বন্ধু ছিলো। ছুটির পরে ওর কাছে গেলাম। তখন কৃষ্ণনগরের সবকটা কলেজে ছাত্র পরিষদের রমরমা ব্যাপার। ওদের দাপটও খুব বেশি। আমার বন্ধু প্রস্তাব দিলো - জয়, তুই এখানে যখন ভর্তি হয়েছিস তখনই আমরা তোর সম্পর্কে আলোচনা করে ঠিক করেছি যে, আগামী ছাত্র সংসদের নির্বাচনে তোকে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াতে হবে। তুই কিন্তু না করবি না। তাহলে আমার মানসম্মান থাকবে না।
আমি বললাম - দেখ নেপু আমি রাজনীতির কিছুই বুঝিনা, এবিষয়ে আমি একেবারে অনভিজ্ঞ। তারপর আমার সম্পর্কে তো জানিস, কত অল্প বয়সে আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছি। সামান্য কটা টাকা টিউশনি করে পাই, তাতেই আমার সমস্ত খরচ খরচা চালাতে হয়, আমাকে এর মধ্যে জড়াস না ভাই, তোর কাছে এটাই আমার চাওয়া। আশা করি তুই আমাকে বুঝবি।
নেপুকে খুব একটা খুশি মনে হলো না। মুখভার করে গম্ভীর কণ্ঠে বললো - দেখ জয় সাধা লক্ষ্মী পায়ে ঠেলিস না। পরে নিজেকে এর জন্য অনুশোচনা করতে হবে। আর এমনও তো হতে পারে যে, আমাদের সাথে পরিচয়ের সূত্রে তোর টিউশনির চাহিদা বেড়ে যেতে পারে। একবার সংসদ ভবনে আয় অনান্য দের সঙ্গে কথা বলে দেখ আশা করি তোর বিষয়টা বিবেচনা করা হবে। তাছাড়া নির্বাচিত হলে তুই একটা রেমুনারেশন পাবি, চিন্তা করছিস কেন? আর ভাবিস না, চলে আয়।
- আমাকে কটা দিন সময় দে, আমি একটু ভেবে দেখি। আমি রাজনীতির বাজারে একটা অচল পয়সা ছাড়া কিছু না। বক্তব্যও রাখতে পারি না। কাউকে বোঝানোর মতো পুঁজিও আমার কাছে নেই। ঠিক আছে তুই যখন বলছিস আমি একটু ভেবে দেখি।
- ঠিক আছে। তাই হোক। দুদিন ভেবে দেখ। তার বেশি সময় কিন্তু দেওয়া যাবে না।
এ আবার এক নতুন উৎপাত। কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। বাড়িতে এসে অনেকটা সময় নিয়ে ভাবতে লাগলাম। কিন্তু কোনো সমাধানের পথ খুঁজে পাইনি। পরের দিনও ঠিক একইভাবে কেটে গেল। কলেজ থেকে ফেরার সময় আমাদের পাড়ার একটা দিদি অঞ্জলি বললো - শোন ভাই, ওদের ফাঁদে পা দিবি না। আমি যখন কলেজে ভর্তি হলাম তখনও এমনই একটা প্রস্তাব আমার কাছে আসে। আমি পত্রপাঠ ওদের বিদায় করে দিয়েছিলাম। তাছাড়া আমি সি পি আই এম করি তাহলে কংগ্রেসের হয়ে আমি লড়বো কেন? বিষয়টা ওদের কে বলতেই ওরা পিছিয়ে গেল। তারপর কোনোদিন কোনোভাবেই ওরা আমাকে বিরক্ত করেনি বরং একটু সমীহ করে চলতো।
দিদিটার কথায় যুক্তি আছে। ওর পিছনে সাপোর্ট আছে। আর আমি? আমি তো পুরো একা। কিছু একটা করা দরকার যাতে সাপও মরবে কিন্তু লাঠি ভাঙবে না। কী করা যায়, কী করা যায় ভাবছি এমন সময় রঘু এসে হাজির। রঘু কে দেখে একটু ভরসা পেলাম। ডাকাবুকো চেহারার রঘু দীর্ঘদিন এমনই একটা সুযোগ খুঁজছিল ওকে আমার সমস্যার কথা বলতেই ও বললো - চিন্তা করছিস কেন, আমি আছি তো, আমি সব সামলে দেবো।
যাক কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। পরদিন অনেকটা হালকা মন নিয়ে কলেজে গেলাম। দেখলাম রঘু ক্লাসে না গিয়ে আগেই সংসদ ভবনে গেল। সংসদ ভবনে তখন নেপু আর চন্দনদা বসে ছিলো। রঘু দরজা বন্ধ করে দিলো। আমরা ক্লাসে চলে গেলাম। আজ একটা ঝামেলা না হয়, রঘু যা ছেলে মারপিট না করে বসে। তার প্রভাবটা আমার ওপর না এসে পড়ে, ইস কেন যে রঘু কে বলতে গেলাম। ক্লাসে মন দিতে পারছিলাম না। এদিকে ইতিহাস স্যার তখন টিপু সুলতানকে নিয়ে পড়ে আছেন। ওনার পড়ানোর মধ্যে প্রতিটি বাক্যে একটা করে ‘ইত্যাদি’ শব্দ থাকবেই। এটা নিয়ে অনেকেই হাসাহাসি করতো। একসময় স্যারের নামই হয়ে গেল ‘ইত্যাদি’ এবং "টিপু সুলতান"। যাইহোক রঘুকে নিয়ে যে আশঙ্কার মেঘ জমেছিল সেটা কেটে গেল। ও তেমন একটা কিছু করেনি। ও যে ঠিক কী করেছিল আমি জানিনা। কিন্তু আমার উপকারই হয়েছিল। সেদিনের পর থেকে নেপু আর আমাকে কিছু বলতে আসেনি। এরপর যতবারই আমাদের দেখা হয়েছে ততবারই নেপু একগাল হেসে বলেছে - তুই ভালোই করেছিস।
(ক্রমশ)