গল্প ও অণুগল্প

এক কাপ চা



অনিন্দিতা মুখার্জি সাহা


অফিস থেকে কোনওরকমে শেষ মেইলটা লিখে কম্পিউটার বন্ধ করে দিল বৃষ্টি । ঘড়িতে ছ'টা বেজেছে সদ্য। অফিস অল্প অল্প ফাঁকা হতে শুরু করেছে। বৃষ্টির যদিও অন্যদিন এইসময় পুরোদমে কাজ চলে। যেদিন কাজ হালকা থাকে রেখে দিয়ে বিকেল চারটে থেকে কাজে হাত দেয়। যদিও এখন উঁচু পোস্টে পৌঁছে কাজের চাপ অনেক কম কিন্তু মানসিক চাপটা বেশ বেড়েছে। বৃষ্টির ওপর গোটা ষোলো জনের দায়িত্ব। ভালো হলে সে দায় টিমের কিন্তু খারাপ কখনো কিছু হলেই ব্যাস সব বৃষ্টির দোষ।

তাই দিনের শেষে যখন সবার সব কাজ শেষের মুখে, তখন সেসব নিজ দায়িত্বে চোখ বুলিয়ে নেয় বৃষ্টি। নিজের দায়িত্বেই করে, ভালোবেসে করে। নেটওয়ার্কিংয়ের কোর্সটা শেষ করেই চাকরিটা পেয়েছিলো ও। সে আজকের গল্প! দশ বছর হতে চললো এই কোম্পানিতে। তাই ওর দায়িত্ব নিয়ে কারোকে কিচ্ছু বলতে হয়না।

বরং বাড়ির দায়িত্বগুলো কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেনা বৃষ্টি। বিয়ের বয়সও তো কম হলো না। এই ফেব্রুয়ারীতে তিনে পড়বে কিন্তু হলে কি হবে এখনও রান্নাঘরে গিয়ে নিজে থেকে কিছু রান্না করতে ইতস্তত হয়! আসলে বৃষ্টি দেখেই এসেছে রান্নাঘর মানে তাতে স্বপ্নাদেবীর একচ্ছত্র অধিকার। আর তার কিছুটা ভাগ পেয়েছে রমলাদি মানে রান্নার দিদি। বৃষ্টি বাড়ি ঢুকেই দেখবে রান্নাঘরজুড়ে রানী সেজে খুন্তি নাড়ছে রমলাদি আর দরজা আগলে দাঁড়িয়ে স্বপ্নাদেবী। পুরোদমে রান্না চলছে তখন। যার যেমন পছন্দ গিয়ে বললেই খাবার হাজির। একদিকে বিষয়টা বেশ শান্তির হলেও বৃষ্টি বেশ বুঝেছে ওর এখনও ও-বাড়ির সদস্য হওয়া হল না।

ঢোকার সাথে সাথে শরবত তারপর রাতের রকমারি খাবার সব তৈরি থাকে বৃষ্টির জন্য। ইচ্ছে থাকলেও শরবতের পরিবর্তে এক কাপ চা খেতে পারেনা বৃষ্টি। অথচ এই বৃষ্টিই বিয়ের আগে বাড়ি ঢুকতেই মা এক কাপ গাঢ় দুধের চা এনে দিত। তাতে বিস্কুট চুবিয়ে উফফ্ ভাবলেই চোখ বুজে আসে বৃষ্টির।

"পঞ্চুদা এক কাপ চা দাও!" - অর্ডারটা দিয়েই ফোন খুললো বৃষ্টি। আজ অফিসে কীসব কাজ হবে তাই ছ'টায় বেরোতেই হল। মানে সাতটার মধ্যে বাড়ি। অর্ক ঢুকবে প্রায় ন"টা। একই সাথে অর্ক আর বৃষ্টি ঢোকে রোজ। সেরকমভাবেই বেরোয় দুজনে প্ল্যান করে। শ্যামবাজারে একসাথে দেখা করে পাঁচমাথার মোড় থেকে এক কাপ করে চা খেয়ে তারপর বাড়ির পথ ধরে দুজনে।

ওই এক নেশা বৃষ্টির, চা! যেমন তেমন নয়, দুধ চা বেশ কড়া চিনি দিয়ে। পুরোনো নতুন যাকেই সামনে পায় চায়ের বন্ধু বানিয়ে ফেলে বৃষ্টি। অফিসেই তো কতবার যে চা চলে তার ঠিক নেই। অর্ক যদিও ভীষণ সচেতন। ও দিনে দু'বারই চা খায়। একবার গ্রিন টি, একবার লিকার চা। তবে বৃষ্টির পাল্লায় পড়ে সন্ধ্যেবেলা একবার দুধ চা খায় ঠিকই কিন্তু একদম মন সায় দেয় না ওর, বৃষ্টি বোঝে। বৃষ্টির একটাই কথা আমি যদি তোমার জন্য সকালে গ্রিন টি খেতে পারি তুমি দুধ চা খেতে পারবে না কেন! মানিয়ে নেওয়া দু' তরফেই হোক।

পঞ্চু কাগজের কাপের এক কাপ চা এগিয়ে দিতেই দু'বার ফুঁ দিয়েই চুমুক দিলো বৃষ্টি। ওর চা খাওয়া দেখলে যে কেউ বুঝবে বৃষ্টির এতে নেশা আছে।

"পঞ্চুদা আর কত জল মেশাবে গো! সেই সকালের গাঢ় চা জল মিশে তো এখন জলের মতোই লাগছে!" - নাক সিঁটকে বললো বৃষ্টি। পঞ্চু দাঁত বের করে হাসছে। বৃষ্টিদের অফিসের নিচে এই একটাই ফুটপাথের চায়ের দোকান। আছে আরও কিন্তু সেসবই ব্র্যান্ডেড। ওটা মাসে একবারই ঠিক আছে। সোহাগে আদরে এই পঞ্চুদার চা-টাই বেশ।

তেতো মুখেই চায়ে চুমুক দিচ্ছে বৃষ্টি। আজ দিনটাই বেকার। না শ্যামবাজারের সেই চা-টা পাবে! না বাড়ি গিয়ে চা পাবে। মাথার দুই কোণই টিপটিপ করছে। ঘড়ি দেখলো বৃষ্টি, সোয়া ছ'টা। হিসেব করে দেখল সাতটা পাঁচের মধ্যে বাড়ি ঢুকে যাবে ও! গিয়ে! উফ্ সেই বোকা বোকা শরবত। যে কেউ ভাববে ভাগ্য করলে মানুষ এমন হাতের কাছে এক গ্লাস শরবত পায়!

কিন্তু বৃষ্টি মোবাইলে টেক্সট মেসেজ টাইপ করল অর্ককে। "তোমার কি দেরি আছে? আমি বেরিয়ে গেছি। দাঁড়াবো শ্যামবাজারে?" সাথে সাথেই অর্ক লিখলো - "পাগল নাকি? আমি সাড়ে সাতটার আগে বেরোতেই পারবো না!" কি করবে বৃষ্টি! অগত্যা উঠে পড়ল বাসে!

বাড়িতে যখন কলিং বেল বাজালো ঘড়িতে তখন সাতটা বারো। পুরো বাড়ি অন্ধকার। পাইকপাড়ায় তিনতলা বাড়ি অর্কদের। দোতলা আলোকিত হয় অর্ক আর বৃষ্টি ফেরার পরেই। কারণ অত বড় বাড়ির দোতলার মাত্র দুটো ঘর নিয়েই ওরা থাকে। আর তিনতলায় লোকজন না আসলে অন্ধকারই থাকে। কিন্তু একতলা!

এই ভর সন্ধ্যেবেলা একটা লাইটও জ্বলেনি! অথচ আশপাশের বাড়ি থেকে শঙ্খর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ঠাকুর দেবতা কোনোকালেই মানে না বৃষ্টি, কিন্তু শুভ অশুভ বিষয়টা বেশ ভাবায় ওকে! শঙ্খর আওয়াজে নাকি বাড়ির যত নেগেটিভ এনার্জি কাটে!

এতো বড় বাড়িটা দেখলে তো বৃষ্টির এটাকে ভুতুড়ে বাড়িই মনে হয়। বাবা-মা-ছেলে, তিনজনের জন্য কি করতে যে অর্কর বাবা এতো বড় বাড়ি বানিয়েছেন! বৃষ্টি শুনেছে ভদ্রলোক নাকি খুব সৌখিন ছিলেন। যদিও বৃষ্টির সাথে কখনও দেখা হয়নি। দেখা বলতে স্বপ্নাদেবীর ঘরের দেওয়ালে।

দেখে মনে হয় মানুষটা বেশ হাসিখুশি স্বভাবের। হয়তো বৃষ্টির সাথে ওঁনার আড্ডা জমতো! ছবি দেখে তো তাই মনে হয়। আর যাই হোক স্বপ্নাদেবীর মতো গোমড়ামুখো নয়। কোনোদিনও একটা অতিরিক্ত কথা বলতে শোনেনি বৃষ্টি। গলার আওয়াজ শুধু শোনা যায় রমলাদি রান্না করতে আসলে! কেমন যেন ওয়েটারের মতো!

একবার ঘরে ঢুকে জেনে যাবেন কে কি খাবে, আবার চলে যাবেন রান্নাঘরে। প্রথম প্রথম বৃষ্টির খুব ইচ্ছে করত অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এক কাপ চা নিয়ে শাশুড়ির সাথে গল্প করতে! আরে বন্ধুত্ব না হোক ঝগড়ার জন্যই না হয় গল্প হোক।

কিন্তু কোনোদিনও ধারেকাছে ঘেঁষতে দেননি মানুষটা। মনে পড়ে না অর্কর সাথেও খুব কথা বলেছেন কখনও! আগে অবাক লাগত বৃষ্টির যে একজন ছেলে কি করে মায়ের থেকে এতটা দূরে থাকতে পারে! বৃষ্টির তো মায়ের কাছে যাওয়াই হয় না। সেই-ই শিলিগুড়ি! ইচ্ছে করলেও যাওয়ার উপায় নেই।

পাশের বাড়ির জানলা দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, তাতে চা পাতার সাথে দুধ ফোটার গন্ধ। বৃষ্টি নাকে টেনে নিল সেই গন্ধ। কত দিন হল এককাপ চা নিজে করে খায়নি। সুযোগ হয়নি তা না কিন্তু আর কারোর চোখে সেরকম উৎসাহ দেখেনি। তাই আর খাওয়াও হয়নি।

আজ খাবে। রমলাদি আটটার আগে ঢোকে না। এখনও অনেকটা সময় বাকি। তাড়াতাড়ি ঢুকেই চায়ের জল বসিয়ে দেবে। তাতে দেবে বেশ করে দুধ! দুধ থাকবে তো! নিশ্চয়ই থাকবে কারণ স্বপ্নাদেবী তো রোজই রাতে দুধ দিয়ে রুটি খান। তাই রোজ সকালে দুধ আসে বাড়িতে তাই আর যাই হোক দুধের অভাব হবে না।

চায়ের কথা মনে পড়তেই গলাটা শুকিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি আরেকবার সুইচটা চেপে ধরল। ক্রিং... করে আওয়াজ হলো! এখন মনে পড়ল ও এতক্ষণ বেলটা ধরে দাঁড়িয়েই ছিল। বেলটা যে বাজাবে ভুলেই গেছে! দু'বার চারবার বেল বাজাতেও দরজা খুলছেন না স্বপ্নাদেবী। একটু ভয় পেয়ে গেল বৃষ্টি। কে জানে শরীর খারাপ হল কিনা! সত্যিই তো সেই যে সকালে বেরোয় সারাদিন নিজের মা-কে ফোন করলেও এই মানুষটার একবারও খোঁজ নেওয়া হয়না বৃষ্টির।

আরও দু'বার বেল দিল বৃষ্টি। ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করতে যাবে হঠাৎ আলো জ্বলে উঠলো বারান্দায়। দরজার ফাঁক থেকে আলোর রেখা দেখতে পেয়ে যেন শান্তি পেল বৃষ্টি।

দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়ানো স্বপ্নদেবী!

"কোথায় ছিলে এতক্ষণ! কখন থেকে বেল বাজাচ্ছি।" - বেশ রাগ করেই কথাগুলো বলে ফেলল বৃষ্টি। বুকটা এখনও ঢিপঢিপ করছে। কেন করছে জানে না ও! এই মানুষটার থাকা না থাকা কোনো কিছুতেই কিছু যায় আসে না বৃষ্টির।

ওপরদিকে স্বপ্নাদেবীও যেন কেমন থমকে গেলেন। খুব অবাক হয়ে গেলেন বৃষ্টির এমন করে কথা বলাতে! নিজের ছেলেটাও এভাবে কখনও কথা বলেনি। কথা তো দূরে থাক মা কেমন আছে সেটুকুও খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি!

"এই চোখটা একটু লেগে গেছিল!" - নিজের অবাক হওয়াটা লুকিয়ে ফেলে বললেন স্বপ্নাদেবী। বৃষ্টি যেন আরও রেগে গেল। একটু ব্যাঁকা স্বরেই বলল, "সারা দুপুর ঘুমোওনি! শরীর খারাপ নাকি!"

স্বপ্নাদেবী কি করে বোঝাবেন আজ কয়েক বছর হয়ে গেল ঘুমোননি ভালো করে উনি। দুপুর হোক বা রাত। মাঝে মাঝে ঘুমের ওষুধ খেয়ে একটু বিষয়টা আয়ত্তে আনলেও কিন্তু ঘুমটা ওনাকে একদমই ছেড়ে চলে গেছে!

সেই যেদিন অর্কর বাবা কিছু না বলে ছেড়ে চলে গেছেন। কি করে ঘুমোতেন স্বপ্নাদেবী! আগেরদিন রাতেও যে বিকাশবাবু মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলেন! লোকে বলে বয়সের ভারে সম্পর্ক শুকিয়ে যায় কিন্তু কই! ত্রিশ বছরের বিয়ের বয়সে কখনও তো মনে হয়নি স্বপ্নাদেবী ক্লান্ত। বরং বিকাশবাবুর হঠাৎ চলে যাওয়ার পর থেকে একেকটা দিন যেন একেকটা যুগ। কাটতেই চায়না।

কেউ নেই যার সাথে একটু কথা বলবেন! কেউ নেই যে মাথায় হাত রেখে বলবে আমি আছি। বিকাশবাবু যখন গেলেন, অর্ক পড়াশোনাটা শেষ করেছে সবে। স্বপ্নাদেবীই বরং অসুস্থ ছিলেন। সুগার, থাইরয়েড। ওষুধটাও মনে করে খাইয়ে দিতেন বিকাশবাবু। কিন্তু যে মুহূর্তে একা হয়ে গেলেন স্বপ্নাদেবীর দায়িত্ববোধ বেড়ে গেল। মনে করে ওষুধ খাওয়া, সংসার সামলানো, ছেলের পড়া শেষ করানো, চাকরি পাওয়া, বিয়ে সবটা করে দিয়েছেন। মুখ বুজে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। করেই যাচ্ছেন। এতদিন মরে যেতে ভয় পেতেন কিন্তু আজ মনে হয় সত্যিই উনি অতিরিক্ত সংসারে। শুধু রান্না খাওয়া এটুকু তদারকি না করলেও টিকে যাবে ওরা।

বরং মাঝখান থেকে যে একা সে একাই রয়ে গেলেন স্বপ্নাদেবী। এই যে সন্ধ্যেবেলা শুয়ে থাকা! বেঁচে থাকলে থাকতে দিতেন বিকাশবাবু? চা বানিয়ে নিয়ে এসে গান চালিয়ে চনমনে করে তবে ছাড়তেন। কি অদ্ভুত সুন্দর দুধ-চা বানাতেন উনি, কি থাকতো না তাতে! এলাচ, লবঙ্গ, আদা। চলে যাওয়ার পর থেকে একদিনের জন্যও দুধ-চা খাননি স্বপ্নাদেবী। খাননি কি খেতে পারেন নি।

আসলে ওভাবে কেউ ভালোবেসে খাওয়ায়ও নি। ভাবনাটা আসতেই আরেক দফায় বৃষ্টি নামল। গরমের আকাশের এই এক সমস্যা কখন যে কেঁদে ভাসাবে!

"মা আসবো?" - দরজায় বৃষ্টির আওয়াজ পেয়ে উঠে বসলেন স্বপ্নাদেবী। তিন বছর হতে চললো মেয়েটা এসেছে কিন্তু একদিনের জন্যও কোনো টান তৈরী হয়নি। কখনও অতিরিক্ত দুটো কথাও না। আজ বরং দুটো কথা বলে দিল মেয়েটা।

"এসো!" - স্বপ্নাদেবী বলতেই বৃষ্টি ঘরে ঢুকল। হাতে একটা ট্রে। তাতে দুটো সবুজ কাপ বসানো। সবুজ এই কাপদুটো বৃষ্টিই কিনে এনেছিল। ছ'টা কাপ চারশো টাকা দিয়ে। কত শখ ছিল একসাথে সবাই বসে চা খাবে। কিন্তু কোথায় আর সবাইকে এক করতে পেরেছে। স্বপ্নাদেবীই যেন বড্ড একচোরা। নিজের মতো থাকতে ভালোবাসেন। তাই তো তাকে একাই ছেড়ে দেয় বৃষ্টি। আজও কি আসত নাকি কিন্তু আজ ভয়ের থেকেই হোক বা উদ্বিগ্ন হয়েই হোক একটু বাজেভাবে কথা বলে ফেলেছে। নিজের মা হলে এতো চাপই নিত না।

"মা তোমাকে না জিজ্ঞেস করেই চা করেছি! খাবে?" - খুব শান্ত স্বরে বললো বৃষ্টি। স্বপ্নাদেবী দেখলেন দরজায় দাঁড়ানো বৃষ্টি। সত্যিই বৃষ্টির মত লাগছে মেয়েটাকে। স্নান সেরে ভেজা চুলে খুব স্বচ্ছ লাগছে ওকে। ভারী মিষ্টি মুখখানা ওর। প্রথম যখন অর্ক ছবি দেখালো পছন্দ হয়েছিল এক দেখাতেই। কিন্তু স্বপ্নাদেবী জানতেন যত ভালোই মেয়ে আসুক সে কিছুতেই আপন হতে পারেনা। কারণ ছেলেটাই যে ওনার আপন নেই।

"খাবে মা, চা?" - বৃষ্টি আবার জিজ্ঞেস করলো। স্বপ্নাদেবী কি করে বলবেন তোমার শ্বশুরের সাথে সাহেবআমার চা-ও বিসর্জন দিয়েছি আমি। কিন্তু পারলেন না। মেয়েটা শখ করে দু'কাপ চা এনেছে। মনের দ্বন্দ্বটুকু গিলে স্বপ্নাদেবী বললেন, "আরে কেন খাবো না, এসো!"

বৃষ্টি দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে ঢুকল ঘরে। টেবিলের ওপর ট্রে-টা বসিয়ে একদম মুখোমুখি বসলো স্বপ্নাদেবীর। চোখগুলো খুব ফোলা লাগছে। কাঁদছিলেন কি! কিন্তু কেন কাঁদবেন! কি সুখ ওঁনার জীবনে! মোটা টাকার পেনশন, বড় বাড়ি, এরকম নাম-যশ সম্পন্ন ছেলে সেই তুলনায় গরিব তো বৃষ্টির মা-বাবা। কোনোরকমে মেয়েটাকে কোর্সটা করিয়েছিলেন ভাগ্যিস।

"তুমি দুধ চা খাও তো?" - জিজ্ঞেস করলো বৃষ্টি। স্বপ্নাদেবী বললেন "কোনো চা-ই খাই না আজকাল, তবে একদিন খেলে কিছু হবে না!" বলতে বলতে সবুজ কাপটা তুলে নিলেন। তাতে মোটা চায়ের সর ভাসছে।

চোখ বন্ধ করে চুমুক দিলেন। উফফ্ কত যুগ পরে পেলেন সেই স্বাদ, সেই সুখ। এরকমই গাঢ় দুধের চা বানাতেন বিকাশবাবু।

বৃষ্টি দেখছে স্বপ্নাদেবীকে। স্বপ্নাদেবী বললেন, "তোমার শ্বশুরও কি ভালো চা বানাতো! পুরো তোমার মতো!" কথাটা বলতে গিয়ে যেন গলাটা কেঁপে গেল স্বপ্নাদেবীর। চোখদুটো ছলছল করছে। বৃষ্টি চা খেতে খেতে দেখছে স্বপ্নাদেবীকে।

কত সুখী ভাবতো মানুষটাকে বৃষ্টি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ও ভুল ছিল। ভীষণ ভুল। বড্ড কষ্ট ওঁনার বুকটায়। এতো কষ্ট বৃষ্টির মায়ের বুকেও নেই কারণ ওর মায়ের পাশে বাবা আছে।

একাকিত্ব বড্ড মারাত্মক। আর তারই শিকার এই স্বপ্নাদেবী। ইশ্ একটু যদি জানত বৃষ্টি তাহলে এই রোগ তো ওই সরিয়ে দিতে পারত!"

"মা তখন ওভাবে কথা বললাম বলে রাগ করেছো? আসলে ভয় পেয়ে গেছিলাম। অনেকক্ষণ বেল বাজিয়েছি তো!"

বলেই যাচ্ছে বৃষ্টি। চোখ বন্ধ করে মনের সুখে চা খাচ্ছেন স্বপ্নাদেবী। চোখ খুলে বললেন, "কখনো কখনো বাজেভাবে বলা কথাগুলো মন ভালো করে দেয়! কারণ তাতে চিন্তা মিশে থাকে, যত্ন মিশে থাকে। তোমার শ্বশুর সারাদিন এভাবে ঝাঁঝিয়ে কথা বলতেন।"

বৃষ্টি দেখলো এইটুকু সময়ের মধ্যে উনি তিনবার শ্বশুরের নাম নিলেন। আসলে মানুষটাকে বড্ড মিস করেন উনি। তাই বোধহয় এরকম একা করে রেখেছেন নিজেকে। আর সেই সূত্র ধরেই এতো দূরত্ব, এতো ভুল বোঝাবুঝি।

পরিবর্তন করতে হবে অনেক কিছু। নিজে থেকে দায়িত্ব ঘাড়ে নিতে হবে, যেমন অফিসে নেয় বৃষ্টি। পঞ্চুদার চা, শ্যামবাজারের চা সব বন্ধ করে নিজের চায়ের পসার সাজাতে হবে। বৃষ্টি জানে, চায়ের মতো বড় ওষুধ আর হয় না। এই চা-ই পারবে দুজন অজানা মানুষকে কাছাকাছি আনতে, একাকিত্ব দূরে করতে।

দুজন মানুষ দু'দিকে বসে আছে। মাঝে দু-কাপ চা। বৃষ্টি মোবাইলে চালিয়ে দিলো -

ডেকেছি কে আগে?
কে দিয়েছে সাড়া?
কার অনুরাগে
কে গো দিশাহারা?
ডেকেছি কে আগে?
কে দিয়েছে সাড়া?
কার অনুরাগে
কে গো দিশাহারা?
কে প্রথম মন জাগানো সুখে হেসেছি?
তুমি, না আমি?
কে প্রথম কাছে এসেছি?
কে প্রথম চেয়ে দেখেছি?
কিছুতেই পাই না ভেবে
কে প্রথম ভালবেসেছি?
তুমি, না আমি?

বৃষ্টি দেখলো স্বপ্নাদেবী চোখ খুলে তাকালেন। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। তৃপ্তির হাসি। একাকিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার হাসি।