গল্প ও অণুগল্প

স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে



হুমায়ুন কবীর


কমিউনিটি সেন্টারের দ্বিতীয় তলায় সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন শফিকুল ইসলাম। হঠাৎ বুকে হাত দিয়ে বসে পড়লেন। পাশের লোকদের বললেন, আমাকে একটু হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেন - বুকে ভীষণ ব্যথা করছে।

ভাগ্নের বিয়ের অনুষ্ঠানে আর যোগ দেওয়া হল না - দ্রুত হাসপাতালের জরুরি বিভাগে তাকে নিয়ে আসা হল।

কর্তব্যরত চিকিৎসক জিজ্ঞাসা করলেন,

- ব্যথাটা বুকের কোনদিকে?

- বাঁ দিকে।

- কেমন ব্যথা?

- ভারী চাপ অনুভব করছি। শরীর ঘেমে যাচ্ছে, অসাড় হয়ে আসছে।

তারপর বেশ কষ্ট করে উচ্চারণ করলেন, "ডাক্তার সাহেব, ব্যথাটা বাঁ হাতের দিকে প্রসারিত হচ্ছে।"

ডাক্তার সাহেবের পরামর্শে শফিকুল সাহেবের জিভের নিচে একটা ট্যাবলেট দেওয়া হল।

স্ত্রী-কন্যারা ব্যতিব্যস্ত, প্রেসক্রিপশন হাতে ছোটাছুটি করছেন। দ্রুত কিছু জরুরি টেস্ট করতে হবে। ট্যাবলেটটা জিভের নীচে রেখে সাময়িক স্বস্তি বোধ করছিলেন শফিকুল সাহেব। এখন ধীরে ধীরে ব্যথাটা ফিরে আসছে। তার আশঙ্কা হচ্ছে, বড় ধরনের কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। এই মুহূর্তে আপনজন কাছে থাকা জরুরি। স্ত্রী-কন্যা বেশ কিছু আগেই এসেছে। ছোট ভাই আর একমাত্র বোনকে খবর দেওয়া হয়েছে - তারা এখনই এসে পড়বে।

শফিকুল ইসলাম ইংরেজি বর্ণ 'R' লিখে একটা নম্বর সেভ করে রেখেছেন। সেটাতে কল দিয়ে বললেন, "আমি এখন হাসপাতালে। যদি আর..."

কথাটা শেষ করতে পারলেন না। বুকে তীব্র ব্যথা শুরু হলো। কাঁধ, বাহু এবং নীচের চোয়ালের দিকে ব্যথাটা ছড়িয়ে পড়ছে। প্রবল শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ডাক্তারদের চেষ্টা ব্যর্থ হল। শফিকুল সাহেব পরপারে পাড়ি জমালেন।

জন্মিলে মরিতে হবে...। পাঁচজন মরে। শফিকুল সাহেব মরেছে। এ পর্যন্ত শেষ হলে আর কথা ছিল না। এখানেই শেষ নয় - আরও কথা আছে।

শহরের ২৪, ব্লক-বি, কবরি রোডের পান্থশালায় তাঁর মরদেহ আনা হয়েছে। এই ভবনের দৃষ্টিনন্দন গৃহে তাঁর আর জায়গা নেই। লোকজনের ভীড়। ভবনের পাশে রাস্তা ঘেঁষে একটু ফাঁকা জায়গা পড়ে আছে। সেখানেই খাটিয়ায় শায়িত শফিকুল সাহেবের মৃতদেহ। শেষবারের মতো কেউ কেউ দেখে যাচ্ছে। বাড়িশুদ্ধ মানুষের চোখ অশ্রুপাত করে ক্লান্ত। একটু পরেই জানাজার জন্য নিকটস্থ মসজিদ প্রাঙ্গণে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হবে। এই সাধের বাড়িতে তিনি যাদের রেখে যাচ্ছেন তারা বলছে - এভাবে যে চলে যাবে ভাবতেই পারিনি। শুভ্র কাফনে ঢাকা শরীর। মুখখানা উন্মুক্ত করে পশ্চিমে হেলিয়ে রেখেছে। নারী-পুরুষ জনে জনে দেখে যাচ্ছে আর মন্তব্য করছে মিছে এ জীবন। কেউ বলছে জগৎ মায়া বই কিছুই না। সব পড়ে থাকলো, মানুষটা চলে গেল - এইসব ভেবে ভেবে স্ত্রী-কন্যারা কান্নাকাটি করে চলেছে - তাদের সান্ত্বনা দেয় কার সাধ্য?

আত্মীয়-স্বজন সবাই ইতিমধ্যে চলে এসেছে। শফিকুল ইসলামের ভাই বললেন, "আর দেরি না - লাশ নিয়ে যাওয়া যাক।"

চারজন প্রস্তুত, খাটিয়া কাঁধে তোলা হবে।

কে যেন বলে উঠলেন, "একটু ওয়েট করেন। একজন ভদ্রমহিলা আসছেন।"

ভদ্রমহিলার মুখমণ্ডল বোরখায় ঢাকা। দ্রুতপদে এগিয়ে আসছেন। কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। লাশের কাছে এসে তিনি খানিকটা আছড়ে পড়েই বললেন, "তুমি আমাকে এভাবে রেখে যেতে পারলে? আমি এখন...।"

ভদ্রমহিলা কিছুটা উদভ্রান্ত - নিজ হাতেই মুখমন্ডল উন্মুক্ত করলেন। তিনি শোকার্ত। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এই শোকার্ত ভদ্রমহিলাকে শফিকুল ইসলামের স্ত্রী-কন্যা-ভাই কেউ চিনলেন না।

উপস্থিত পাড়া-প্রতিবেশীরা বললেন, "এই মহিলাকে তো আমরা কোনোদিন এ বাড়িতে আসতে দেখিনি।"

ভদ্রমহিলা নিজে থেকেই বললেন, "আমাকে আপনারা চিনবেন না। আমি শফিকুল সাহেবের বিবাহিতা স্ত্রী।"

দমকা ঝড় শুরু হল। শোকাবহ ভারি বাতাস হালকা হল। শফিকুল ইসলামের স্ত্রী-কন্যারা এই আগন্তুক মহিলাকে গায়ে হাত তুলতে বাকি রাখলেন বটে; কিন্তু তাকে উদ্দেশ্য করে যা বললেন তাতে তিনি অগ্নিশর্মা হয়ে উপস্থিত সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন, "আমার বিয়ের কাবিন আছে। এখন বিশ্বাস করুন, পরে কাবিননামা দেখবেন। প্রয়োজন হলে আমি আদালতে যাব।"

বয়োজ্যেষ্ঠরা বললেন, "এ মীমাংসা পরে হবে। শফিকুল ইসলামের খাটিয়া কাঁধে তোলা হল।"

শফিকুল ইসলামকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাঁর চলে যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে আছে প্রিয়তমা স্ত্রী, কন্যা আর প্রতিবেশীরা। এই নবাগত মহিলার অশ্রু টলটল চোখও সেদিকেই।

শফিকুল ইসলামের মরদেহ ঢেকে দেওয়া হয়েছে। একটা বিব্রতকর প্রশ্নের জবাব মেলেনি। সেই জবাবটা অতীব জরুরি। রাতে শফিকুল সাহেবের ভার্সিটি পড়ুয়া ভাইপো রাসেল চাচার রেখে যাওয়া মোবাইলটা নিয়ে কল লিস্ট চেক করছেন। ডায়াল কলে দেখা গেল, চাচা সর্বশেষ একজনের সাথে কথা বলেছে। নম্বরটা ইংরেজি বর্ণ 'R' দিয়ে সেভ করা। কিছু তথ্য ঘেটে জানা গেল 'R' বর্ণ দ্বারা রেবা নামক এক মহিলাকে বুঝতে হবে। ফেসবুকে 'রেবা' নামে একটা আইডি-র সন্ধান মিললো। প্রোফাইলে মহিলার ঠিকানা স্পষ্ট না, তবে তার ফেসবুক ওয়ালে কিছু পোস্ট দেখে অনুমান করা গেল কুষ্টিয়া এলাকায় তার বাড়ি।

মেসেঞ্জারে ওনার সাথে চাচার কিছু সংলাপের সন্ধান পেল রাসেল। একান্ত সংলাপগুলো অনেককিছু স্পষ্ট করে দিচ্ছে। স্ত্রীর পরিচয় দিয়ে যে মহিলা বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে - এই কি সেই মহিলা?

নম্বরটিতে একটা কল দিল রাসেল।

- আচ্ছালামুয়ালাইকুম।

- ওয়ালাইকুম আচ্ছালাম।

- আপনার পরিচয় জানতে পারি কি?

- পারেন।

- আপনার বাসা কি কুষ্টিয়ায়?

- জী... কেন বলুন তো?

- আচ্ছা, গতকাল দুপুরে শফিকুল ইসলাম নামে কারও সাথে কি আপনার কথা হইছে?

- জী... হইছে।

- উনি আপনার কে?

- আমার স্বামী। গতকাল মারা গেছেন।

সত্য ঘটনাও অনেক সময় বিশ্বাস হতে চায় না। রাসেলের মনে সেই এক প্রশ্ন - সত্যিই কি চাচা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন? প্রমাণ মিলেছে; তবু আরও নিশ্চিত হতে চায় রাসেল।

দিনে এ বিষয়টা নিয়ে খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে অবাক হল রাসেল। চাচার ডায়েরি বইয়ের পাতায় একটা প্রেমপত্র আবিষ্কার হলো। প্রেমপত্রটা এমন -

প্রিয় রেবা,

আমার কাছে তুমি মানেই
ছুঁতে না পারা অসীম আকাশ।
আমার কাছে তুমি মানেই
চোখ নির্ঘুম আষাঢ়ের মাস।

ইতি,
শফিকুল

যতটা জানা গেল শফিকুল ইসলাম গত দু'বছর হলো বিয়েটা করেছেন। বেশ ক'বছর থেকে তার অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ ভালো। অনেক টাকা নাড়াচাড়া করতেন তিনি। অনেক সময় টাকাওয়ালা বাঙালি পুরুষেরা মধ্য বয়সে দ্বিতীয় বিয়ে করে বসে। শফিকুল সাহেব করবে তা অসম্ভব না। মাঝেমধ্যে তিনি ট্রেনে-বাসে কুষ্টিয়া যেতেন - এমন তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। রাসেল তার চাচীর সাথে এ বিষয় নিয়ে কথা বললেন। চাচী শুধু এতটুকুই বললেন যে, বিয়ের বিষয়টা ঘুনাক্ষরেও জানেনি সে। তবে মাঝেমধ্যেই তিনি বাসায় থাকতেন না। বলতেন, অফিসের কাজে ট্যুরে যাচ্ছেন।

সহসা বলতেন, ঢাকায় সাত দিনের ট্রেনিং আছে।

শফিকুল ইসলামের মেয়ে মায়ের কথা শুনছেন। চাচাতো ভাই রাসেলের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসা তথ্য শুনছেন। নিজে কোনো কথা বলছেন না। মা-মেয়ে দুজনেই শোকাভিভূত। মেয়ের চোখে জল, মায়ের চোখে জল। একইসাথে একটা বড় জিজ্ঞাসাবোধক চিহ্ন তাদের মনে। উপন্যাসের পাতায় রাসেল পড়েছে নারীর মন এক ঘন গহীন বন। একরাশ রহস্যময়তা নারীকে আড়াল করে রাখে - পুরুষের সাধ্য কি নারীর মন বোঝে? ওদিকে শফিকুল ইসলামের স্ত্রী ভাবছেন পুরুষ মানুষের মন তো তা না। নাকি তার স্বামী পুরুষটি এর ব্যতিক্রম? তিনি যে এহেন এক কাজ করে বসলেন, তা একটিবারের জন্য জানতেই পারলাম না? মনের কথা মনেই রাখলেন, একটিবারের জন্যও বললেন না? এতদিন সংসার করেও তার মন চিনলাম না। হায়রে! পুরুষের মন!

অশ্রুসিক্ত চোখ মুছতে মুছতে মেয়ে মা'কে প্রশ্ন করল, "মা, বাবা বিয়েটা করতে গেলেন কেন?"

মা কোনো উত্তর করলেন না।

অফিসের বড় কর্মকর্তা চাকরি বিধিমালা মোতাবেক দুই স্ত্রীর মধ্যে সমান হারে পেনশন চালু করলেন। এই বিভাজনে প্রথমা স্ত্রীর মনে কষ্ট বেশি হল। সে মনে করল সব অংশটাই তার প্রাপ্য - কোথা থেকে একজন উড়ে এসে জুড়ে বসল।

প্রথমা স্ত্রীর সংসারে অভাব। মেয়েটাকে বিয়ে দিতে পারেনি। অর্ধেক পেনশনে ভালোমতো চলে না। একসময় মেয়ের প্রশ্নের জবাব দেন নাই এখন সেই জবাবটা মুখ থেকে বেরিয়ে আসে। মাসের শেষে তাকে বলতে শোনা যায়, হায়! পুরুষ মানুষের মন - কোন বিশ্বাস নাই!