প্রবন্ধ

তুমি কৈকেয়ী [পুস্তক আলোচনা] (সপ্তম পর্ব)



কাকলী দেব


।। ৭ ।।

যুদ্ধ শুরু হল! তুমি প্রথম দিন একবার আস্তাবল ঘুরে দেখে এলে, কী অপূর্ব, বলশালী ঘোড়ার সংগ্রহ আছে রাজার! প্রত্যেকটা ঘোড়ার কাছে গিয়ে তাদের আদর করলে! তোমার পেছনে, আস্তাবলের প্রধান রক্ষক অশ্বসেন এসে দাঁড়াল। তোমাকে কুর্নিশ জানিয়ে বলল, "মহারানীর নিজের দেশে অনেক সুন্দর সুন্দর অশ্ব পাওয়া যায় আমি শুনেছি। আপনি এদের ভালবাসেন, আমি দেখেই বুঝেছি। সবাই পারেনা। এই প্রাণীরা ভালবাসার বশ!" তুমি বললে, "এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ঘোড়ায় একবার চড়তে চাই।" রাণীর আদেশ উপেক্ষা করেনা অশ্বসেন, একটি ঘোড়াকে সামনে নিয়ে আসে। তুমি, তার গলায় হাত বুলিয়ে নিমেষে তার পিঠে চড়ে, তাকে ছুটিয়ে নিয়ে যাও। দূরন্ত গতিতে তাকে ঘুরিয়ে, আবার আস্তাবলে ফিরিয়ে আনো। অশ্বসেন মুগ্ধ বিস্ময়ে তোমাকে দ্যাখে।

রাজার রথ চালকের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে দশরথ প্রথম দিন বিপর্যস্ত ছিল। অশ্বসেনের অনুমোদনে রাজা, তোমাকে রথ চালানর অনুমতি দিল। অশ্বসেনের কথা অনুযায়ী, এমন আশ্চর্য ঘোড়সওয়ারী সে আগে দেখেনি। তার ও পরের দিন রাজার সঙ্গে রথ দেখতে এলে। কাঠের তৈরী বিশাল রথ, তার গায়ে চমৎকার কারুকার্য করা। রথের সারথী প্রথমে, আর তার পেছনে যোদ্ধার বসার আসন। তোমার এই নতুন দায়িত্ব পেয়ে, তুমি যৎপরোনাস্তি খুশি হয়েছো। রাজার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকলে। রাজার যত সেনাপতি, মন্ত্রীদের অগ্রাহ্য করেই তিনি তোমাকে এই গুরু দায়িত্ব দিলেন। তুমি নিজের মনে প্রতিজ্ঞা করলে, এর সঠিক প্রতিদান তুমি রাজাকে ফিরিয়ে দেবে।

পরদিন সূর্য ওঠার অনেক আগেই উঠে, স্নান করে, সূর্য প্রণাম করে যুদ্ধের উপযুক্ত বর্ম, শিরস্ত্রাণ পরে প্রস্তুত হয়ে রইলে। 'আশা' এসে তোমাকে দেখে অবাক হল, বলল, "রাণীমা, আপনাকে এই পোষাকে খুব মানিয়েছে!" বলেই আবার তোমাকে খুশী করার জন্য তাড়াতাড়ি বলে উঠল, "আসলে, আপনি যাই পরেন, আপনাকে খুব সুন্দর লাগে!"

ভোরের আলোয় যুদ্ধক্ষেত্রকে একদম অন্য রকম লাগছে। মনে হচ্ছেনা, এই ধরনীতে হিংসার কোনও স্থান আছে! কিন্ত কিছুক্ষণ পরেই জায়গাটা বীভৎস রণভূমিতে পরিণত হবে!

রথে উঠে বসলে তুমি এবং রাজা দশরথ। তুমি দুরন্ত গতিতে রথ ছোটালে। রাজা পেছন থেকে তোমাকে, সাবাশি জানালেন, তুমি আরও উৎসাহিত হয়ে উঠলে।

চারিদিক থেকে অস্ত্রের ঝনঝনানি, বীভৎস মরণ আর্তনাদ ভেসে আসছে, ছিন্ন মুন্ড সৈনিকদের দেহ যত্রতত্র, রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে! সত্যিকার যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিল না, তাই এসব দেখে শরীরের ভেতর বিবমিষার ভাব হচ্ছে!

রাজা হঠাৎ বললেন, "কৈকেয়ী রথের গতি ধীরে করো, ঐ তো ডানদিকে শম্বাসুরকে দেখা যাচ্ছে! কী ভীষণভাবে আমার সৈনিকদের হত্যা করছে!"

তুমি ডানদিকে রথ ঘোরাতে গেলে, সেই মুহূর্তেই রথের বাঁ দিকের চাকা নরম মাটিতে বসে গেল। ক্ষিপ্র গতিতে নামলে লাফিয়ে। তোমার হাতের জোর নিয়ে, যুধাজিত মজা করেছে কত! তোমার কব্জির জোর নাকি পুরুষের মত, আজ তার আসল পরীক্ষা হবে! সমস্ত শক্তি দিয়ে রথের চাকা তুলে ধরলে, আবার দ্রুত গতিতে রথ ছোটাতে যাবে, এমন সময় শম্বাসুরের তীর এসে রাজার বুকে লাগল, তুমি দ্বিধা করলেনা আর, রাজার হাতের তরবারী ছিনিয়ে নিয়ে রথ চালালে সোজা শম্বাসুরকে লক্ষ্য করে। দিলে তোমার তরোয়াল চালিয়ে শত্রুকে লক্ষ্য করে। ফালাফালা করে দিলে ওকে। নিমেষেই ঘটে গেল এতসব। পেছনে রাজার গোঙানির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, রাজাকে বললে, "একটু ধৈর্য ধর রাজা, আমি এক্ষুনি তোমাকে শিবিরে নিয়ে যাচ্ছি।" শিবিরে পৌঁছে গেলে, যত সেনাপতি, মন্ত্রী, অমাত্যরা আছে সবাই এসে রাজাকে ধরাধরি করে নিয়ে গেল, চিকিৎসার কক্ষে। তুমিও ছুটে গেলে ওদের সঙ্গে। মহাবৈদ্যরা, সবাই রাজাকে ঘিরে ধরে চিকিৎসা শুরু করল কিন্ত কক্ষে তোমাকে প্রবেশ করতে দিলনা ওরা। তুমি, পাশের কক্ষে মাটিতে শয্যা নিলে। ধুলিধূসরিত শরীরে অপেক্ষা করতে লাগলে। 'আশা' এসে তোমাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করতে লাগল! কিন্ত তোমার মুখে এখন কিছুই রুচবেনা। তাই বারণ করে দিলে।

কিছুক্ষণ পরে, প্রধান বৈদ্য বেরিয়ে এসে বললেন, "রাজাকে যদি ঠিক সময়ে এখানে না আনা হতো, তাহলে হয়ত বাঁচানো সম্ভব হতো না।" শুনে তোমার ধড়ে প্রাণ এল। তুমি রাজবৈদ্যকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে, "কেমন অবস্থা এখন?" আশা করছি, "দুদিনের মধ্যে অবস্থা স্থিতিশীল হবে, অনেকটা রক্ত ক্ষরণের ফলে ওনার নাড়ীর গতি খুব ক্ষীণ!"

তুমি দুদিন ধরে উপবাস করে রইলে, আর কায়মনোবাক্যে
রাজার দীর্ঘায়ু প্রার্থনা করতে লাগলে, এই বিশ্ব চরাচরের কাছে। কারণ তোমার তো নির্দিষ্ট দেবতা কেউ নেই! এই খোলা আকাশ, এই মধুর বাতাস, এই সবুজ অরণ্য, এই নদীর জলোচ্ছ্বাস, এরাই তোমার ঈশ্বর! 

তৃতীয় দিন, মহামন্ত্রী তোমাকে ডাকতে এল। মহারাজ তোমার নাম ধরে বারবার ডাকছেন, যদিও এখনও ঘোর কাটেনি।

তুমি, রাজার চিকিৎসা কক্ষে যাবার আগে স্নান করলে, পরিস্কার কাপড় পরলে, তারপর প্রধান বৈদ্যের সঙ্গে কথা বললে, জেনে নিলে কতটা কথা বলা উচিত, রাজাকে ঠিক কী ঔষধ দেওয়া হচ্ছে এখন ইত্যাদি!

রাজা তন্দ্রাচ্ছন্ন, বুকের ওপর মলম পট্টি লাগানো কাপড় জড়ানো! তুমি গিয়ে নিঃশব্দে শয্যার পাশে দাঁড়ালে! রাজা চোখ মেলে তোমার দিকে তাকাল আর হাত ধরতে চাইল!

তুমি রাজার হাত ধরলে শক্ত করে। বেশী কথা বলা একদম উচিত নয় এখন তাই আঙুলের ইশারায় রাজাকে চুপ করে থাকতে বললে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলে। এই এক বছরে, মানুষটাকে ভালবেসেছ, তার ধীর স্থির স্বভাব, মৃদু অথচ দৃঢ় ব্যাক্তিত্ব, মার্জিত কথাবার্তার জন্য। মানুষটা সুস্থ হয়ে উঠছে, এর থেকে বড় আনন্দ এই মুহূর্তে আর কিছু নেই। শিবিরের লোকজন সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে।

তিনদিন পরে তুমিও খাবার মুখে দিতে পারলে!

পরদিন আবার গেলে রাজাকে দেখতে। এখন চিকিৎসা কক্ষ থেকে সরিয়ে তাকে শুশ্রুষা কক্ষে রাখা হয়েছে। দিনরাত তার সেবায়, সেবাকর্মীরা ব্যস্ত। আজ রাজাকে অনেক সুস্থ দেখাচ্ছে। তোমাকে নিজেই হাত ধরে বসালেন। "কৈকেয়ী আমাকে সব সত্যি করে বলো তো ? শম্বাসুর নিহত হল কেমন করে? তার বুকে, আমার নাম খোদাই করা তরোয়াল বিঁধে আছে কিন্ত আমার তো স্পষ্ট মনে আছে তার তীরের আঘাতে আমি যখন মূর্ছিত প্রায়, তুমি দ্রুত রথ ছোটালে! তাহলে কে তাকে আমারই তলোয়ার দিয়ে বধ করল?"

রাজার বড় বড় জিজ্ঞাসু চোখ তোমার মুখের ওপর, মুখে যেন সামান্য হাসির আভাস! তুমি মিথ্যাচার শেখোনি, তবে এক্ষেত্রে সত্যি কথা বলতে তোমার ভয় হচ্ছে! রাজা কি রাগ করবেন, সত্যিটা শুনলে! এই অসুস্থ অবস্থায়, শরীরের কোন রকম উত্তেজনা তো ঠিক হবেনা। এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে থাকো। রাজা বলে ওঠেন, "আমি জানি কৈকেয়ী, শম্বাসুরের সৌভাগ্য যে সে তোমার হাতে মৃত্যু বরণ করেছে!"

তুমি বলে ওঠ, "কিন্ত, বাইরে এইকথা জানাজানি যেন না হয়, আপনার সেনাপতি মন্ত্রীরা জানে তাকে আপনিই মেরেছেন এবং সেই সময়ই আহত হয়েছেন। কারণ আপনার রাণী রথ চালাতে পারে, কিন্ত মানুষকে হত্যাও করতে পারে, একথা জানলে হয়তো আপনার সম্মানহানি হবে!"

"ঠিক আছে তবে, তাই হোক! তবে তুমি আমার জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যা করলে, তাতে আমার তোমাকে অদেয় কিছুই থাকবেনা। বল, তুমি কি চাও? আমি তোমাকে দুটি বর দিতে চাই!"

"আমার কিচ্ছু চাই না, তুমি আমাকে, তোমার সব রাণীদের থেকে বেশী ভালবেসো তাহলেই আমি খুশী!"

এরপরও রাজার জোরাজুরি তে বলতে বাধ্য হলে, "ঠিক আছে, এখন কিছু চাইনা, যখন সময় হবে, ঠিক চেয়ে নেব।"

(ক্রমশ)

গ্রন্থের নামঃ কৈকেয়ী (Kaikeyi: A Novel)
লেখিকাঃ বৈষ্ণবী প্যাটেল (Vaishnavi Patel)
ভাষাঃ ইংরাজী
প্রকাশকঃ রেডহুক (Redhook)
বাঁধাইঃ পেপারব্যাক
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৫১২ পাতা
মুদ্রিত মূল্য (ভারতীয় মুদ্রায়): ১,৭৩৪ টাকা