বিবিধ

খাল-বিলের আখ্যান (দ্বাদশ পর্ব)



মমতা বিশ্বাস


দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ শীতকালীন ফসলে অপরূপা হয়ে ওঠে। বঙ্গজননী তার মধুমাখা রঙিন শীতল আঁচলখানি বিছিয়ে রাখে যেন। কোথাও গাঢ় সবুজ, কোথাও হাল্কা সবুজ, কোথাও সোনালী বরণ, কোথাও বিবর্ণ। মায়াময় সে চিত্র জাদু জানে। সে জাদু সবাইকে সম্মোহিত করতে পারে না। প্রকৃতি দেখার চোখ যার আছে; সেই ধন্য হয়। ফাল্গুনে ফসল পেকে ওঠে। দুপুরে বঙ্গজননীর সোনালী আঁচল সোনা রোদ ঝিকিমিকি করে। সমস্যা তৈরি হয় ফসল বাড়িতে আনতে। কোনো কোনো জমি তিন/চার ফসলি। বৃষ্টির না হলে সেচ দিয়ে ফসল কাটার পর পর অন্য ফসল রোপন/বপন হয়ে যায়। অতীতে একটা ফসল উঠে যাওয়ার পর জমি ফাঁকা পড়ে থাকত। গরুর গাড়ি, মোষের গাড়িতে ফসল বাড়িতে এনে ঝাড়ায়- মাড়ায় করতে অসুবিধা হত না। ট্রাক্টর, ঝাড়ায় মেসিন চাষির পরিশ্রম কমিয়ে দিয়েছে ঠিকই; তবে নতুন সমস্যাও দেখা দিয়েছে। ফসল ঝাড়ায়-মাড়ায় করে, শুকিয়ে মাথায় করে বয়ে আনতে হয়। মুনিষের খুব অভাব। বোঝা টানার কাজ কেউ করতে চায় না। দুই /একজনের গরুর গাড়ি আছে। তারা ফসল টানার কাজ করে। পরির মতো ক্ষুদ্র চাষীরা মাথায় ক'রে অথবা সাইকেলে ক'রে ফসল বাড়িতে আনে। কয়েক হাজার বিঘের বিলের মাঠে একটা রাস্তা থাকা খুব দরকার। অনন্ত ফরেস্ট পর্যন্ত। থগবগের খাল থেকে চূর্ণীনদী পর্যন্ত খাল কাটা যেমন জরুরি; তেমনি একটা রাস্তা ও দরকার। এসব আলোচনা চাষিরা মাঠে, তেমাথায়, চৌমাথায় করে; কিন্তু কীভাবে হবে - সে রাস্তা কেউ বাতলাতে পারে না। অবশ্য সম্পদ মাস্টার বলে, "তোমরা যদি একটু স্বার্থ ত্যাগ করার উদারতা দেখাতে পার তবে খালটা হয়ে যাবে; রাস্তাটাও। উঠে দাঁড়িয়ে বল তো কে কে রাজি?

উঠল না একজনও। দুই/একজন মুখে আশ্বাস দেয় শুধু।

সম্পদ মাস্টার বলে, "তোমাদের রাস্তাও হবে না; খাল ও না।"

ফসলের গাড়ি যাওয়া-আসা নিয়ে ঝগড়া-গণ্ডগোল বারোমেসে সমস্যা। শিবরাত্রির দিন বিপদভঞ্জন, বারিনের তিলের জমির মধ্যে দিয়ে সর্ষের গাড়ি নিয়ে গেল। সেচ দেওয়া জমিতে তিলের চারা সবে মাটির উপর সবুজ ছাউনি দিয়েছে। চাকার চাপে তিলগাছ থেঁতলে গেছে। গাড়ি নিয়ে যাবে - সে কথা শোনার প্রয়োজন বোধ করেনি। পরের গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় খিস্তিখামারি হয়ে গেছে।

"এর একটা হেস্তনেস্ত করতেই হইব।"- চৌমাথায় এসে বারিন বলে।

শান্ত মানুষ রেগে গেলে যা হয়, বারিনের অবস্থা তাই। তাঁতিয়ে দেওয়ার লোকের অভাব নেই।

হরেন বলে ওঠে, "বারিন ওই বিপদভঞ্জন মাস্টার রে ছাইড়া দিও না। অর বাপ আর তালুক ডাক্তারের জন্ন্যিই সেই সুমায় মাঠের হওয়া রাস্তা বন্দ হইল।"

"হ' বাপের কাচে শুনচি। ছাড়ুম না। মাস্টারি মারাচ্ছে। শিক্ষিত ! বড়োলোক! মুখ দিয়ে কী বাইর হয়। কানে আঙুল দিউন লাগে। ওর জমির আল দিয়া একটা মানুষ হাঁটতে পারব না! মোড়ল হইচে? মানে কিডা?"

"মাথা গরম কইরো না বারিন।"

"মাথা গরমের কিচ্ছু দেখ নাই। অন্যায় করচে, নত না হয়ে -বাপ- মা তুইল্যা খিস্তি দিবো। বয়সে বড়ো তাই কী ? মানুম না। সামনে পাইলেই মারুম। বাপ-মা তুইল্যা কথা কয়!"

পরি, বারিনরে এট্টু বুঝায়া কও - ওর গায় য্যান হাত না দেয়। চণ্ডাল ! মাথা গরম হইলে কিচ্চু ঠিক থাকে না। রক্তারক্তি হইব?"

"তুমি আবার এর মধ্যে আসলে ক্যান কাকি। বাড়ি যাও। আমরা আছি।"

 শ'খানেক লোক জড়ো হয়ে গেছে ক্লাবের সামনে। পরি বিপদভঞ্জনের মাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে পাড়ায় একটা মিটিং ডাকার প্রস্তাব রাখে। মিটিং - এর প্রধান আলোচনার বিষয়, অঞ্চলে খাল সংস্কারের জন্য টাকা এসেছে। খাল তাদের। কাজ বুঝে নিতে হবে।

খাল-বিল সংরক্ষণের সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য যে কটা সংগঠন তৈরি হয়েছে সম্পদ মাস্টার সবগুলোকে একছাতার নীচে আনার চেষ্টা করছে। কয়েক বছর হয়ে গেল অঞ্জনা, পলদা সংস্কারে টাকা বরাদ্দ হয়েছ। রাজনৈতিক তর্জায় কিচ্ছু কাজ হয়নি। টাকাটা সরকারের ঘরে ফেরত যায়নি। টাকাটা কোথায় আছে, সেটাও জানা যাচ্ছে না। তাই পরিরা এই সকল খাল-বিল বেষ্টিত গ্রামের মানুষদের নিয়ে মিটিং করবে। নিজেদের ন্যায্য পাওনা কড়ায় গণ্ডায় আদায় করে নেওয়ার লড়াই। উন্নয়নের জন্য যে টাকা বরাদ্দ হয়; তা তো জনসাধারণের ট্যাক্সের টাকা, জি এস টির টাকা। এক প্যাকেট মুড়ি কেনে তাতেও সরকার ট্যাক্স কাটে। সে টাকা তারা নেতাদের পকেট বোঝায় হতে দেবে না। পাড়ার রাস্তাটা যে পিচের; বোঝার উপায় নেই। মাটির মধ্যে খোয়া পোতা রাস্তা। নাম মাত্র পিচ দিয়ে রাস্তা বানানোর ফল। প্রমোটারের রাজপ্রাসাদে অ্যাকোয়ার জলে রাজকন্যের স্নান হয় ! এসব কথা এলাকার সবাই জানে।

(ক্রমশ)