বিবিধ

আরণ্যক জীবন ছুঁয়ে



অমিতাভ বিশ্বাস


সুচেতনা তুমি কি দোতলা ঘরের খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছো? ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছি আমি। দোতলা থেকে নেমে এসে আমাকে কুড়িয়ে নাও। সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ে পা ঝুলিয়ে বসবো আমি। আমার পথশ্রম, ঝক্কি-ঝামেলা ধুলোবালি পরিষ্কার করে নেবে একটি পাহাড়ী মেয়ে। তার নাম ঝর্ণা হতে পারে...। তার নাম তোর্ষা হতে পারে...। গায়ে তার পাহাড়ের গন্ধ। সমতলে তার অন্য নাম...। আমার স্পর্ধা ক্ষমার যোগ্য কিনা জানি না। আজ খোলামনে আমার আরণ্যক জীবনকে ছুঁয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতার খসড়া পত্র লিখব। ইচ্ছা করলেই তোমার নরম হাত ছুঁতে পারবে আমাকে। তোমার হাতে যদি অঢেল সময় থাকে আমাকে পাঠ করো - একটা ডাক পাখি আমার পত্রটা নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে যাবে।

আজ কবিতা থেকে পালিয়ে গিয়ে সমুদ্রের উথাল-পাথাল ঢেউ বলব। আজ কবিতা থেকে পালিয়ে গিয়ে সমুদ্রমুগ্ধ রাখালের কথা বলব। আর বলব সমুদ্র সৈকতে পড়ে থাকা কড়ি ও ঝিনুকের কথা। অন্ধকার রাতে শিশির ঝরে পড়ে। আর তারই ছোঁয়াতে অরণ্যের গভীর থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ হয়েছে অধীর। কোথায় লুকিয়ে ছিল এত গান? চোখের এই দরদ মাখা প্রশান্তি কোথায় ছিল এতদিন? কোথায় ছিল বাগানের এই রাশি রাশি ফুল? নদীতে হারায় মন, শেষে নদীতেই ফিরে পায় জীবন - এ এক অদ্ভুত খেলা জীবন মরণ...!

উৎসবের উগ্র উন্মাদনা আর বাঙ্ময় রজনীর ব্যভিচার পেরিয়ে, নদীর উঁচু বাঁধ আর বাঁশের ভাঙা সাঁকো পেরিয়ে কালো কুচ্ কুচে সেই রাখাল ছেলে অবসর লগ্নে সমুদ্র সৈকতে বসে আছে। বসে আছে, আর সমুদ্র সৈকতে বসে বসে তর্জনীর আঁচড় কেটে কি যেন লিখে চলেছে। আকাশে তখন ধারালো এক ফালি চাঁদকে ঘিরে লাজুক মেঘেরা উঁকি দিচ্ছে। আর সমুদ্রে তখন মহাকাব্যিক গল্পকথার উথাল-পাথাল...। শিরিশকালো সমুদ্র মুগ্ধ সেই রাখাল ছেলে সমুদ্র সৈকতের তর্জনীর আঁচড় কেটে লিখে চলেছে গুপ্ত কথা - ব্যাপ্ত কথা। লিখে চলেছে সমুদ্র সৈকতে হাজার পাতা। সেই সকাল থেকে ভাবছি কিছু বলব। আমার সচেতন আমি সম্পর্কে কিছু বলব। আরণ্যক জীবনে বজ্র-বৃষ্টির কথা বলব। আরণ্যক জীবনে দ্বান্দ্বিক শব্দের বৃষ্টি পড়ে - আর যখন সেই বৃষ্টি পড়া শুরু হয়, তখনই আমার শৈশবের কথা মনে পড়ে যায়...।

শৈশবে মার কাছে শেখা কথাগুলো গেঁথে আছে মস্তিষ্কে। আর সেই কথাগুলো কাজের সঙ্গে মিশে যায় সচেতন ভাবে। সদা সত্য কথা বলবে, সত্য পথে চলবে, মিথ্যা কথা বললে পরে জিভ খসে পড়বে। জিভ খসে পড়তে পারে, সেই ভয়ে একটাও মিথ্যে কথা বলিনি আমি। অতঃপর অরণ্যপথে ঘুরে ঘুরে পাহাড় থেকে সমুদ্রে জল গড়িয়েছে বিস্তর। আরন্যক জীবনে দাঁড়িয়ে সতেজ ক্লোরোফিল অভিজ্ঞতার চোখ দিয়ে আমি অনেক দেখেছি, জেনেছিও অনেক। সেই সকাল থেকে ভাবছি কিছু বলব। ক্লোরোফিল চোখে আমার দেখা ও জানা সম্পর্কে কিছু বলব -

আমি তেলে ভাজার দোকান দেখেছি। আবার সেই তেলে ভেজালও দেখেছি। আমি দুধে জল মেশাতে দেখেছি। আমি ডিজেল পেট্রলের দাম দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখেছি। আমি তেলা মাথায় তেল দিতে দেখেছি। আমি নিমক দেখেছি - হারাম দেখেছি। আমি বিষ জানি, বৃক্ষ জানি। আমি অমৃত জানি, গরল জানি। আমি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ দেখেছি। আমি নিঃস্ব মানুষের তালগাছ দেখেছি। আমি টাকা পয়সার স্ফীতি দেখেছি। আমি বাচ্চা ছেলের হিশি দেখেছি। আমি রাম রহিমের সর্বনাশ দেখেছি। আমি যদু-মধুর পোষ মাস দেখেছি। আমি তাবড়-তাবড় নেতা দেখেছি। আমি ভোটে তাদের জেতা দেখেছি। আমি রাম-ভক্ত হনুমান দেখেছি। আমি দেশের প্রতি তাদের টান দেখেছি। আমি নরোত্তম দেখেছি, নরাধম দেখেছি।আমি ব্ল্যাকমানি দেখেছি, হানাহানি দেখেছি। আমি মানব অধিকার নিয়ে মাত্ তে দেখেছি। আবার সেই অধিকার ভাঙ্ তে দেখেছি। আমি জীবনমুখী গান শুনেছি। আমি মৃত্যুমুখী প্রাণ দেখেছি। আমি রবি ঠাকুরের 'ফাঁকি' পড়েছি। আমি সরকারী কাজে ফাঁকি দেখেছি।

আমি চিন জানি, জাপান জানি। আমি নরত্তয়ে জানি, রোপত্তয়ে জানি। আমি ভূ-স্বর্গ জানি, কাশ্মীর জানি। আমি ভূগর্ভ জানি, জানি কয়লার খনি। আমি ষ্টেনগান জানি, ষ্টোনম্যান জানি। আমি বোলিং জানি, ব্যাটিং জানি। আমি গয়া জানি, কাশি জানি। আমি কাশির জন্য বাসক ও তুলসিপাতা জানি। আমি মক্কা জানি, মদিনা জানি। আমি ব্যাবিলন জানি, বেথেলহেম জানি। আমি কর্মসূচী জানি, সব্যসাচী জানি। আমি নিরক্ষরতা ও স্বাক্ষরতা দুই-ই জানি।

আমি বৈকুন্ঠের খাতা জানি। আমি হল্লা বল্লায় মাথা জানি। আমি গুলিবিদ্ধ রক্ত জানি। আমি ঠগেরা অতি ধূর্ত জানি। আমি 'মোহরা'র মস্ত্-মস্ত্ জানি। আমি সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত জানি। আমি মেঘে ঢাকা তারা জানি। আমি ঘুমিয়ে আছে কারা জানি। আমি অপমানের তীব্র দহন জানি। আমি ভোটের নামে প্রহসন জানি। আমি উৎকণ্ঠা ভরা রাত্রি জানি। আমি বেকারের দুঃসহ যন্ত্রণা জানি। আমি প্রশস্ত সাগরের শান্ত জানি। আমি আবিরে রাঙা বসন্ত জানি। আমি চোখের জলের উষ্ণতা জানি। আমি মিঠেল হাতের স্পর্শ জানি। এ কথা আমি ভালো করে জানি - তাই আমি আমার সচেতন আমি।

পকেটমারকে পকেট কাটতে দেখেছি। আমি চোখে ধুলো দিয়ে পালাতে দেখেছি। আমি সুচেতনার কপালে তিনটে তিল দেখেছি। আমি ধানী মাঠাল জমিতে লম্বা বিল দেখেছি। আমি কাতুকুতোর হাসি খিল্-খিল্ দেখেছি। আমি মিটিং এর আগে বড় মিছিল দেখেছি। আর সেই মিছিলের মধ্যে জনসমুদ্র দেখেছি।

আমি আসরে বসে কবিতা পাঠ দেখেছি। আমি তেপান্তরের ফাঁকা মাঠ দেখেছি। আমি শিশিরে ভেজা দুঃস্থ কবিতা দেখেছি। আমি বৃষ্টি ভেজা দৃপ্ত সবিতা দেখেছি। আমি পদস্খলনের অন্ধকার সোপান দেখেছি।আমি উৎসবের উগ্র উন্মাদনা দেখেছি। আমি বিষর্জনের বিষন্ন প্রতিমা দেখেছি।

আমি বুকের ভাজা পাঁজর দেখেছি। আমি হার হিম করা খবর জানি। আমি দেশ জানি, বিদেশ জানি। আর আমি একথা ভালো করে জানি - এই আমি আমার সচেতন আমি...। - এই আমি সমুদ্রের উথাল-পাতাল ঢেউকে পাশে রেখে সমুদ্র সৈকতে তর্জনীর আঁচড় কেটে লিখে চলেছে গুপ্ত কথা, ব্যাপ্ত কথা। লিখে চলেছে সমুদ্র সৈকতে সহস্র পাতা। এই আমি, সচেতন ক্লোরোফিল চোখে আর আরন্যক জীবনকে ছুঁয়ে অভিজ্ঞতার সমুদ্রে হেঁটে হেঁটে আর সাঁতরিয়ে সাঁতরিয়ে অনেক দেখেছে। অনেক জেনেছে। এই আমি অনুভাবনায় ভাবিত হয়ে আত্মান্বেষণে গভীরভাবে মগ্ন থাকে। হে ক্ষমাসুন্দর শ্রদ্ধেয় গুণীজন, গুস্তাকী মাপ। আমার সচেতন আমিকে আরো সচেতন করো - আলো, বায়ু আর জল দিয়ে। আমার আরণ্যক জীবনকে ছুঁয়ে থাক নরম আলো। শ্যামল আত্মীয়তা। ক্লোরোফিল নখ।