বিবিধ

মহাভারতের নারী চরিত্রঃ আজ গান্ধারীর কথা



স্বপ্না সেন



গান্ধারী ও তাঁর এক পরিচারিকা (১৯১৯)। শিল্পীঃ নন্দলাল বসু।

গান্ধারী ও কুন্তী এই দুই নারী চরিত্রকে মহাভারতের গণ্ডি অতিক্রম করে বাঙালি সমাজে এক নতুন মানবিক অবস্থানে উজ্জ্বল করে তুলেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর লেখা গান্ধারীর আবেদন অথবা কর্ণকুন্তী সংবাদ পড়ে মাতৃহৃদয়ের দুটি ধারা আমরা অনুভব করেছি এই দুই কবিতায়। কিন্তু ব্যাসদেবের লেখনী যদি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে গান্ধারী বা কুন্তী সম্পর্কে অন্য পর্যবেক্ষণ চলে আসে। গান্ধারী সম্পর্কে এই অন্য ভাবনাটি আজ তুলে ধরব। কুন্তী সম্পর্কে আগামীতে।

গান্ধারী গান্ধাররাজ সুবলের কন্যা। তিনি সুন্দরী ও বিদুষী। গান্ধার কন্যা বলে তাঁকে গান্ধারীও বলা হয়। ভীষ্মের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সুবল বাধ্য হন হস্তিনাপুরের রাজা অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের সাথে কন্যার বিবাহ দিতে। সুবল অত্যন্ত তেজী আত্মাভিমানী রাজা ছিলেন। ভীষ্মের কাছে পরাজিত হয়ে গান্ধারীকে অন্ধ রাজার সাথে বিবাহ দিতে তিনি রাজি ছিলেন না। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ভীষ্মকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। তাঁর পুত্ররা নিহত হয় এবং তিনি বন্দী হন। কারারুদ্ধ অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর অস্থি দিয়ে পাশা তৈরি করে সুবলের একমাত্র জীবিত সন্তান শকুনি গান্ধারীর সাথে হস্তিনাপুরে আসেন।

ব্যাসদেব অত্যন্ত নির্লিপ্ত ভাবে ঘটনাটি বিবৃত করেছেন। শকুনির মনে সেই মুহূর্তে কি ভাবনা কাজ করেছিল অথবা গান্ধারী যিনি সদ্য পিতৃহীন হয়েছেন এবং যাঁর একটি মাত্র ভাই কেবল জীবিত রয়েছে, তাঁর মানসিক অবস্থা কোন পর্যায়ে ছিল, এই সম্পর্কে ব্যাসদেব একটি শব্দও খরচ করেন নি। হস্তিনাপুরে তাঁরা ভীষ্মের সাথে এলেন এবং ধৃতরাষ্ট্রের সাথে গান্ধারীর বিবাহ হল। মহাভারতে লেখা আছে যে যেহেতু স্বামী দৃষ্টিহীন, কাজেই গান্ধারী তাঁর চোখ দুটি কাপড়ে আচ্ছাদিত করে রেখেছিলেন। অর্থাৎ দৃষ্টি থাকতেও গান্ধারী দৃষ্টিহীন হয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন।

এই প্রসঙ্গে একটা ব্যাখ্যা দেওয়া যেতেই পারে। গান্ধারী হস্তিনাপুর সম্পর্কে কতটা প্রীতিমতি ছিলেন তা বলা শক্ত। কারণ যে পরিবারে তিনি বধূ হয়ে এসেছেন, সেই পরিবারের প্রধান পুরুষ ভীষ্ম তাঁর পিতা ও ভ্রাতাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী। বাহুবলে জয়ী হয়ে, গান্ধার রাজ্যকে তছনছ করে তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছে। শকুনি ছাড়া তাঁর নিজের পরিবারের আর কেউ বেঁচে নেই। তাছাড়া স্বামী হিসাবে ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ ছিলেন। কাজেই এই বিবাহ সমানে সমানে হয়নি। এই বিবাহে পরাজয়, অধীনতা ও বশ্যতা স্বীকারের বেদনা ছিল। তাই কোনও কিছু দেখা বা তার রঙ রস রূপ উপভোগ করা, কিছুতেই গান্ধারীর আগ্রহ ছিল না। জীবন থেকে তিনি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ছিলেন বলেই চোখ দুটি আবৃত রাখার মতো তাঁর এই কঠিন সিদ্ধান্ত। তাছাড়া ধৃতরাষ্ট্রের তিনি প্রধানা মহিষী ছিলেন ঠিকই, কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের আরও অনেক সেবিকা ছিল। স্বামীর নিঃশর্ত প্রেম তিনি পাননি। স্বামী সম্পর্কে তাঁর ধারণা বিশেষ উচ্চ ছিল না। ধৃতরাষ্ট্র যে রাজ্যলোলুপ ও দুর্বল মেরুদণ্ডের মানুষ গান্ধারী তা উপলব্ধি করে ছিলেন। গান্ধারী খুব নিরাসক্ত ভাবে হস্তিনাপুরের রাজ অন্তঃপুরে ছিলেন। কিন্তু তাঁর মর্যাদাবোধ ও সহৃদয় আচরণ রাজপরিবারের সবাইকে মুগ্ধ করেছিল।

গান্ধারী এবং পাণ্ডুর স্ত্রী কুন্তী এদের মধ্যে অথবা অন্যান্য অন্তঃপুরিকাদের মধ্যে কোনও বিভাজন ছিল না। রাজঅন্তঃপুর ছিল শালীনতা, মর্যাদা ও আন্তরিকতায় ভরপুর। এর মূল কৃতিত্ব অবশ্যই গান্ধারীর। তিনি যতই বহির্জগত সম্পর্কে নিরাসক্ত থাকুন না কেন, রাজ অন্তঃপুরের প্রধানা হিসাবে তাঁর কর্তব্য ও দায়িত্ব তিনি কখনই অস্বীকার করেন নি। গান্ধারী রাজনীতি বা রাজসভার কূটকচালি নিয়ে কখনই মাথা ঘামান নি। কিন্তু তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন পুত্র দুর্যোধনের আচরণে। দুর্যোধন বীর, উন্নত চরিত্রের। প্রজারঞ্জক। কিন্তু পাণ্ডু পুত্রদের প্রতি অসম্ভব বিদ্বেষ পরায়ণ। বিশেষত ভীমের সাথে তার রেষারেষি মারাত্মক। তাতে ইন্ধন জোগান শকুনি। দুর্যোধন মাতৃভক্ত কি না জানা যায় না, কিন্তু মাতুল শকুনির সাথে তার সম্পর্ক বড়ই হৃদ্যতাপূর্ণ। পাণ্ডু পুত্রদের বিরুদ্ধে শকুনির দুরভিসন্ধি দুর্যোধনের খুবই মনোমত হয়। বিদুর প্রতিবাদ করেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র পুত্রকে শাসন করতে চান না। দুর্যোধন হয়ে ওঠেন উদ্ধত। হস্তিনাপুরে পাণ্ডবদের উপস্থিতি দুর্যোধনের কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে। তিনি বারংবার চেষ্টা করেন পাণ্ডু পুত্রদের প্রাণনাশ করার।

গান্ধারী জননী তবে ন্যায়ের পক্ষে। পুত্রকে স্নেহ করেন কিন্তু অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে রাজি নন। বারবার ধৃতরাষ্ট্রকে অনুরোধ করেন স্নেহবশে দুর্যোধনকে শাসন না করে কুরুকূলের সর্বনাশ যেন ডেকে না আনেন। শকুনিকে তিনি ভর্ৎসনা করেন তার অন্যায় আচরণের জন্য। গান্ধারীর দুর্ভাগ্য তিনি চেষ্টা করেও কিছু করে উঠতে পারেন নি। কর্ণ, শকুনি এবং দুর্যোধনের গোষ্ঠী ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষপাতিত্বে অন্যায়ের মহীরুহে পরিণত হয়। রাজা যেখানে অপত্যস্নেহে অন্ধ সেখানে রাজসভার অন্য সদস্যরা নির্বাক দর্শক। এই অসমান পরিবেশে পাণ্ডব ও কৌরব পক্ষ ধীরে ধীরে মনে মনে আসন্ন মহা সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে থাকে।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে গান্ধারী প্রত্যহ পুত্র দুর্যোধনকে বলেছেন ন্যায়ের জয় হবে। জয়ী হও বলে পুত্রকে কখনও আশীর্বাদ করেন নি। অবশেষে আঠারো দিন ধরে যুদ্ধের পরে ভারতবর্ষ ক্ষত্রিয়শূণ্য হয়ে পড়ল। তখন বেঁচে আছেন কেবল পাণ্ডুপুত্ররা, বিদুর, ধৃতরাষ্ট্র এবং যদুকুলোপতি শ্রীকৃষ্ণ। পুত্রশোকাতুরা গান্ধারী যমুনার তীরে সরাসরি পুত্রদের মৃতদেহের সামনে এই প্রথম আত্মসংবরণ করতে পারেন নি। তিনি ক্রোধে জ্বলে ওঠেন। সেই তেজ সহ্য করা অসম্ভব জেনে শ্রীকৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে ইঙ্গিত করেন গান্ধারীর চরণস্পর্শ করে ক্ষমা চাইতে। যুধিষ্ঠির যুদ্ধের সমস্ত দায় এবং গান্ধারীর পুত্রদের নিধনের দায় নিজের কাঁধে নিয়ে গান্ধারীর চরণস্পর্শ করে ক্ষমা চাইলেন। গান্ধারীর চোখের ওপর যে আবরণ ছিল তার ফাঁক দিয়ে গান্ধারীর দৃষ্টি যুধিষ্ঠিরের পায়ের নখের ওপর পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের পায়ের নখ কুৎসিত হয়ে গেল। এরপর গান্ধারী কৃষ্ণকেও অভিশাপ দেন। তিনি বলেন কৃষ্ণ এই মহাসংগ্রাম রোধ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি। ধর্মের মাদক সেবন করিয়ে অধর্মের মাধ্যমে তিনি কুরুকুল ধ্বংস করেছেন। ক্ষত্রিয় রমণীদের স্বামী হারা করেছেন। এর শাস্তি তিনি পাবেন। ছত্রিশ বছর পরে অত্যন্ত অসহায় ভাবে তাঁর মৃত্যু হবে। যদুকুল রমণীরা শ্লীলতাহানির মুখোমুখি হবে। আর কৃষ্ণ তাদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হবেন। যদুবংশীয়রা মাদকে আসক্ত ও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে নিজেদের পতন নিজেরা ডেকে আনবে। যদুবংশ ধ্বংস হবে।

প্রত্যেকটি ঘটনাই পরবর্তীকালে ঘটেছিল। কুরুকুল এবং যাদবকুল নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মা হিসাবে গান্ধারী পুত্রদের সৎপথে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। পারেন নি। আর কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পরিণতি এতো নির্মম ছিল যে তিনি আত্মস্থ থাকতে পারেন নি। কারণ তিনি জননী।