ছাত্র সংসদের নির্বাচনে রঘু বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করে। রঘু এসে আমাকেও ধন্যবাদ জানিয়ে যায়। রঘুকেও আমি আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানালাম। ওর সাফল্য কামনা করে ওকে বললাম - ভালো থাকিস।
টিপু সুলতানের ক্লাস চলছে। ওনার ওই ‘ইত্যাদি’-র ঠেলায় আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রায়। ঠিক এজন্যই ওনার ক্লাস অনেকে মন দিয়ে করে না। নিজেদের মধ্যে গল্প গুজব করে কাটিয়ে দেয়, মাঝে মাঝেই দুই একজনকে বকাবকিও করেন। কিন্তু ছেলে-মেয়েরা একটু বড়ো হয়েছে, ওদের জ্ঞানের বিকাশ ঘটেছে, ওরা বুঝতে পারে এটা কলেজ, স্যার যতই বকাঝকা করুন না কেন, তার বেশি কিছু করার ক্ষমতা ওনার নেই। কিন্তু এটা বোঝার মতো বুদ্ধি হয়নি যে, কেউ কেউ তো কলেজে পড়াশোনা করতেও আসে, তারা ডিসটার্বড হয়। আমি দেখলাম এভাবে চলতে থাকলে সবচেয়ে বড়ো ক্ষতি হবে আমার। তাই একদিন সাহসে ভর করে কলেজের জিএস-কে ব্যাপারটা জানালাম। জিএস আমাকে অভয় দিয়ে বললো - কিচ্ছু ভাবিস না ভাই, ব্যাপারটা আমি দেখছি। আমি জানি কেউ কেউ কলেজে সত্যি সত্যি পড়াশোনা করতে আসে, আরে এই জন্যই তো ছাত্র সংসদের দরকার।
তারপর ওরা একদিন ক্লাসে এসে বিষয়টি নিয়ে ক্যাম্পেইন করে গেল। আমি খানিকটা আশ্বস্ত হলাম। তারপর থেকে ক্রমশ ক্লাসগুলোতে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কমতে শুরু করলো। যে ক’জনের আগ্রহ বেশি কেবল তারাই মন দিয়ে ক্লাসটা করে, প্রশ্ন করে, পড়াটা বুঝে নেয়। ধীরে ধীরে এদের সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠলো। আমরা একটা গ্রুপ হয়ে গেলাম। অফ পিরিয়ডে আমরা কলেজের পূর্ব দিকের মাঠে গিয়ে বসতাম, পড়াশোনার আলোচনা ছাড়াও খেলাধূলা, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নানা কাজকর্ম, সম্পর্ক এবং কখনও কখনও রাজনীতির প্রসঙ্গ উঠে আসতো। তারপর শুনলাম কলেজে নবীন বরণ উৎসব হবে স্থানীয় রবীন্দ্রভবন মঞ্চে। বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এক উজ্জ্বল তারকা আসবেন। সবার মুখে মুখে আলোচনা চলছে, এই অনুষ্ঠানে কে কী পারফরম্যান্স করবে তার একটা পরিকল্পনাও চলছে। আমাদের গ্রুপের সবাই একসাথে আলোচনা করলাম যে, আমাদেরও একটা কিছু করা উচিত। আমি প্রস্তাব দিলাম - আমরা একটা নাটক পরিবেশন করবো।
প্রস্তাবটা যে গ্রহণযোগ্য তাতে কারও দ্বিধা নেই। তাহলে কী, মানে কোন নাটক করা যায় তা নিয়ে একপ্রস্থ আলোচনা হলো। অবশেষে ঠিক হলো রবিঠাকুরের “মুসলমানীর গল্প” কে নাট্যরূপ দিয়ে সেটাকেই পরিবেশন করা হবে। কিন্তু নাট্যরূপ দেবে কে? লাখ টাকার প্রশ্ন, সবাই ভাবতে শুরু করেছে। তাহলে কী তীরে এসে তরী ডুববে? একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, কেউ কোনো কথা বলে না। অবশেষে জীবেশ বললো — এ ব্যাপারে দক্ষ একজনই আমাদের মধ্যে আছে।
সবাই উৎসুকভাবে ওর দিকে তাকায় - কে সেই মহাপুরুষ?
তারপর লক্ষ্য করলাম জীবেশের তর্জনীটা আমার দিকে - সবাই একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি স্মিতহাস্যে বললাম - শেষে আমাকেই মুরগী করতে চাইছিস? না ভাই, এসব দায়িত্ব আমাকে দিস না তাহলে ইট-পাথরের বৃষ্টি তো হবেই, সেই সাথে কলেজের মান-মর্যাদা সবই যাবে।
জীবেশ মুখ ভেংচে বললো — ন্যাকামো করিস না। তোর ক্ষমতা যে কতটা সেটা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানেনা। যা যা লেগে পড় আর না করিস না। আগামী সপ্তাহ থেকে আমরা রিহার্সাল শুরু করবো।
আমার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। পারবো তো! তারপর শুনলাম দেবশ্রী রায় আসছেন। মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। আমার প্রিয় নায়িকাদের একজন। খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাবো। উনি আমাদের কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের অনুষ্ঠান দেখবেন, নিজেও কিছু টিপস দেবেন। মনের মধ্যে একটা অজ্ঞাত শক্তি কাজ করতে শুরু করলো। যেভাবেই হোক নাটকটা নামাতে হবে, আর পিছিয়ে গেলে চলবে না। সারারাত ধরে গল্পটা বারকয়েক পড়লাম। তারপর লেগে গেলাম কাজে। লেখার হাতটা যে খুব একটা খারাপ ছিলো একথা কেউ বলেননি কোনোদিন। বরং দুই একটা কবিতা বা ছোটগল্প যা লিখে পত্রিকায় পাঠিয়েছি অনেকেই তার প্রশংসা করেছেন। গল্পের নাট্যরূপ দিতে বেশি সময় লাগলো না। পরদিন কলেজে গিয়ে দেখলাম নবীনদের বরণ করার প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। ক্লাসে ক্লাসে নোটিশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে — আগামী চব্বিশে ডিসেম্বর নবীন বরণ উৎসব উদযাপন করা হবে। যারা এই অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতে চায় তারা অবিলম্বে ছাত্র সংসদের অফিসে যোগাযোগ করবে। আগামী তিন দিনের মধ্যে সমস্ত কর্মসূচি তৈরী হয়ে যাবে।
অফ পিরিয়ডে আমরা সবাই এক জায়গায় জড়ো হলাম। জীবেশ বললো - জয়, তোর কাজ কতদূর, মানে কতটা এগুতে পারলি?
আমি ঠাট্টা করে বললাম - চিন্তা কোরো না বৎস, ট্রেন স্টেশনে পৌঁছে গেছে। এখন যাত্রীরা নেমে পড়লেই কাজ শুরু করা যায়।
জীবেশ বললো - তার মানে নাটক রেডি?
- তবে আর বলছি কী। আমি পড়ে শোনাচ্ছি, সবাই মন দিয়ে শুনবি। কোথায় কী সমস্যা আছে সেটা ভালো করে লক্ষ্য করবি। সংযোজন, বিয়োজনের ব্যাপারটা মাথায় রাখবি, তোদের মতামত পেলেই সংসদ ভবনে গিয়ে আমাদের পারফরম্যান্সের কথা জানিয়ে আসবো।
সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালে আমি নাটকটি পড়তে শুরু করলাম। সম্পূর্ণ নাটকীয় ভঙ্গিতে পড়লাম, সংলাপের ওঠানামা, এক্সপ্রেশন, শব্দের স্ট্রেস এবং নাটকের পরিপূর্ণ পরিকল্পনা কীভাবে পরিবেশন করা হবে তার সমস্ত বিষয়গুলি ব্যাখ্যা করলাম। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। আমার নাটক পাঠ ও ব্যাখ্যা শেষ হলে জীবেশ চিৎকার করে বললো - ব্র্যাভো ব্রাদার, ব্র্যাভো। তবে? আমি ঠিক জহুরিকেই বেছে নিয়েছি, তোরা দেখলি তো? বলে কীনা পারবো না। মারবো কান ঝাপটা একটা।
- আরে, কেমন হলো তাই বল। এটা করা যাবে তো?
- করা যাবে মানে, এটাই করবো। এর থেকে ভালো কিছু আর হতে পারে না। জয়, তুই এক কাজ কর নাটকের চরিত্রগুলো কোনটা কাকে দিবি সেটা ঠিক করে নে। আমি কিন্তু হবির খাঁ করবো তা আগেভাগেই বলে রাখলাম। আমি চট করে সংসদ ভবন থেকে আসছি।
জীবেশ চলে যেতেই আমরা আলোচনায় বসলাম। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই, তাই আজ থেকেই আমাদের নাটকের মহড়া শুরু করা উচিত। সবাই একবাক্যে রাজি হলো। জীবেশ আসতেই আমরা কোনোরকম সময় নষ্ট না করে লেগে পড়লাম নাটকের মহড়ায়। প্রথমে বসে বসেই সংলাপ বলা শুরু হলো। তারপর প্রত্যেককে তাদের চরিত্র বুঝিয়ে দেওয়া হলো এবং সংলাপ লিখে নিতে বলা হোলো। তখন তো জেরক্স মেশিন কৃষ্ণনগরে চালু হয়নি তাই কার্বন দিয়ে কপি করে নিতে বলা হোলো। ছোটো নাটক, মাত্র চল্লিশ মিনিটের। সুতরাং ছাত্র সংসদের সদস্যরা সহজেই অনুমোদন করলো। কেবল আমাদের সতর্ক করে দিয়ে বললো - আর যাইহোক নাটকটা যেন কলেজের মান রাখে।
আমি বললাম - চিন্তা কোরো না দাদা, আশা করি ভালোই হবে।
স্কুলে বেশ কয়েকবার নাটকে অভিনয় করেছি। সুতরাং আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি নেই। তাছাড়া আমরা সবাই মোটামুটি প্রাপ্তবয়স্ক। কোনো অঘটন না ঘটলে নাটকটি ভালোই হবে। জীবেশ, সুকন্যা, সুচন্দ্রা, রূপা, সমীরণ সজীব সবাই মনপ্রাণ দিয়ে নাটকের মহড়া দিচ্ছে। কোন কোন জায়গায় কীভাবে সংলাপ থ্রো করতে হবে সেটা ঠিক করে নেওয়া হচ্ছে। দিন পনেরোর মধ্যে আমাদের নাটক রেডি হয়ে গেল। নাটকে ব্যবহৃত সাজপোশাক ও অন্যান্য দ্রব্যাদি কীভাবে সংগ্রহ করা হবে সে সম্পর্কে সজীবের ধারণা ছিলো। ও জানালো যে, বেলেডাঙ্গা রেলগেটের ওপারে একজন পোশাক ও অন্যান্য দ্রব্যাদি ভাড়া দেয়। আজ বিকেলে ওখানে গেলে হয়। আমি বললাম - আমার তো টিউশনি আছে, তোরা বরং যা। সজীব আর জীবেশ যেতে পারিস আর সুকন্যাদের বাড়িও তো ওইদিকে কোথায়, তুই ওদের সাথে থাকতে পারিস।
ঠিক হলো ওরা তিনজনই যাবে। পোশাক নাহয় হোলো, কিন্তু মেক-আপ আর্টিস্ট? মিউজিকটা মানে আবহসঙ্গীত কে করবে? সত্যি তো এটার কথা তো ভাবা হয়নি। অনেক বড়ো কাজ বাকি অথচ আমরা...?
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। রূপা হঠাৎই বলে উঠলো - এই আমাদের বাড়ির পিছনে শম্ভুদা থাকেন। উনি খুব ভালো মেক-আপ আর্টিস্ট ওনাকে একবার ব’লে দেখলে হয়।
- তা ভালোই হবে। তুই একবার কথা বলে দেখতে পারিস। তারপর নয় আমরা সবাই একসাথে গিয়ে কথা বলে আসবো।
রূপা সম্মতি জানালে আমরা কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম।
(ক্রমশ)