ফাঁকা রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকান দেখে গাড়িটা থামাল বিকাশ। বহরমপুর -কৃষ্ণনগর রাস্তার নব্বইভাগ ফোর লেন হয়ে যাওয়ায় রাস্তার পাশের দৃশ্যপট এক্কেবারে বদলে গেছে। এক্কেবারে অচেনা লাগছে অনেক জায়গাই। গঞ্জ, মফস্বলের বুক চিরে এই মসৃণ ফোর লেন রাস্তা যাওয়ায় জায়গাগুলোর চেহারায় আধুনিকতার ছাপ স্পষ্ট। চায়ের দোকানদারকে চা অর্ডার দেবার পর রাস্তার পাশে এই নতুন গজিয়ে ওঠা দোকানেও সেই আধুনিকতার ছাপ পরিস্কার চোখে পড়ল বিকাশের।
অনেকদিন পর বীথির কাছে যাচ্ছে এবার। ইয়ার-এন্ডের ধকল সামলে প্রায় মাসখানেক পর কৃষ্ণনগর। বৌ আর ছেলের জন্য ব্যাঙ্ক থেকে এবার সপ্তাহ খানেকের ছুটি ম্যানেজ করেছে। বীথির এক সহকর্মীর বিবাহবার্ষিকীর নেমন্তন্ন আজ সন্ধ্যায়। কাল সকালে সপরিবারে মন্দারমনি। গাড়ি নিয়ে লং ড্রাইভ।
দাদা, আপনার চা। বিস্কুট দেব?
দিন একটা নোনতা বিস্কুট। দোকানি বয়াম খুলে একটা বিস্কুট এগিয়ে দিল বিকাশের হাতে।
আপনার এই দোকানটা কত দিন করেছেন? বিকাশ দোকানের পিছনের সবুজ ধানখেতের দিকে তাকাতে তাকাতে প্রশ্ন করল।
বেশিদিন নয় দাদা। আজ তো শনিবার, সামনের সোমবার এক মাস হবে।
হ্যাঁ। আগে দেখিনি। আমি তো সপ্তাহে একবার যাই এই পথ দিয়ে। এবারই চল্লিশ দিন পর যাচ্ছি বাড়ি। এই প্রথম দেখলাম। তা আগে কী করতেন?
আগে ছেলেমেয়ে পড়াতাম গাঁয়ে। এই পিছন দিকেই আমাদের গাঁ। করোনা, লকডাউনের পর আমাদের গাঁয়ের স্কুলে পড়া মেয়েগুলোর সব বিয়ে দিয়ে দিল বাপ-মায়ে আর ছেলেগুলো রাজমিস্ত্রী খাটতে কেরল চলে গেল এক দালালের পাল্লায় পড়ে। হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রী প্রায় পঞ্চাশ ভাগ কইমে গেছে। আমি জনা পঞ্চাশেক পড়াতাম। এখন ছাত্রছাত্রী আট জন।
- সিগারেট হবে?
বিকাশের কথা ফুরোতে না ফুরোতেই দোকানদার একটা ছোট গোল্ডফ্লেক দেখিয়ে বলে চলবে? বিকাশ বলে - তাই দিন। সিগারেট ধরাতে ধরাতে বিকাশ আবার জিজ্ঞেস করে, - তা আপনার দোকান চলছে কেমন?
দোকানি একা গাল হেসে বলে, নতুন দোকান তো। সময় লাগবে দাদা। তবে প্রতিদিনই একটু একটু করে বিক্রি বাড়ছে। আসলে সবাই চিনছে তো! সন্ধেবেলা গাঁয়ের মুরুব্বি মানুষজন এসে বসে। চা, বিড়ি বিক্রি হয় ভালই।
বিকাশ চায়ের দাম মিটিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। বেলা যে বাড়ছে তা রোদের তাপে জানান দিচ্ছিল বেশ। জানলার কাচ তুলে দিয়ে এসিটা চালিয়ে দিল সে। মিউজিক সিস্টেমে গান চালিয়ে নিজেও গুনগুন শুরু করল। এবার সোজা বাড়ি। ফোন বেজে উঠল। বিকাশ দেখল বীথি ফোন করেছে।
হ্যালো।
আরে কতদূর তুমি?
এই পলাশী ঢুকছি।
এতক্ষণে! কালকের জন্য কিছু গোছগাছ করতে হবে নাকি?
এই তো যাচ্ছি।
(২)
এই হল আমার সহকর্মী কাম বোন শিবানী আর ইনি সুব্রতদা। আমাদের স্কুলে নতুন ট্রান্সফার নিয়ে এসেছেন মাজদিয়া থেকে। এদের দুজনের সাবজেক্ট ইংরাজি।
বীথির পরিচয়ের সাথে সাথে বিকাশ হাত বাড়িয়ে দেয় দুজনের দিকে। তারপর বলে, এই অধমের নাম বিকাশ ব্যানার্জি। ইচ্ছে হলেও একই কর্মক্ষেত্র ভাগ করে নিতে পারব না।
সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। সুব্রত বলে ওঠে, দুর্ভাগ্য না সৌভাগ্য তা আর এই জীবনে বুঝে উঠতে পারবেন না এটা অবশ্যই আফশোষের।
বিকাশ সুব্রতর ইঙ্গিত বুঝতে পেরে হাসে। কনুই দিয়ে ঠেলা মারে বীথিকে।
পাশের ঘর থেকে এক ভদ্রমহিলা সরবতের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢোকে। সুব্রত তার দিকে তাকিয়ে বলেন, আরে দিদি, আপনি কেন? রেণুমাসি আছে তো? অঙ্কুশ বিকাশের ফোন নিয়ে খেলছিল। সেদিকেই নজর ছিল বিকাশের। ভদ্রমহিলা বিকাশের সামনে ট্রে ধরে বলল, দাদা গ্লাসটা তুলে নিন। বিকাশ সরবতের গ্লাস তুলতে গিয়ে নজর পড়ল ভদ্রমহিলার দিকে। একটু বিস্মিত থেকে প্রশ্নটা করেই ফেলল, 'আরে! তুমি শ্যামলী না?'
উল্টোদিকের সোফায় বসেছিল শিবানী। সেই উত্তর দিল। হ্যাঁ বিকাশদা। আমার বড়দিদি শ্যামলী। আপনি চেনেন! কী করে?'
- সেটা তো আপনার দিদিই ভাল বলতে পারবে। সরবতের গ্লাসটা তুলে নিতে নিতে বলল বিকাশ। শ্যামলী অনেকক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে থাকল বিকাশের দিকে। তারপর খুব দ্বিধা নিয়ে আস্তে আস্তে বলল, 'বিকাশ? ঠিক বলেছি?'
- হ্যাঁ রে। ঠিক না বললে তোকে ডাক্তার দেখাতে বলতাম। বিকাশ হাসতে হাসতে বলল।
- তাই নাকি? চুলগুলো কোথায় মানত করে দিয়ে এসেছিস বাপ? তোর যা সুন্দর কোঁকড়ানো চুল ছিল কলেজে পড়ার সময়। এখন চেনা কিন্তু মুসকিল।'
বিকাশ আর শ্যামলী একটু আলাদাই হয়ে গেল। ওরা আলাদা হয়ে নিজেদের কলেজ জীবনের কত স্মৃতিচারণা করল। বিকাশ জানতে পারল, শ্যামলীর স্বামী মারা গিয়েছে বিয়ের দশ বছরের মধ্যেই। পুলিশে চাকরি করতো। খুব মদ খেত। তাতেই সিরোসিস অফ লিভারে মারা গিয়েছিল। এক মেয়ে শ্যামলীর। এবার মাধ্যমিক দেবে।
বীথি দু’বার খাবারের জন্য ডাকতে এল। 'পরে যাচ্ছি' বলে বীথিকে ফিরিয়ে দিল। শ্যামলীই শেষে বলল, এই শোন, এরপর তোর বউ কিন্তু সন্দেহ করবে! চল খেতে চল। আচ্ছা, তুই কি জানিস শান্তনু এখন কোথায়? তোর সঙ্গে যোগাযোগ আছে?
(৩)
তুমি বাপু যতই শান্তনুর গল্প শোনাও আমার কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না। সত্যি করে বল, কলেজজীবনে কি শিবানীর দিদির সঙ্গে তোমার এফেয়ার ছিল? কোলাঘাটে গাড়ি থামিয়ে চা আর ফিস ফিঙ্গার খেতে খেতে বীথি বিকাশকে জিজ্ঞেস করল। বিকাশ ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বলল, কী উল্টো পালটা বকছ ছেলের সামনে? অঙ্কুশের ক্লাস এইট এটা মাথায় রেখে কথা বলবে। অঙ্কুশ মায়ের মোবাইলে গেম খেলতে ব্যস্ত ছিল। বীথি ইশারায় বোঝাল ওর কানে কিছুই ঢুকবে না এখন। বিকাশ তাও ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে চুপ থাকতে বলল।
কোলাঘাট থেকে রওনা দেবার সময় বীথি কায়দা করে অঙ্কুশকে ফোন ধরিয়ে পিছনের সিটে বসতে রাজি করাল। বিকাশ বীথির এই কৌতুহলী মানসিকতায় বিকাশ হেসে ফেলল। বলল, 'তুমি কিন্তু আমার বয়স কমিয়ে দিচ্ছ। এরপর দুষ্টুমি করলে দোষ দিও না আমায়।'
বীথি বলল, সে আমি পরে দেখে নেব। এখন বল, শ্যামলী আর তোমার গল্প।
আরে! তুমি শান্তনুর অস্তিত্ব বিশ্বাস করছ না? আচ্ছা, ফেরার পথে তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেব। এখন শুধু জেনে রাখ, আমি শুধু ওদের মধ্যে পিয়নের কাজ করতাম। শান্তনুকে হিংসে করতাম বটে। কারণ ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। শ্যামলী যখন ওর জীবনে এল তখন ও একটু একটু করে দূরে সরে গেল। আমার কোনও কাজে, কোনও সমস্যায় ওকে ডাকলে পেতাম না। অথচ, ওরা দুজনেই ওদের যাবতীয় কাজে আমাকে লাগাত। বিশেষ করে দুজনের বাড়িতে দুজনের মিথ্যে সামাল দিতে।
- তা এখন তোমার বন্ধু কোথায়? কী করছে সে এখন? তোমার মুখে কোনওদিন শ্যামলী আর শান্তনুর নাম শুনিনি কেন?
- 'বাবান। এবার কিন্তু আমি ফোনটা কেড়ে নেব। তোমাকে কিছু না বললে কি তুমি সারাটা রাস্তা এভাবেই গেম খেলবে? চোখ খারাপ হলে কী হবে?' বেশ জোরেই ছেলেকে ধমকায় বিকাশ। অঙ্কুশ ভয়ে মোবাইলটা বীথিকে দিয়ে দেয়।
- বীথিও চুপ করে যায়। আস্তে আস্তে মেঘ উঠে আসে আকাশে। কালো হয়ে ওঠে আকাশ। টুপটাপ বৃষ্টি পড়ে গাড়ির কাচে। এতক্ষণের রোদের তাপে বাষ্প হয়ে উবে যায়। রিসোর্টের বড় গেট দিয়ে বিকাশের গাড়ি ঢুকে পড়ে ভিতরে।
(৪)
বিচের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে এসেছে বীথি আর বিকাশ। বালির উপর বেশিক্ষণ হাঁটা খুব সহজ কাজ নয়। ওদের দুজনের অসুবিধা কম হচ্ছে কারণ ওরা চটি বা জুতো পরে বের হয়নি। অঙ্কুশকে বারবার ডেকেও ঘুম থেকে তোলা যায়নি। সূর্যোদয়ের রক্তিম আনন্দ নিতে ওরা দুজনেই ভোরবেলা বেরিয়ে পড়েছে রিসোর্ট থেকে। অথচ দুজনের মধ্যে কোনও কথা নেই। শুধুমাত্র পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া। বিকাশকে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়াতে দেখে বীথি চুপ করে গিয়ে সেই দোকানের সামনে পাতা চেয়ারে বসে পড়ে। দুজনে ঢেউ ভাঙার খেলা আর ওদের শেষ দিনের মন্দারমনির সূর্যোদয় দেখে। চা খাওয়া শেষ হলে আবার হাঁটতে থাকে। বিকাশ বীথিকে কিছু বলতে চায় কিন্তু ভয় পায়। প্রথম দিনে রাতে সরি বলেছিল একবার কিন্তু তাতে বীথির উত্তর শুনে নিজের উপর ঘুব ঘেন্না হয়েছিল।
- 'সরি কেন? রাতে আমার শরীর চাই তাই?' ঘর থেকে বেরিয়ে রাত দুটো পর্যন্ত রিসোর্টের গার্ডেনে বসেছিল বিকাশ। ঘরে ঢুকলে দেখে বীথি শুয়ে আছে। বীথি যে ঘুমায়নি তা বুঝে নিজে শুয়ে পড়েছিল।
অঙ্কুশ ফোন করেছিল বীথিকে। ফোনটা রেখেই বীথি বিকাশকে বলল, বাবান উঠে গেছে। আর তারপরেই হাঁটা দিলে উল্টো দিকে, রিসোর্ট অভিমুখে।
ফেরার পথে বিকাশ কোনা এক্সপ্রেস ওয়ে থেকে গাড়ি অন্য দিকে নিয়ে যাচ্ছিল দেখে বীথি জিজ্ঞেস করল এদিকে কোথায়?
সারপ্রাইজ দেব বলেছিলাম। তাই। বিকাশ সিগারেটের শেষাংশ গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে দিয়ে কাচ তুলে দিল। আবার এসি চালিয়ে দিল গাড়ির।
বিকাশদের গাড়ি এসে দাঁড়াল সোনারপুর মেন্টাল এসাইলামে। বীথি অবাক হয়ে বিকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বিকাশ অঙ্কুশকে বলে, বাবান, আমাদের একটা কাজ আছে এখানে। গাড়ির এসি চালানো থাকল। তুমি গাড়িতেই থাকো। আমরা আধাঘন্টার মধ্যে কাজ সেরে আসছি। বীথি নিজের মোবাইল অঙ্কুশকে দিয়ে গাড়ি থেকে নামে। রিসেপশনে গিয়ে বিকাশ খাতায় লেখে শান্তনু সেন। বীথি অবাক হলেও আশ্বস্ত হয় যে শান্তনু সেন নামে কেউ আছে।
কী রে বেটা তুই কী আঁকছিস? বিকাশ শান্তনুকে জড়িয়ে ধরে ওর ঘরে ঢুকে।
কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থাকে শান্তনু। তারপর বলে, হাঁ হাঁ। দাঁড়ান। একদিকের দেয়ালে একটা মস্ত ক্যানভাস কাপড়ে ঢাকা। শান্তনু সেদিকে এগিয়ে গিয়ে কাপড়টা টান মেরে খুলে দিল। বীথি দেখল, সেই বিরাট ক্যানভাসে শ্যামলীর মুখ আঁকা।
দেখুন তো এঁকে কোথায় দেখেছেন কিনা! এই মেয়েটা একদিন হঠাৎ করে ভ্যানিস হয়ে গেল। আমাকে কথা দিয়েছিল। কথা না রেখেই হারিয়ে গেল। আমি খুঁজছি। জানেন আপনি? আপনি একে এনে দিতে পারবেন? বিকাশ শান্তনুকে চেপে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।
(৫)
ফেরার পথে এয়ারপোর্ট পেরিয়ে গাড়ি থামায় বিকাশ। দুপুরের খাওয়া বাকি। অঙ্কুশ অনেকক্ষণ থেকেই খিদে পেয়েছে বলছিল। শান্তনুকে দেখার পর তার আর খিদে নেই। সে শুধুই ভাবছে, শ্যামলীকে একবার দেখা করানো যায় কিনা!
বীথি খাবার টেবিলে বসে বিকাশের হাত ধরে। বলে, আমি লজ্জিত। তুমি যা শাস্তি দেবে দিও কিন্তু কথা বল। আর গল্পটা বল যে কী হয়েছিল তোমাদের?
বিকাশের চোখ ছলছল করে ওঠে। বলে, আমার জীবনে তোমার আগে কোনও মেয়ে ছিল না। এ কথা সত্যি। কিন্তু এ কথাও সত্যি যে আমার জীবনে শান্তনু ছিল। শ্যামলী শান্তনুর জীবনে আসার আগে পর্যন্ত আমিই ছিলাম শান্তনুর জীবনে। সেই ক্লাস ফাইভ থেকে আমাদের আলাদা করে কেউ দেখেনি। রাস্তাঘাট, স্কুল, কলেজ, সিনেমা থিয়েটার - সর্বত্র আমরা মানিকজোড়। কলেজে ঢোকার পর কেউ কেউ আমাদের 'গে' বলে ঠাট্টা ইয়ার্কিও করতো। আমরা গায়ে মাখিনি। দুজনের কেউই মাখিনি গায়ে। কিন্তু থার্ড ইয়ারে পড়াকালীন শ্যামলী এল শান্তনুর জীবনে আর ও এড়িয়ে যেতে লাগল আমাকে। আমি হঠাৎ করেই একা হয়ে গেলাম।' গলা ধরে এল বিকাশের। বীথি পিঠে হাত বোলাতে থাকল। খাবার দিয়ে গেছে। বীথি খাবার সার্ভ করতে করতেই বলল, তুমি বলতে থাক। কষ্ট পেওনা। আমি আছি বিকাশ। তোমার সঙ্গে আছি। সারাজীবন থাকব।'
গলা ঝেড়ে নিয়ে বিকাশ বলল, একদিন শুনলাম ওরা বিয়ের কথা ভাবছে। শান্তনু খুব বড়লোকের ছেলে। ওর জীবিকা নিয়ে ভাবনা ছিল না। অনার্স পাশ করার পর থেকেই ও ঠিক করেছিল শিল্পী হবে। শ্যামলীর বাড়িতে আমার যাতায়াত ছিল এবং কাকুকাকিমা আমাকে খুব ভালবাসতেন। একদিন কী মনে হল, কাকিমাকে সব বললাম ওদের সম্বন্ধে। সঙ্গে দুটো কথা বাড়িয়ে বললাম। প্রথমত, শান্তনু বোহেমিয়ান টাইপের ছেলে। এখানে ওখানে শিল্পীদের সঙ্গে গিয়ে মদ, গাঁজা আর ড্রাগস খায়। দ্বিতীয়ত, ওরা খুব শীঘ্রই রেজিস্ট্রি করে নেবে।'
বীথি রূপকথার গল্প শোনার মতো হাঁ করে শুনছিল সব। বিকাশ একটু থেমে খেতে শুরু করল। তারপর ইশারায় দেখাল যে অঙ্কুশের খাওয়া শেষ এবং মোবাইল গেম শুরু। বীথি এক টুকরো নান মুখে ভরে বলল, তারপর?
- শ্যামলীর বাবা তিনদিনের মধ্যে সুরাটে এক মামার কাছে শ্যামলীকে দিয়ে এলেন এবং রটিয়ে দিলেন শ্যামলী বেপাত্তা, ভ্যানিস।
শান্তনু আমাকে শ্যামলীর বাড়ি পাঠাতে থাকে। সত্যি বলতে কি শ্যামলীর বাবা, মা আমাকেও কিছু জানাননি।
কিছুদিন পর শান্তনুর মাথা খারাপ হয়ে যায়। ওর বাবা-মা'র পয়সার অভাব নেই। সব রকমের ডাক্তার দেখানো হয়। কিন্তু ব্যবস্থা কিচ্ছু হয় না। ক্রমশ ওর মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা খারাপ হয়। দুবার সুইসাইডও করতে যায়।
তাই কি বাধ্য হয়ে এসাইলামে? বীথি চোখ মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করে।
বিকাশ বলে, হ্যাঁ। তাছাড়া কাকু কাকিমার বয়স হচ্ছিল। দেখভাল করার অসুবিধা হচ্ছিল।
বীথি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বলে, তুমি তো সব যোগাযোগ রেখেছিলে। আমাকে বলোনি। রাগ করছি না। হয়তো এতটা সত্যি শোনার মতো কাছের হতে পারিনি তোমার। কিন্তু তুমি কি শ্যামলীকে এসব বলবে? তুমি কি ভাবছ যে শ্যামলীকে দেখলে শান্তনুদা ঠিক হয়ে যাবে?
- একবার মনে হচ্ছে চান্স নিয়ে দেখি। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হচ্ছে যদি হিতে বিপরীত হয়?
বীথি কাঁধে হাত রাখে বিকাশের। ঠিক ভেবেছ। নিয়তি ওদের গন্তব্য স্থির করে দিয়েছে। তুমি আর নতুন কোনও ভুল কোরো না। চলো যাওয়া যাক।
(৬)
কার সঙ্গে দেখা করবেন ম্যাডাম?
সোনারপুর এসাইলাম সেন্টারের রিসেপশনের কর্মী খাতা বাড়িয়ে দেয়।
- শান্তনু সেনের সঙ্গে।
খাতা নিজের দিকে টেনে নিয়ে বীথি সই করে শ্যামলী দত্ত।
বিকাশের ভুলের, বিকাশের ভালবাসার ক্ষতিপূরণের দায় তো তারও। সে তো বিকাশকেই ভালবাসে। বিকাশ না হয় শান্তনুকে ভালবাসুক তার চেয়ে বেশি।